ইসলাম, জহুরুল
ইসলাম, জহুরুল (১৯২৮-১৯৯৫) ব্যবসায়ী, শিল্পোদ্যোক্তা, সমাজসেবী। ১৯২৮ সালের ১ আগষ্ট কিশোরগঞ্জ জেলার বাজিতপুর থানার অন্তর্গত ভাগলপুর গ্রামে তাঁর জন্ম। জহুরুল ইসলামের শৈশব কেটেছে ভাগলপুর গ্রামে। স্থানীয় স্কুলে ৫ম শ্রেণি পড়ার পর সরারচর শিবনাথ হাইস্কুল ও পরবর্তী সময়ে বাজিতপুর হাইস্কুলে পড়ালেখা করেন। চাচা মুর্শিদ উদ্দিন আহমেদ-এর সাথে কলকাতা যাওয়ার পর রিপন হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। উচ্চ শিক্ষা গ্রহণে প্রবল আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও দারিদ্র্যতার কারণে তিনি শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেননি। ১৯৪৮ সালে তিনি তৎকালীন সিএন্ডবি-তে স্বল্প বেতনে যোগদান করেন। জহুরুল ইসলাম সিএন্ডবিতে অনেক বাস্তব অভিজ্ঞতা লাভ করেন এবং সে অভিজ্ঞতাকে সম্বল করে তিনি বৃহত্তর কিছু করার জন্য জীবনযুদ্ধে অবতীর্ণ হন। শুরু করেন তিনি ক্ষুদ্র ঠিকাদারি ব্যবসা। অচিরেই তিনি ঠিকাদারি ব্যবসায় প্রসার লাভ করেন। প্রতিষ্ঠা করেন ‘বেঙ্গল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন’ যা তাঁর দক্ষ ব্যবস্থাপনায় বৃহৎ ও প্রসিদ্ধ প্রতিষ্ঠানে রূপ নেয়। তাঁর সময়ে সকল ব্যবসাবাণিজ্য, শিল্পকারখানা ছিল অবাঙালিদের একচেটিয়া দখলে। তাঁদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় যে কয়েকজন বাঙালি ব্যবসাক্ষেত্রে অবতীর্ণ হন, জহুরুল ইসলাম তাঁদের অন্যতম।
জহুরুল ইসলামের ব্যবসায়ী জীবনের প্রথম দিকের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা হল বাংলাদেশ ব্যাংক, পুরানো হাইকোর্ট ভবন, সুপ্রিম কোর্ট ভবন, গণভবন, ঢাকার নগর ভবন ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানের শপিং কমপ্লেক্স। অক্লান্ত পরিশ্রমী ও আত্মপ্রত্যয়ী এই ব্যক্তিত্ব স্বল্পতম সময়ে নির্মাণ সম্পন্ন করেন এমপি হোস্টেল, পুরানো সংসদ ভবন, খাদ্য গুদাম, বিভিন্ন সড়ক যা এদেশের নির্মাণ শিল্পে স্থাপন করেছে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।
পুঁজিবাদী ব্যবস্থার একটি বৈশিষ্ট্য এমন যে, একটি বিশেষ শিল্পে পুঁজি প্রয়োজনের অতিরিক্ত জমে গেলে তা নতুন শিল্পে বিনিয়োগ না করলে এর মুনাফা তুলনামূলকভাবে কমতে থাকে। তাঁর কোনো উচ্চ শিক্ষা না থাকলেও অর্থনীতির প্রচলিত ধারণা মোতাবেক তিনি তাঁর পুজির লাভজনক বিনিয়োগের জন্য নতুন নতুন ক্ষেত্র আবিস্কার করেন। যেমন তিনি অনুভব করেন যে, দ্রুত নগরায়ণের কারণে অচিরেই আবাসিক চাহিদা দেখা দেবে। এ চাহিদার প্রথম সুযোগ গ্রহণ করে তিনি স্থাপন করেন প্রথম পুঁজিবাদী গৃহায়ন শিল্প প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন হাউজিং। এমনিভাবে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ইস্টার্ন ব্যাংকিং কর্পোরেশন যা ছিল বেসরকারি ব্যাংকিং খাতের অগ্রদূত। কৃষি উৎপাদনে সেচের গুরুত্ব অনুভব করে তিনি সেচ ব্যবস্থার উন্নয়নে আধুনিক যন্ত্রপাতি উৎপাদনের জন্য প্রতিষ্ঠা করেন মিলনার্স পাম্প ইন্ডাস্ট্রি। এ শিল্পেও তিনি দেশের প্রথম উদ্যোক্তা। তাঁর শিল্পোদ্যোগের মধ্যে রয়েছে কয়েকটি জুটমিল, ঔষধ শিল্প, গাড়ি সংযোজন কারখানা ইত্যাদি।
