মানসিক হাসপাতাল
মানসিক হাসপাতাল মানসিকভাবে প্রতিবন্ধী, অসুস্থ অথবা আহতকে ঔষধ ও শল্যচিকিৎসা এবং যথাযথ সেবাশুশ্রূষা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পৃথিবীর অন্যান্য উন্নত এবং অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় ততটা উন্নত নয়। প্রায় ১৩ কোটি লোকের জন্য আছে একমাত্র পাবনা মানসিক হাসপাতাল। ১৯৫৭ সালে তৎকালীন পাবনা জেলার সিভিল সার্জন একটি জমিদার বাড়িতে এটি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৫৯ সালে জেলা শহর থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার দূরে হেমায়েতপুরে ১১২.২৫ একরের একটি চত্বরে হাসপাতালটি স্থানান্তরিত হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে শয্যা সংখ্যা ছিল ৬০, যা পরবর্তীকালে বৃদ্ধি পেয়ে ২০০-তে দাঁড়ায়। পরে ১৯৬৬ সালে আরও ২০০ শয্যা যুক্ত হয়। মোট শয্যার ২৮০টি নন-পেয়িং এবং ১২০টি পেয়িং। হাসপাতালটির মোট ১৮টি ওয়ার্ডের মধ্যে পুরুষ রোগীদের জন্য ১৩টি (১১টি নন-পেয়িং, ২টি পেয়িং) এবং মহিলা রোগীদের জন্য ৫টি (৪টি নন-পেয়িং, ১টি পেয়িং) নির্দিষ্ট। সম্প্রতি আরও ১০০ শয্যা সংযোজনের কাজ চলছে।
পরিচালক প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে হাসপাতাল পরিচালনা করেন। হাসপাতালের ৩৬৫টি অনুমোদিত পদের মধ্যে আছেন মনোরোগবিদ্যা বিশেষজ্ঞ, চিকিৎসক, নিদানিক মনস্তত্ত্ববিদ, প্রাণরসায়নবিদ, মনোরোগ অভিজ্ঞ সমাজকর্মী ইত্যাদি। এছাড়া অন্যান্য পদে সহকারী হিসেবে আছেন সেবিকা, ঔষধ প্রস্ত্ততকারক (ফার্মাসিস্ট), রেডিওগ্রাফার, প্রশাসনিক সহকারী ইত্যাদি।
এ হাসপাতাল সারাদেশ থেকে আগত রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেয়। বহির্বিভাগীয় ও অভ্যন্তরীণ বিভাগীয় রোগীদের জন্য রয়েছে পৃথক বিভাগ। হাসপাতালে রোগী ভর্তির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয় বহির্বিভাগ। সাধারণত ১৮ বছরের নিচে এবং ৬০ বছরের অধিক বয়সী রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় না। এছাড়া মানসিক প্রতিবন্ধী ও মৃগীরোগীকেও ভর্তি করা হয় না। মাদকাসক্তদের শুধু পেয়িং বেড-এ ভর্তি করা হয়। যেসব রোগীকে হাসাপাতালে ভর্তি করা হয় না তাদের বিনামূল্যে উপদেশ ও ঔষধ দেওয়া হয়। এসব রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত প্রতি ১৫ দিন অন্তর বহির্বিভাগে আসতে বলা হয়। ঔষধের মাধ্যমে চিকিৎসা এক্ষেত্রে প্রধান কৌশল হলেও রোগীরা দলগত চিকিৎসা এবং পেশাগত চিকিৎসাও পায়। বাহিরে ও ঘরে খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কার্যক্রম ইত্যাদির ব্যবস্থাও হাসপাতালে রয়েছে। কর্তব্যরত চিকিৎসক প্রতিদিনই অভ্যন্তরীণ বিভাগের রোগীদের চিকিৎসার ব্যাপারে খোঁজখবর নেন। রোগীদের জন্য নিয়মিত পরীক্ষার সুযোগ সুবিধা, যেমন এক্সরে, প্যাথোলজি, রোগবিদ্যা ল্যাবরেটরি, ইসিজি, ইইজি ইত্যাদির ব্যবস্থাও হাসপাতালে রয়েছে। হাসপাতালের অধিকাংশই সিজোফ্রেনিক (schizophrenic) রোগী। ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৮ সালের মধ্যে বহির্বিভাগে প্রায় ৯০,০০০ এবং অভ্যন্তরীণ বিভাগে প্রায় ২,৮০০ জন রোগী চিকিৎসা লাভ করেছে। মানসিক রোগীদের জন্য বাংলাদেশে কোন পুনর্বাসন কেন্দ্র নেই। পাবনা মানসিক হাসপাতালে সরকার অনুমোদিত একটি জনকল্যাণ সংস্থা রয়েছে। রোগীরা সুস্থ হওয়ার পর তাদের নিজ বাড়িতে পৌঁছানোর খরচ এই সংস্থা বহন করে। জীবনরক্ষাকারী ঔষধপত্রও এই সংস্থা সরবরাহ করে থাকে। এছাড়াও হাসপাতালে থাকা অবস্থায় সক্ষম রোগীদের চাকুরি বা কাজের ব্যবস্থাও এই সংস্থাটিই করে।
বাংলাদেশ সরকারের সমাজকল্যাণ অধিদপ্তর থেকে এই সংস্থা বাৎসরিক অনুদান পায়। এছাড়া এটি দুগ্ধখামার, কৃষিখামারসহ কয়েকটি প্রকল্পও পরিচালনা করে। এসব কার্যক্রম থেকে অর্জিত অর্থ রোগীদের কল্যাণে ব্যবহূত হয়। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা এবং ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান থেকেও সংস্থাটি অনুদান পায়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পরিচালিত বিশ্বের মানসিক রোগীদের এক হিসাব অনুসারে ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশের প্রায় ১৩ কোটি লোকের মধ্যে ১২ লক্ষ মারাত্মক এবং প্রায় ১ কোটি ২০ লক্ষ আংশিক মানসিক রোগী ছিল। সম্প্রতি ঢাকায় জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং ২০০০ সাল থেকে এটি কার্যক্রম শুরু করেছে। সব সরকারি চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় হাসপাতাল, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (CMH) এবং অল্পসংখ্যক বেসরকারি ক্লিনিকে মনোরোগবিদ্যা বিভাগ রয়েছে। নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল এবং কয়েকটি বেসরকারি ক্লিনিকেও মানসিক রোগীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে। বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ১৯৯৯ সালে সিলেটে বহির্বিভাগীয় সুবিধাদিসহ ৫০ শয্যাবিশিষ্ট মানসিক স্বাস্থ্য হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাসহ শয্যা সংখ্যা ১০০ করার পরিকল্পনা রয়েছে। নামমাত্র খরচে বহির্বিভাগীয় রোগীদের চিকিৎসা কার্যক্রম এখানে শুরু হয়ে গেছে।
বাংলাদেশে প্রতি দুই লক্ষ রোগীর জন্য হাসপাতালে মাত্র একটি শয্যার ব্যবস্থা রয়েছে, যা প্রতিবেশী দেশসমূহসহ পৃথিবীর যে কোন উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় অত্যন্ত কম। মানসিক রোগীদের চিকিৎসার বর্তমান দৈন্যদশা বিবেচনা করে সরকার নবপ্রতিষ্ঠিত সকল চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় হাসপাতালে মানসিক রোগীর জন্য পৃথক বিভাগ গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। [রোকেয়া বেগম]
আরও দেখুন মানসিক ব্যাধি।