মজুমদার, হেমেন্দ্রনাথ
মজুমদার, হেমেন্দ্রনাথ (১৮৯৪-১৯৪৮) চিত্রশিল্পী। পাশ্চাত্য রীতির ছবি এঁকে তিনি খ্যাত হন। ১৮৯৪ সালে কিশোরগঞ্জ জেলার গচিহাটা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা দুর্গানাথ মজুমদার ময়মনসিংহের আঠারবাড়ি এস্টেটের কর্মচারী ছিলেন। ছেলেবেলা থেকে ছবি আকাঁর ঝোঁক ছিল হেমেন্দ্রনাথের। ময়মনসিংহের সিটি স্কুলে দশম শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে তিনি বাড়ি থেকে পালিয়ে কলকাতায় উপস্থিত হন এবং সেখানকার সরকারি আর্ট স্কুলে ভর্তি হন।
অচিরেই সেখানের বাঁধা-ধরা নিয়ম-কানুনে তিনি হাঁপিয়ে ওঠেন। ১৯১১ সালে ইংল্যান্ডের পঞ্চম জর্জের আগমন উপলক্ষ্যে তোরণ সজ্জার ব্যাপারে তাঁর আপত্তি থাকায় তিনি উপরোক্ত আর্টস্কুল ত্যাগ করেন। সরকারি আর্টস্কুল ত্যাগ করলেও তিনি ছবি অাঁকা পরিত্যাগ করেননি। এর পর তিনি পুনরায় কলকাতার জুবিলী আর্ট স্কুলে ভর্তি হন। সেখানে তিনি প্রায় চার বছর ব্যাপী চিত্র অংকনে শিক্ষা গ্রহণ করেন।
এরপর তিনি আগ্রহভরে ভারতের বিভিন্ন চিত্র প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করে ভূয়সী প্রসংশা অর্জন করেন এবং পুরস্কৃত হন। ১৯২১ সালে বোম্বে আর্ট একজিবিশনে তাঁর অংকিত ‘স্মৃতি’ নামক চিত্রটি প্রথম পুরস্কারস্বরূপ স্বর্ণপদক অর্জন করে। সে বছরই তাঁর অপর একটি চিত্র ‘পল্লীপ্রাণ’ কলকাতার সোসাইটি অব ফাইন আর্টস-এর প্রথম প্রদর্শনীতে পুরস্কৃত হয়। এরপর ১৯২২ ও ১৯২৩ সালে যথাক্রমে ‘ঝঙ্কার’ ও ‘কর্দমে কমল’ চিত্র দুটি মাদ্রাজ ও বোম্বাই (মুম্বাই) প্রদর্শনীতে পুরস্কৃত হলে শিল্পি হিসেবে হেমেন্দ্রনাথের খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
এ সময় বাংলার বিভিন্ন মাসিক পত্রিকা ও সাময়িকীতে তাঁর চিত্র প্রকাশিত হতে থাকে এবং সুধী ও বোদ্ধামহলে তিনি জনপ্রিয় শিল্পি হিসেবে স্বীকৃতি পান। সে সময় এদেশের বহু বিখ্যাত ব্যক্তি তাঁর চিত্র ক্রয় করেন, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন ময়ূরভঞ্জের মহারাজা পূর্ণচন্দ্র ভঞ্জদেও, স্যার রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, ব্যরিস্টার এস.আর দাশ প্রমুখ।
পাশ্চাত্য রীতিতে ছবি এঁকে শিল্পি হেমেন্দ্রনাথ এত খ্যাতি অর্জন করেছিলেন যে তাঁকে সে সময়ে ভারতের রাজা মহারাজারা তাঁদের দরবারে ছবি অাঁকার জন্য আমন্ত্রণ জানাতেন। ১৯৩১ সালে শিল্পি হেমেন্দ্রনাথকে কাশ্মীরের মহারাজা তাঁর দরবারে আমন্ত্রণ জানান। এর পর পাতিয়ালার মহারাজার সভায় তিনি মাসিক দুহাজার টাকা বেতনে শিল্পি হিসেবে পাঁচ বছরের জন্য নিয়োজিত হন।
সেখানে তিনি পাতিয়ালার মহারাজার জন্য তিনটি চিত্রের সমাহারে একটি নয়নাভিরাম ‘পার্টিসন স্ক্রীন’ (Partition Screen) তৈরি করেন যা তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ শিল্পকৃতি হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। বর্তমানে এই স্ক্রীনটি পাতিয়ালার মহারাজার চিত্রালয়ে সংরক্ষিত আছে।