১৯৭২-এর পর থেকে বাণিজ্য ও শিল্পোদ্যোগে জহুরুল ইসলামের কর্মযজ্ঞ আরো বিস্তৃতি লাভ করে। ১৯৭৫ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন বেঙ্গল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন (বিডিসি)। এ কর্পোরেশন বাংলাদেশের প্রথম প্রতিষ্ঠান যা মধ্যপ্রাচ্যে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নির্মাণ ব্যবসা শুরু করে। মধ্যপ্রাচ্যে এই প্রতিষ্ঠানের উল্লেখযোগ্য ব্যবসার মধ্যে রয়েছে নতুন প্রযুক্তিতে আবুধাবিতে ৫০০০ বাড়ি নির্মাণ, ইরাক ও ইয়েমেনে উপশহর নির্মাণ ইত্যাদি। এই সকল কাজের মাধ্যমে তিনি দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষের জন্য মধ্যপ্রাচ্যে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেন। বিদেশে জনশক্তি রপ্তানি ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন পথিকৃৎ। কৃষি, পোলট্রি, ফিশারিজ ইত্যাদি ক্ষেত্রেও তিনি উন্মোচন করেন নতুন দিগন্তের, তাঁর এই আইডিয়া থেকে আজ বাংলাদেশে এসব খাতে বিপুল পুঁজি বিনিয়োগ হচ্ছে।
জহুরুল ইসলাম অনুভব করতেন যে, দেশের সাধারণ মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে পুঁজিপতি শ্রেণির গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব রয়েছে। সে অনুভূতি থেকে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন অনেক স্কুল ও কলেজ। এছাড়া তিনি অনুদান দিয়েছেন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে। তিনি দরিদ্র মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের উচ্চ শিক্ষার জন্য নানা বৃত্তির ব্যবস্থা করেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন মাজেদুল ইসলাম ট্রাস্ট। শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর একটি বড় কীর্তি জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল। নিজ গ্রাম ভাগলপুরে প্রতিষ্ঠিত এই হাসপাতাল থেকে নিজের এলাকাসহ আশেপাশের বেশ কয়েকটি জেলার মানুষ অতি কম মূল্যে আধুনিক চিকিৎসা সেবা পাচ্ছে। জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ বর্তমানে দেশের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ বেসরকারি মেডিকেল কলেজ। জহুরুল ইসলাম ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে কিশোরগঞ্জে খুলেছিলেন দুই শত লঙ্গরখানা। এসব লঙ্গরখানায় সকল দরিদ্র অভুক্ত মানুষের জন্য ৫ মাস ব্যাপী খাদ্য নিশ্চিত করেছিলেন তিনি।
জহুরুল ইসলাম ছিলেন আত্মপ্রচার বিমুখ এবং সরলসোজা জীবনে বিশ্বাসী। তিনি কর্ম সংস্থান করেছেন লক্ষ লক্ষ মানুষের জন্য, কিন্তু এসবের জন্য তিনি কখনো আত্মপ্রচারে নামেননি। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন ধর্মভীরু। তিনি মসজিদ নির্মাণ করেছেন এবং অন্যদের মসজিদ নির্মাণে সাহায্য করেছেন। বহু আলেমকে নিজ খরচে হজ্বে পাঠিয়েছেন। ১৯৯৫ সালের ১৯শে অক্টোবর সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে নিজ গ্রাম ভাগলপুরে সমাহিত করা হয়। তিনি ছিলেন এক পুত্র ও চার কন্যার জনক। তাঁর একমাত্র পুত্র মঞ্জুরুল ইসলাম বর্তমানে ইসলাম গ্রুপের চেয়ারম্যান। [সৈয়দ মাহমুদুল আজিজ]