খাজা শাহবাজ মসজিদ-সমাধি কমপ্লেক্স
খাজা শাহবাজ মসজিদ-সমাধি কমপ্লেক্স ঢাকা হাইকোর্টের পশ্চিম পার্শ্বে এবং আধুনিক সমাধি কমপ্লেক্স ‘তিন নেতার মাযার’এর পূর্ব পার্শ্বে অবস্থিত। দক্ষিণ দিকে একটি প্রবেশপথসহ একটি নিচু প্রাচীর বেষ্টনীর ভেতরে সমস্ত কমপ্লেক্সটি আবদ্ধ। প্রধান প্রবেশপথের উপরে স্থাপিত উৎকীর্ণ শিলালিপি থেকে জানা যায় যে, শাহজাদা মুহম্মদ আজম-এর সুবাহদারিকালীন সময়ে ঢাকার বণিক শাহজাদা খাজা শাহবাজ ১৬৭৯ খ্রিস্টাব্দে এটি নির্মাণ করেন।
মসজিদ মাটির উঁচু ভিটির উপর অবস্থিত। বাইরের দিকে এর পরিমাপ ২০.৭৩ মি × ৭.৯২ মি। চার কোণের বুরুজগুলি প্যারাপেট পর্যন্ত অষ্টভুজাকার এবং এর পর উপরের অংশ গোলাকার। বুরুজগুলি শীর্ষে ছোট শিরাল গম্বুজ (ribbed cupolas) এবং কলস ফিনিয়াল দ্বারা সজ্জিত। পূর্ব দিকের ফাসাদের কেন্দ্রে একটি অভিক্ষিপ্ত ফ্রণ্টন স্থাপিত যার মাঝে মসজিদের কেন্দ্রীয় খিলানপথটি একটি পাথরের ফ্রেমের মধ্যে ন্যস্ত। কেন্দ্রীয় খিলানপথটির দুপাশে অপেক্ষাকৃত ছোট দুটি খিলানপথ রয়েছে। পূর্ব দিকের তিনটি প্রবেশপথই পর পর দুটি খিলান দ্বারা গঠিত বাইরের দিকের খিলানটি খাঁজকাটা ও ভেতরেরটি অপেক্ষা উঁচু, আর অভ্যন্তরভাগের খিলানটি চতুর্কেন্দ্রিক ধরনের এবং এর শীর্ষবিন্দুতে রয়েছে ওজী (Ogee) আকারের বক্রবস্ত্ত। উত্তর এবং দক্ষিণ দেওয়ালেও একটি করে খিলানপথ রয়েছে। পশ্চিম দেওয়ালে অভ্যন্তরভাগে প্রায় অষ্টভুজাকৃতির কুলুঙ্গিত তিনটি মিহরাব আছে যার কেন্দ্রীয়টি ঐতিহ্যগতভাবে বড় এবং বাইরের দিকে অভিক্ষিপ্ত। কেন্দ্রীয় মিহরাবের পাশে একটি তিন ধাপ বিশিষ্ট মিম্বার রয়েছে। কেন্দ্রীয় মিহরাব এবং প্রবেশপথ উভয়েরই অভিক্ষিপ্ত কাঠামোর দুপাশে রয়েছে ছোট মিনার (turrets) এবং এগুলি প্যারাপেট ছাড়িয়ে উপরে উঠে গেছে। এ ছোট মিনারগুলির শীর্ষ ছোট গম্বুজ ও কলস চূড়া দ্বারা সজ্জিত।
ইটের জোড়া স্তম্ভ থেকে উত্থিত দুটি প্রশস্ত বহু-খাঁজ বিশিষ্ট আড়াআড়ি খিলান মসজিদ অভ্যন্তরকে ৫.১৮ বর্গাকার পরিমাপের তিনটি সমান ‘বে’তে বিভক্ত করেছে। প্রত্যেকটি ‘বে’ অনুচ্চ কাঁধ যুক্ত ড্রামের উপর স্থাপিত গম্বুজ দ্বারা আচ্ছাদিত। পদ্ম ও কলস চূড়ায় সজ্জিত গম্বুজগুলি প্রবেশপথ এবং মিহরাবের উপরে অবস্থিত দুটি প্রশস্ত খিলান ও বদ্ধ খিলানের উপর স্থাপিত এবং এদের অবস্থানান্তর পর্যায় সম্পন্ন হয়েছে অর্ধ-গম্বুজ স্কুইঞ্চ (squinchs) দ্বারা।
