মিয়া, ধীর আলী
মিয়া, ধীর আলী (১৯২০-১৯৮৪) বংশীবাদক, সুরকার, সঙ্গীত, অর্কেস্ট্রা পরিচালক। ১৯২০ সালের ১ জানুয়ারি মুন্সিগঞ্জজেলার টঙ্গিবাড়ি উপজেলার বাঁশবাড়ি গ্রামে তাঁর জন্ম। স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অধ্যয়নশেষে তিনি কিছুদিন সোনারং উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। কিন্তু সঙ্গীতের প্রতি অনুরাগবশত পড়ালেখায় ইস্তফা দিয়ে প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ পিতৃব্য সাদেক আলীর নিকট শৈশব থেকেই বংশীবাদনে পাঠগ্রহণ শুরু করেন। ধীর আলী বাঁশি ছাড়া বেহালা, গিটার এবং ক্লারিওনেট বাদনেও বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। তবে বংশীবাদক হিসেবেই তাঁর খ্যাতি সর্বাধিক। আধুনিক বাংলা গানে লোকসঙ্গীতের সুর সংযোজন করে তিনি এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেন।
ধীর আলী ১৯৪৫ সালে অল ইন্ডিয়া রেডিওর ঢাকা কেন্দ্রে অনিয়মিত বংশীবাদক হিসেবে পেশাগত জীবন শুরু করেন। দেশ বিভাগের পর ১৯৪৮ সালে এই কেন্দ্রেই তিনি নিজস্ব শিল্পী হিসেবে যোগদান করেন এবং ১৯৮৩ সালে উপপ্রধান সঙ্গীত প্রযোজক হিসেবে চাকরি থেকে অবসর নেন। তিনি বুলবুল ললিতকলা একাডেমী ও আর্টস কাউন্সিলের প্রশিক্ষণ কোর্সে শিক্ষকতার দায়িত্বও পালন করেন।
ধীর আলী ‘ঢাকা অর্কেস্ট্রা’ নামে একটি অর্কেস্ট্রা দল গঠন করে সঙ্গীতের উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। দেশের বাইরে বিভিন্ন সঙ্গীত সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে তিনি তাঁর সাঙ্গীতিক প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। ১৯৫২ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত লাহোরে অনুষ্ঠিত ‘অল পাকিস্তান রেডিও মিউজিক কনফারেন্স’-এ শিল্পী ও প্রযোজক হিসেবে তিনি নিয়মিত অংশগ্রহণ করেন এবং বাংলা সঙ্গীতকে অবাঙালি বিশেষজ্ঞ-শ্রোতাদের নিকট তুলে ধরেন। এছাড়া ভারতে অনুষ্ঠিত বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলনেও তিনি দুবার অংশগ্রহণ করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭২ সালে তিনি ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। সাংস্কৃতিক প্রতিনিধিদলের সদস্যরূপে তিনি রাশিয়া এবং আফগানিস্তানও সফর করেন।
হিজ মাস্টার্স ভয়েজ এবং ঢাকা গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে ধীর আলীর সুরে ও পরিচালনায় অনেক গানের রেকর্ড প্রকাশিত হয়। সেসবের মাধ্যমে তাঁর সঙ্গীতপ্রতিভার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।
ধীর আলী চলচ্চিত্র জগতের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। ঢাকা থেকে নির্মিত প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য ছায়াছবি মুখ ও মুখোশ-এ তিনি সহকারী সঙ্গীত পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীকালে তিনি নাচঘর, উজালা, জোয়ার এলো, কাঞ্চনমালা, আবার বনবাসে রূপবান, দস্যুরানী, কাজলরেখা প্রভৃতি ছায়াছবিতেও সঙ্গীত পরিচালনা করে কৃতিত্বের পরিচয় দেন।
সঙ্গীতক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য পাকিস্তান সরকার ১৯৬৫ সালে ‘তমঘায়ে ইমতিয়াজ’ এবং বাংলাদেশ সরকার ১৯৮৬ সালে ‘একুশে পদক’ (মরণোত্তর) প্রদানের মাধ্যমে তাঁকে সম্মানিত করে। [মোবারক হোসেন খান]