বিবেকানন্দ, স্বামী
বিবেকানন্দ, স্বামী (১৮৬৩-১৯০২) দার্শনিক, ধর্মিয়-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর পারিবারিক নাম ছিল নরেন্দ্রনাথ দত্ত। স্বামী বিবেকানন্দ এক অনন্য সাধারণ প্রতিভা—যিনি আধুনিক কালের ধর্ম-সংস্কৃতি এবং পরোক্ষভাবে ভারতীয়দের জাতীয় আত্মচেতনার রূপ দিতে সাহায্য করেছিলেন। উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত হিন্দুধর্মীয় জীবনব্যবস্থা, আচরণ ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অভ্যস্ত হওয়া সত্ত্বেও তিনি হিন্দুধর্মের বহু আদর্শিক বিচ্যুতির কড়া সমালোচক ছিলেন। তিনি একটি ভাবাদর্শ প্রচার এবং একটি সম্পূর্ণ নতুন কর্মসূচি প্রদান করেছিলেন। তাঁর সময়ের তুলনায় বহু দিক থেকে প্রাগ্রসর চিন্তার অধিকারী বিবেকানন্দের জাতীয় পুনর্জীবনের পথ ও পন্থা নিয়ে বহু ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ রয়েছে।
উত্তর কলকাতার শিমলা বা শিমুলিয়া গ্রামের বিখ্যাত দত্ত পরিবারে নরেন্দ্রনাথ দত্ত জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা বিশ্বনাথ দত্ত একজন ধনবান এবং সফল সরকারি উকিল ছিলেন। এ পরিবার উত্তরাধিকারসূত্রে ইন্দো-মুগল যুগের সামাজিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য লাভ করেছিল। জীবনের সকল ক্ষেত্রে বিবেকানন্দের উদার দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে তার আংশিক প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। দত্ত পরিবারে শুভ বা উত্তম জীবনধারণ, বিশেষ করে খাদ্যে একটা পরিচ্ছন্ন ও মার্জিত রুচির পরিবেশ রক্ষা করা হতো। ফলে সন্ন্যাস জীবনেও বিবেকানন্দ তাঁর উত্তম বা শুভ জীবনধারণের প্রতি ভালোবাসা পরিত্যাগ করেননি। ‘দুঃখ চাতামি’ বা নিম্ন জীবনধারণে আনন্দলাভ করা তাঁর নিকট সবসময় ঘৃণার বিষয় ছিল। তিনি নিজে মুগল ঐতিহ্যের একজন বিখ্যাত পাচক ছিলেন।
বিবেকানন্দের পরিবারে এমন একটি প্রচলিত বিশ্বাস ছিল যে, দেবতা শিবের আশীর্বাদ নিয়ে বিবেকানন্দের জন্ম, কারণ তাঁর মা শিবের নিকট একটি পুত্র সন্তান কামনা করেছিলেন। শৈশবকাল থেকেই তাঁর মধ্যে অপার্থিব ধ্যান-ধারণার লক্ষণ দেখা দিলে তাঁর মা বিশ্বাস করেন যে, তাঁর পুত্র স্বয়ং শিব অবতাররূপে জন্মগ্রহণ করেছেন। তিনি মাটির তৈরি প্রিয় দেবদেবীর মূর্তির সামনে বসে প্রার্থনা করতেন এবং কখনো কখনো সমাধিতে চলে যেতেন। প্রথমে তাঁর নাম রাখা হয়েছিল বীরেশ্বর ওরফে বিলে, কিন্তু পরবর্তীকালে এ নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় নরেন্দ্র।
প্রথমে নিজ গৃহে মায়ের নিকট এবং পরে একজন গৃহশিক্ষকের নিকট নরেন্দ্রর শিক্ষাজীবন শুরু হয়। কলকাতার মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশনে তাঁর স্কুল জীবন, প্রেসিডেন্সি কলেজ ও পরে জেনারেল অ্যাসেম্বলিতে (পরবর্তীকালে স্কটিশ চার্চ কলেজ) তাঁর কলেজ জীবন শুরু, এবং ১৮৮৩ সালে এখান থেকেই তিনি স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। কলেজ জীবন থেকেই তিনি এক তৃপ্তিহীন পার্থিব ও আধ্যাত্মিক জ্ঞান অন্বেষণে ব্রতী হন। তিনি ব্যাপক ও গভীরভাবে পড়াশুনা শুরু করেন। তাঁর বৌদ্ধিক বা একাডেমিক আগ্রহের মধ্যে ছিল দর্শন, ইতিহাস, সাহিত্য, বিজ্ঞান ইত্যাদি। একজন যুব-সত্যানুসন্ধানকারী হিসেবে ঈশ্বর জ্ঞানলাভের প্রতিও তাঁর গভীর আগ্রহ জন্মলাভ করে। তিনি রাজা রামমোহন রায়ের বেদান্তবিষয়ক গ্রন্থাদি পাঠ করে ব্রাহ্মসমাজের প্রতি আকৃষ্ট হন।কেশবচন্দ্র সেন এ আন্দোলনের একজন শক্তিশালী নেতা হিসেবে আবির্ভূত হলে নরেন্দ্র তাঁর বক্তৃতা শুনতেন এবং তাঁর সংগঠিত সভাসমিতিতে ভক্তিমূলক সংগীত পরিবেশন করতেন।