সংযোজিত ছোট মিনারগুলির ভিত্তি দৃষ্টিনন্দন কলস নকশায় শোভিত। কোণের বুরুজগুলিতে নিয়মিত বিরতিতে রয়েছে আলঙ্কারিক ব্যান্ড এবং প্যারাপেটে রয়েছে বদ্ধ মারলোন নকশা। মিহরাব ও খিলানপথ বাদ দিয়ে সমস্ত মসজিদের প্লাস্টার করা দেওয়ালে খিলান খোপ নকশার মাধ্যমে চমৎকারভাবে বৈচিত্র্য আনা হয়েছে। মিহরাব খিলানটি ক্রমশ সরু হয়ে যাওয়া দেওয়াল সন্নিহিত স্তম্ভ (pilaster) থেকে অসাধারণভাবে উত্থিত। মিহরাব খিলানের খিলান গর্ভ (soffits) বর্শা ফলক নকশায় সজ্জিত এবং এদের স্প্যান্ড্রিলে ফুলেল নকশায় স্টাকো (stucco) করা। কেন্দ্রীয় গম্বুজের অভ্যন্তরীণ ভিত্তিতে কোণা বের হওয়া ইটের অভিক্ষেপ ফ্রিজ রয়েছে যার উপরে প্যাঁচানো দড়ি নকশা করা।
গম্বুজ কেন্দ্র বিশাল মেডালিয়নের মাঝ বরাবর স্তরীকৃত রোজেট নকশা দ্বারা শোভিত। মসজিদের বাইরের দিকে পাথুরে ভিত (plinth) এবং মিম্বারের সর্বোচ্চ ধাপটি সারিবদ্ধভাবে ফুলেল নকশা ও অগভীর বদ্ধ ক্রেসটিং নকশায় অলংকৃত।
সমাধিসৌধ মসজিদের উত্তরপূর্ব কোণে অবস্থিত। এটি একটি বর্গাকার কক্ষ ও কক্ষের দক্ষিণ পার্শ্বে একটি বারান্দা নিয়ে গঠিত। বাইরের চারকোণে স্থাপিত অষ্টভুজাকৃতির বুরুজের মাধ্যমে দৃঢ়ীকৃত সমাধিসৌধের বর্গাকার কক্ষটিতে চারটি অক্ষীয় দরজা আছে। দক্ষিণের প্রবেশদ্বার ব্যতীত সবগুলি প্রবেশদ্বারই উভয় পার্শ্বস্থ খাতকাটা ছোট মিনারসহ (fluted minarets) অভিক্ষিপ্ত ফ্রন্টনের মধ্যে স্থাপিত। কোণের বুরুজগুলি প্যারাপেট ছাড়িয়ে উপরে উঠে গেছে এবং এদের শীর্ষ যথারীতি মুগল রীতির ছত্রী (kiosks) এবং কলস ফিনিয়াল শোভিত।
বর্গাকার সমাধি কক্ষটি, যার কেন্দ্রে রয়েছে মেকি কবর (cenotaph), একটি গম্বুজ দ্বারা আচ্ছাদিত। গম্বুজটি একটি অষ্টভুজাকার ড্রামের উপর স্থাপিত। চারদিকের দেওয়ালের উপর ন্যস্ত চারটি বদ্ধ খিলান এবং উপরের চার কোণের স্কুইঞ্চ-এর উপর স্থাপিত গম্বুজটি বিকশিত দৃষ্টিনন্দন পদ্ম এবং কলস চূড়া দ্বারা সুশোভিত। অষ্টভুজাকার বুরুজসহ ইমারতটির বাইরের দিক নিখুঁতভাবে প্যানেল নকশায় অলংকৃত। আর অনুভূমিক প্যারাপেট সারিবদ্ধ মেরলোন নকশায় সমৃদ্ধ। প্রধান সমাধি কক্ষের দক্ষিণ দিকের বারান্দাটি সুন্দর দোচালা কুঁড়ে ঘর আকৃতির ছাউনি দ্বারা আচ্ছাদিত। আদিতে এর দক্ষিণ দিকে তিনটি খিলানপথ এবং পশ্চিম ও পূর্ব দিকে একটি করে খিলানপথ ছিল। বর্তমানে বারান্দার দক্ষিণ দিকে একটি প্রশস্ত প্রবেশপথ রয়েছে। বারান্দার খিলানগুলি খাঁজকাটা এবং ক্রমশ সরু হয়ে যাওয়া দেওয়াল সন্নিহিত স্তম্ভ থেকে উত্থিত।
খাজা শাহবাজ কমপ্লেক্সের ভবন দুটির মধ্যে মসজিদটি দুটি অসাধারণ বৈশিষ্ট্যের কারণে বিশেষভাবে চিহ্নিত: একটি হলো আড়াআড়িভাবে স্থাপিত খিলানগুলির ভার বহনকারী দেওয়াল সন্নিহিত জোড়া-স্তম্ভ (ঃরিহ-ঢ়রষধংঃবৎ) এবং অন্যটি মিহরাব খিলানের দৃষ্টিনন্দন বর্শা ফলক মোটিফ। প্রথমোক্তটি নিশ্চিতভাবে উত্তর ভারতের মুগল রীতি থেকে উদ্ভূত, যেমনটি দেখা যায় শাহজাহানের আগ্রা দুর্গের দীউয়ান-ই-আম (১৬২৭ খ্রি.) ভবনে। বর্শাফলক মোটিফটিও সম্ভবত উত্তর ভারত থেকে আগত স্টাইল, কেননা রীতিটি সেখানকার সালতানাত সৌধগুলিতে প্রায়শই লক্ষ করা যায়। [এম.এ বারি]