ভূ-পৃষ্ঠ জলরাশি
ভূ-পৃষ্ঠ জলরাশি (Surface water) নদনদী, ঝর্ণাধারা, হ্রদ, খাল-বিল ও পুকুরের পানি। অন্যভাবে বলতে গেলে স্বাদু ও লবণাক্ত পানি, তুষার বরফসহ ভূ-পৃষ্ঠের উপরিভাগে প্রাপ্ত সকল জল। বাংলাদেশে ভূ-পৃষ্ঠ জলরাশির মূল উৎস বৃষ্টিপাত ও আন্তঃদেশীয় নদীপ্রবাহ। বাংলাদেশে গড় বার্ষিক ভূ-পৃষ্ঠস্থ প্রবাহের পরিমাণ প্রায় ১০৭.৩ কোটি একর ফুট, যার মধ্যে প্রায় ৮৭ কোটি একর ফুট (৮১.০৮%) স্রোত আকারে ভারত থেকে আসে এবং অবশিষ্ট ২০.৩ কোটি একর ফুট (১৮.৯২%) বৃষ্টিপাত আকারে পাওয়া যায়। এ পরিমাণ পানি সমগ্র দেশকে ৯.১৪ মিটার গভীরতায় প্লাবিত করার জন্য যথেষ্ট। মোট ভূ-পৃষ্ঠস্থ প্রবাহের মধ্যে প্রায় ১৩.২ কোটি একর ফুট (বৃষ্টিপাতের ৬৫% এবং সামগ্রিকভাবে ১২.৩%) বাষ্পীভূত (১১৪.৩০ সেমি) হয় এবং অবশিষ্টাংশ নদনদী দ্বারা সমুদ্রে পতিত হয়।
নদনদীর পানি বাংলাদেশের ভূভাগে জালের মতো ছড়িয়ে রয়েছে প্রায় ৭০০ নদনদী ও তাদের শাখা-প্রশাখা, যাদের মোট দৈর্ঘ্য ২৪,০০০ কিমি। এদের মধ্যে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রসহ ৫৪টি নদনদীর উৎপত্তিস্থল ভারতে এবং ৩টির মায়ানমারে। এই ৫৭টি নদনদীর প্রায় ৯৩% উজান অঞ্চল বাংলাদেশের বাইরে এবং মাত্র ৭% বাংলাদেশে। উজানের দেশ কর্তৃক উজানস্রোতে বাঁধ নির্মাণের ফলে শুষ্ক মৌসুমে যখন সেচের প্রয়োজন দেখা দেয় তখন এসব নদ-নদীর বাংলাদেশ অংশে প্রবাহমাত্রা হয় সর্বনিম্ন থাকে না, হয় একেবারে শুকিয়ে যায়।
সমগ্র পৃথিবীর সাগরসমূহের জল যোগানদাতা হিসেবে বাংলাদেশের নদীমালার অবস্থান তৃতীয় স্থানে। কেবল ব্রাজিলের আমাজান এবং আফ্রিকার কঙ্গো নদীই বাংলাদেশের গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা নদীপ্রণালীর চেয়ে বেশি জল সরবরাহ করে থাকে। ব্রহ্মপুত্র (যমুনা) ও গঙ্গা নদীর সঙ্গমস্থলের ঠিক ভাটিতে বারুরিয়া নামক স্থানে এই নদী দুটির সম্মিলিত জলপ্রবাহের পরিমাণ বৎসরে ৭৯,৫০০ কোটি ঘনমিটার। এই পরিমাণ পানিকে সমগ্র বাংলাদেশের আয়তনের সমান ভূমিতে আবদ্ধ করলে তা ৫.৫২ মিটার গভীরতা সৃষ্টি করবে।
বাংলাদেশের ভূ-পৃষ্ঠস্থ জলসম্পদকে মাসিক নদীপ্রবাহ, শুষ্ক মৌসুমের স্থৈতিক পানি (static water) এবং নদীস্থ সঞ্চায়ক ক্ষমতা (storage potential) এই সব অভিধায় প্রকাশ করা যায়। দেশের নদীপ্রবাহের সবটাই গিয়ে পতিত হয় বঙ্গোপসাগরে। এর পরিমাণ ১৯৯০ সালের হিসাব অনুযায়ী আগস্ট মাসে প্রতি সেকেন্ডে ১,৭৪,০০০ ঘনমিটার এবং মার্চ মাসে ৫৬৩ ঘনমিটার। দেশে মোট প্রাপ্ত নদীপ্রবাহের প্রায় ৯০ শতাংশ আসে ভারত থেকে। শুষ্ক মৌসুমের (জানুয়ারি-এপ্রিল) প্রায় ৮৫ শতাংশ প্রবাহ আসে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা নদীপ্রণালীর মাধ্যমে। এদেশের প্রধান প্রধান নদীগুলো ছাড়া স্বতন্ত্র পরিবাহ ক্ষেত্র (catchment area) বিশিষ্ট নদী অত্যন্ত সীমিত। অবশ্য দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে কর্ণফুলি নদীর বৃদ্ধিপ্রাপ্ত প্রবাহ এবং মধ্য-দক্ষিণ অঞ্চলে বরিশাল পটুয়াখালী এলাকায় নদীপ্রবাহ এর ব্যতিক্রম।
