মন্ত্র
মন্ত্র হিন্দু ও বৌদ্ধধর্মীয় অনুষ্ঠানে ব্যবহূত আবৃত্তিমূলক শব্দাবলি। দক্ষিণ এশিয়ায় ধর্মচর্চার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হিসেবে বৈদিক যুগ (খ্রি.পূ ২৫০০-৯৫০) থেকেই মন্ত্র প্রচলিত। এ সংস্কৃত শব্দটির মূল অর্থ চিন্তার বাহন। প্রথম দিকে এর দ্বারা বৈদিক স্ত্ততিগানের যেকোনো অংশকে বোঝাত। খ্রিস্টীয় ১ম শতাব্দী থেকে প্রচলিত তান্ত্রিকবাদের মন্ত্রে আংশিকভাবে বৈদিক স্ত্ততিগানের প্রতিফলন ঘটে এবং এটি তান্ত্রিকদের রীতিনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। এ কারণে হিন্দুতন্ত্র ও বৌদ্ধতন্ত্রে মন্ত্রকে বলা হয় যথাক্রমে মন্ত্রশাস্ত্র বা মন্ত্রবিজ্ঞান এবং মন্ত্রযান বা মন্ত্রপথ। এছাড়া ভিন্ন ধরনের আরও কিছু ধর্মীয় ভাষা আছে যেগুলি মন্ত্র থেকে আলাদা, যেমন বৌদ্ধ ধরণী বা বিদ্যা। তবে এগুলি অনেক সময় একই অর্থে ব্যবহূত হয়।
প্রাচীনকালে ভারতীয়দের মধ্যে এমন একটি বিশ্বাস প্রচলিত ছিল যে, শব্দের একটি পবিত্র শক্তি আছে এবং এর দ্বারা অনেক কিছু করা বা হওয়া সম্ভব। এ বিশ্বাস থেকেই মন্ত্রপ্রথা চলে আসছে। শব্দের শক্তি সম্পর্কে ভর্তৃহরির বাক্যপদীয় গ্রন্থে (৫ম শতক) উল্লেখ আছে। পূজা এবং আরাধনা উভয় ক্ষেত্রেই মন্ত্রের ব্যবহার আছে। জাদুবিদ্যায়ও এর ব্যবহার আছে। জাদুর মাধ্যমে যেকোনো অলৌকিক ঘটনা ঘটানো, যেমন বৃষ্টি নামানো, নরনারীর পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি করা ইত্যাদি ক্ষেত্রেও মন্ত্রের ব্যবহার হয়। তান্ত্রিক মতে গুরুর নিকট থেকে মন্ত্র নিতে হয়, তা না হলে এর শক্তি হ্রাস পায়। এ মন্ত্র জপের মাধ্যমে এমনিতেই ব্যবহার করা যায় বা অন্যান্য আচারবিধি যেমন মুদ্রা, মন্ডলএবং হোমের সঙ্গেও ব্যবহার করা যায়।
কাঙ্ক্ষিত ফল পেতে হলে মন্ত্র শুদ্ধভাবে উচ্চারণ করতে হয়। মন্ত্রের প্রারম্ভে এবং শেষে নিয়ম মাফিক কিছু শব্দ ব্যবহার করতে হয়, যার মধ্যে অপরিহার্য একটি শব্দ হচ্ছে ‘ওম্’। এছাড়া তান্ত্রিক মন্ত্রে কতিপয় অর্থহীন ধ্বনিও ব্যবহূত হয় যেগুলি ‘বীজ’ বা ‘বীজমন্ত্র’ নামে পরিচিত। এসব কারণে বৈদিক ঋষি কৌৎস এবং বৌদ্ধ দার্শনিক বসুবন্ধু (৪র্থ শতক) মন্ত্রকে অর্থহীন মনে করেন। তবে মন্ত্রে অনেক শৈলীগত কৌশল আছে যা বিভিন্ন সভ্যতার কবিতা ও ধর্মের ভাষায়, জাদুতে এবং স্তব-স্ত্ততিতে দেখা যায়। আর ‘বীজ’ সদৃশ আবৃত্তিমূলক অর্থহীন জাদুশব্দ পৃথিবীর সর্বত্রই দেখা যায়। [রবার্ট এ. ইয়েলে]
আরও দেখুন লোকসাহিত্য।