পাঁচ বছর পাতিয়ালার রাজ দরবারে অবস্থানের পর হেমেন্দ্রনাথ নিজের এলাকায় প্রত্যাবর্তন করেন। পাতিয়ালায় অবস্থানের সময় তিনি জয়পুর, যোধপুর ও বিকানীরের রাজাদের বহু ফরমায়েসী চিত্র অংকন করেন। চিত্রশিল্পি হিসেবে খ্যাতি অর্জনের পূর্ব থেকেই হেমেন্দ্রনাথ চিত্র অংকন এবং চিত্রশিল্প সম্পর্কে আলোচনায় বিরাট ভূমিকা রাখেন। কলকাতার ২৪নং বিডন স্ট্রীটের বাসভবনে ১৯১৯ সালে তিনি ‘ইন্ডিয়ান একাডেমী অব আর্ট’ নামে একটি চারুকলা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। শিল্পি ভবানীচরণ লাহা, যোগেশচন্দ্রশীল, যামিনী রায়, অতুল বসু প্রমুখ কতিপয় তরুণ শিল্পি এই প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত হন।
১৯২০ সালের জানুয়ারিতে উপর্যুক্ত প্রতিষ্ঠানের ত্রৈমাসিক মুখপত্র The Indian Academy of Art প্রকাশিত হয়। রঙিন ছবি সম্বলিত ও পরিচ্ছন্ন মুদ্রণে এত সুন্দর সাময়িকী সম্ভবত এ দেশে ইতঃপূর্বে প্রকাশিত হয়নি। এই সংস্থা থেকে ‘শিল্পি’ নামক অপর একটি আর্ট জার্নাল প্রকাশিত হয়। এরপর হেমেন্দ্রনাথ ‘The Indian Masters’ নামক চিত্রসংগ্রহের একটি এ্যালবাম তৈরির কাজে হাত দেন, যাতে তিনি তাঁর সমকালীন ভারতের প্রায় সকল খ্যাতিমান শিল্পির উল্লেখযোগ্য চিত্রের নমুনা সংগ্রহ করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য অপর একটি কাজ হলো চিত্রশিল্প ও চিত্রশিক্ষা বিষয়ে 'ছবির চশমা নামক অসমাপ্ত কিন্তু দুর্লভ একটি পান্ডুলিপি তৈরি। কলকাতার আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড উজ্জ্বলকুমার মজুমদারের সম্পাদনায় শিল্পির মৃত্যুর বহুবছর পর সম্প্রতি (১৯৯১) এই পান্ডুলিপিটি প্রকাশ করেছে।
উনিশ শতকের শেষ পাদে ও বিশ শতকের প্রথমদিকে পাশ্চাত্য রীতিতে ছবি এঁকে যারা খ্যাতি অর্জন করেন তাঁদের মধ্যে হেমেন্দ্রনাথ মজুমদার অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। কলকাতার জুবিলী আর্ট স্কুলের চিত্রশিক্ষক শিল্পি রণদাগুপ্ত ছিলেন তাঁর শিক্ষাগুরু। এই গুরুর হাত ধরেই তিনি তেল, জল, প্যাস্টেল ও চারকোলের মাধ্যমে ইউরোপীয় অ্যাকাডেমিক রীতির চিত্ররচনায় দক্ষ হয়ে ওঠেন। তেল রঙ-এ চিত্রিত ‘সাবজেক্ট পেইনটিং’-এ তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী চিত্রকর। বিষয় নির্বাচন, রঙের মাধুর্য ও সূক্ষ্ম পেলব রেখার প্রয়োগে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে তাঁর শিল্পকৃতি মোহনীয় রূপলাভ করে।
১৯৪৭ এর অব্যবহিত পর ‘All Indian Art Exhibitions’ এ হেমেন্দ্রনাথের কয়েকটি নতুন ধরনের নয়নাভিরাম তৈলচিত্র প্রদর্শিত হয়। এগুলির বিষয় ছিল আবহমান বাংলার গ্রামীণ জীবনের দৈনন্দিন চিত্র যেমন-‘ফসল কাটা’, ‘মাছ ধরা’ ইত্যাদি। জল রঙের ছোট ছোট স্কেচ থেকে বৃহদাকারে উপরোক্ত তৈলচিত্রগুলি অংকন করতে তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। এর ফলে হেমেন্দ্রনাথের স্বাস্থ্য ভেঙ্গে যায় এবং ১৯৪৮ সালের ২২ জুলাই তাঁর মৃত্যু হয়। [নাজমা খান মজলিস]