শুষ্ক মৌসুমে দেশের নদীগুলোর মোট সঞ্চায়ক ক্ষমতা আনুমানিক প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৬৫ ঘনমিটার। এই হিসাব ১০০ মিটারের কম বা সমান প্রস্থবিশিষ্ট নদীর ১ মিটার গভীরে পানি নিষ্কাশনের ভিত্তিতে নিরূপণ করা হয়েছে। উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে গড় মাসিক নদী নিঃসরণ মার্চ মাসে প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৪১৭ ঘনমিটার এবং আগস্ট মাসে প্রায় ৭,৯৭০ ঘনমিটার। সবচেয়ে খরা মাসে (মার্চ) ভারত থেকে এই অঞ্চলে গড় মাসিক আগত প্রবাহের পরিমাণ প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৪০.৬ কোটি ঘনমিটার। এ সময় প্রবাহ যোগানদাতা নদীসমূহ হচ্ছে তিস্তা (৩৭%), দুধকুমার (৩০%), ধরলা (১৯%) ও মহানন্দা (১৯%)। প্রাপ্ত স্থৈতিক জলের পরিমাণ প্রায় ১৬.৭ কোটি ঘনমিটার এবং নদীস্থ সঞ্চায়ক ক্ষমতা প্রায় ১০.৩ কোটি ঘনমিটার।
উত্তর-পূর্বাঞ্চলে গড় মাসিক নদীপ্রবাহ ফেব্রুয়ারি মাসে সেকেন্ড প্রতি প্রায় ১০০ ঘনমিটার থেকে জুলাই মাসে প্রায় ১৮,৭০০ ঘনমিটারে উঠানামা করে। ফেব্রুয়ারি মাসে ভারত থেকে ঐ অঞ্চলে আগত গড় মাসিক প্রবাহের পরিমাণ প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ২২৩ ঘনমিটার। এছাড়া ঐ অঞ্চলে ফেব্রুয়ারি মাসে ব্রহ্মপুত্র নদী থেকে প্রবাহ আসে সেকেন্ড প্রতি প্রায় ৮০ ঘনমিটার। ফেব্রুয়ারি মাসে পানির অন্তঃপ্রবাহ নিষ্ক্রমণের চেয়ে প্রবাহ সেকেন্ড প্রতি প্রায় ২০৩ ঘনমিটার বেশি। ফেব্রুয়ারি মাসে নদীপ্রবাহের প্রধান প্রধান উৎসগুলো হচ্ছে: মনু-কুশিয়ারা নদী (৭৫%), সুরমা নদী (২৫%), ধলেশ্বরী নদী (১৭%) ও পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ (১৭%)। প্রাপ্ত স্থৈতিক পানির পরিমাণ প্রায় ৩৭.৪ কোটি ঘনমিটার এবং আন্তঃনদী সঞ্চায়ক ক্ষমতা আনুমানিক ২৭.৫ কোটি ঘনমিটার।
দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে প্রাপ্ত গড় মাসিক প্রবাহ মার্চ মাসে সেকেন্ড প্রতি ৩৭৭ ঘনমিটার থেকে জুলাই মাসে ৪,৮৭০ ঘনমিটারের মধ্যে উঠানামা করে। সবচেয়ে শুষ্ক মাসে (মার্চ) মোট প্রবাহের প্রায় ৮৯% আসে কাপ্তাই জলাধার থেকে কর্ণফুলির মাধ্যমে। মার্চ মাসের প্রবাহের ক্ষেত্রে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ উৎসগুলো হচ্ছে গোমতি নদী (৩%), ফেনী নদী (৩%), সাঙ্গু নদী (৩%) ও মাতামুহুরী নদী (২%)।
দক্ষিণ-মধ্যাঞ্চলে গড় মাসিক নদীপ্রবাহ মার্চ মাসে সেকেন্ড প্রতি ১,১২০ ঘনমিটার থেকে আগস্ট মাসে ২১,৫০০ ঘনমিটারে উঠানামা করে। শুকনা মৌসুমের ৮০ শতাংশেরও বেশি প্রাপ্ত প্রবাহ নিম্ন মেঘনার আবুপুর, হিজলা ও রামদাসপুর খালপথ দিয়ে অঞ্চলটিতে প্রবেশ করে। সবচেয়ে খরার মাস মার্চে পানিপ্রবাহের গুরুত্বপূর্ণ সূত্রগুলো হলো: বিষখালি (৪১%), বুড়িশ্বর (২৮%) ও আড়িয়াল খাঁ (৫%)। প্রাপ্ত স্থৈতিক জলের পরিমাণ ৯০ লক্ষ ঘনমিটার ও আন্তঃনদী সঞ্চায়ক ক্ষমতা ৩৯ লক্ষ ঘনমিটার।
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে প্রাপ্ত গড় মাসিক নদীপ্রবাহ মার্চ মাসে সেকেন্ড প্রতি ১৯০ ঘনমিটার থেকে আগস্ট মাসে ৭,৬৫০ ঘনমিটারের মধ্যে উঠানামা করে। ভারত থেকে মাথাভাঙ্গা নদীর মাধ্যমে এপ্রিল মাসে সেকেন্ড প্রতি ১.৭ ঘনমিটার থেকে সেপ্টেম্বর মাসে ১২৪ ঘনমিটারের মধ্যে নদীপ্রবাহ উঠানামা করে। সবচেয়ে শুষ্ক মাস মার্চে মোট নদীপ্রবাহের প্রায় ৫৭% আসে গড়াই নদী থেকে, ২৭% গঙ্গা-কপোতাক্ষ থেকে এবং ১.৬% মাথাভাঙ্গা থেকে।
পুকুর ও বিলের পানি বাংলাদেশে ১,৪৭,০০০ হেক্টর জুড়ে প্রায় ১৩ লক্ষ পুকুর এবং ১০,০০০ হাওর, বাওড় ও বিল রয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে এদের অধিকাংশই শুকিয়ে যায়। এসব জলাশয়কে পরিকল্পিত খনন ও ব্যবহারের মাধ্যমে সেচের পানি এবং মৎস্য চাষের জন্য সম্ভাবনাময় ক্ষুদ্র জলাধারে পরিণত করা সম্ভব।
বন্যার পানি প্রতি বছর বাংলাদেশের ভূভাগের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বন্যাকবলিত হয় এবং ভয়াবহ বন্যার সময়গুলোতে দেশের প্রায় অর্ধেক তার বেশি অংশ প্লাবিত হয়। সাধারণত উত্তর-পশ্চিম, পশ্চিম ও পূর্ব অংশে অগভীর কিন্তু কেন্দ্রাঞ্চল ও উত্তর-পূর্বে গভীর মৌসুমি বন্যা দেখা দেয়। ভূ-পৃষ্ঠের বন্ধুরতার পার্থক্য ও মানব সৃষ্ট পরিবর্তনসমূহের জন্য এলাকা ভেদে বন্যার গভীরতায় পার্থক্য দেখা যায়।
যদিও বিপুল পরিমাণ ভূপৃষ্ঠ জলরাশি বাংলাদেশের উপর দিয়ে বয়ে যায়, তবুও এর সুফল ও উন্নয়নমূলক কাজে এর অপার সম্ভাবনা কিছু কিছু কারণে বিঘ্নিত হচ্ছে। বড় একটা কারণ হচ্ছে আভিকর্ষিক অপসারণের সুযোগ না থাকা এবং সেই সঙ্গে অতিরিক্ত পানি সঞ্চয়নের জন্য জলাধারের অভাব। বর্তমান অবস্থায় প্রধান প্রধান নদীগুলো থেকে বঙ্গোপসাগরে বার্ষিক জলপ্রবাহের পরিমাণ আবশ্যিকভাবে ভারত থেকে আগত প্রবাহের সমান। তবে শুষ্ক মাসে (মার্চ) পরিচালিত একটি জল ভারসাম্য জরিপ থেকে দেখা যায় যে, সেচকার্য ও নিম্নভূমি প্রবাহের কারণে তুলনামূলকভাবে বঙ্গোপসাগরে উচ্চ অপসারণের এই মাসেও অপসারণের পরিমাণ মোট আগত প্রবাহের মাত্র পাঁচ শতাংশের মতো। ভবিষ্যৎ উন্নয়ন পরিস্থিতিতে বড় বড় বাঁধ ছাড়াই অপসারণের পরিমাণ সম্ভবত ১৫ শতাংশ এবং বাঁধ নিয়ে ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। [মোঃ সাজ্জাদ হোসেন এবং হারুন-অর-রশিদ]