বাঙালি সমাজে খ্যাতনামা আধ্যাত্মিক পুরুষদের সঙ্গে দেখা করে তাঁদের জিজ্ঞাসা করতেন তাঁরা ‘ঈশ্বরকে দেখেছেন কিনা’। বলা হয়ে থাকে এরকম প্রশ্নের উত্তরে বিখ্যাত মরমি সাধক দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন তিনি অবশ্য ঈশ্বরকে দেখেননি, কিন্তু তাঁর বিশ্বাস নরেন্দ্র অবশ্যই ঈশ্বরকে দেখার সাধনায় সার্থক হবেন। জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইনস্টিটিউশনের অধ্যক্ষ রেভারেন্ড হেস্টি নরেন্দ্রকে রামকৃষ্ণ-এর কথা বলেন এবং তাঁকে আধ্যাত্মিক সাধনায় আবিষ্ট পুরুষ হিসেবে বর্ণনা করেন। নরেন্দ্র যথারীতি তাঁকে এ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলে তিনি উত্তরে বলেন, ‘হ্যাঁ, আমি তাঁকে দেখেছি এবং তোমাকেও দেখাতে পারি।’ নানা প্রকার বাস্তবধর্মী প্রশ্ন ও তর্ক-বিতর্কের পর অল্প সময়ের মধ্যে নরেন্দ্র প্রথমে রামকৃষ্ণের ভক্ত এবং অচিরেই তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।
নরেনের জীবনে এমন একটি সময় আসে যখন তিনি পার্থিব জীবন এবং সন্ন্যাস জীবনের যে কোনো একটি গ্রহণ করার বিষয়ে দ্বিধান্বিত ছিলেন। এ সময় তিনি আইন বিষয়ে পড়াশুনা করছিলেন, কিন্তু পিতার মৃত্যুর কারণে তিনি পড়াশুনা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। তাঁকে তাঁর পরিবারের ভরণপোষণের দায়ভার গ্রহণ করতে হয় এবং তিনি মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশনে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন।
নরেনের ভবিষ্যৎ জীবন সম্পর্কে তাঁর পিতার একটি পরিকল্পনা ছিল। তিনি ইংল্যান্ডে যাবেন এবং ব্যারিস্টার হয়ে দেশে ফিরে এসে আইন ব্যবসা শুরু করবেন। কিন্তু অধ্যাত্ম-জীবনের প্রতি আকর্ষণই তাঁর নিকট বড় হয়ে দেখা দেয় এবং তিনি শ্রীরামকৃষ্ণের শিষ্যত্ব গ্রহণের আশায় বাড়ি ত্যাগ করেন। শিষ্য কর্তৃক রচিত বিবেকানন্দের বহু জীবনী এবং স্মৃতিকথা রয়েছে। কিন্তু গুরুর নিকট থেকে তারা কী শিক্ষালাভ করেছেন—এ প্রশ্নের উত্তরে সকলেই নীরব থাকেন। মানবসেবা এবং বিশেষ করে পাশ্চাত্যে বেদান্ত ও যোগদর্শন প্রচারের জন্য যখন বিবেকানন্দ ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেন, তখন তিনি বলেন তিনি যা কিছু করছেন তা গুরুর নির্দেশেই করছেন। কিন্তু তাঁর কর্মসূচি ও গুরুর শিক্ষার মধ্যে সুনির্দিষ্ট সম্পর্কের বিষয়টি সুস্পষ্ট নয়। তাঁর গুরু অধিকাংশ সময় দেবীর ধ্যানে মগ্ন থাকতেন এবং তাঁকে দেবী মা-কালি হিসেবে ‘দেখেছিলেন’। তিনি আরও দাবি করেছিলেন যে, ইসলাম ও খ্রিস্টধর্মসহ সব প্রধান ধর্মের মরমি ভাবধারার মাধ্যমে তিনি ঈশ্বরকে উপলদ্ধি করেছিলেন। বিবেকানন্দ তাঁর জীবন ও শিক্ষা নিয়ে আলোচনা করেন, কিন্তু তাঁর ধ্যান ধারণাগুলি কখনো প্রচার করার চেষ্টা করেননি, বা রামকৃষ্ণের অনুলিখিত কোনো গ্রন্থে আমরা মানব সেবার বিশেষ করে অনগ্রসর শ্রেণির জনগণের সেবার উল্লেখ পাই না। অথচ এ মানবসেবাই ছিল বিবেকানন্দের জীবনসাধনার মূলকথা।
রামকৃষ্ণের মৃত্যুর (১৬. ৮. ১৮৮৬) পর নরেন্দ্র ও তাঁর বারজন শিষ্য কলকাতার উপকণ্ঠ বরাহনগরে একটি ‘মঠ’ প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে তাঁরা গুরুর নিকট থেকে শিক্ষালদ্ধ আধ্যাত্মিক সাধনা শুরু করেন। এশিয়াটিক সোসাইটি গ্রন্থাগার থেকে বই এনে তাঁরা সেখানে গভীরভাবে বৌদ্ধিকচর্চাও শুরু করেন। তাঁদের স্তবসংগীতের মধ্যে একটি কৌতুহলোদ্দীপক মন্ত্র হচ্ছে ‘প্রজাতন্ত্র দীর্ঘজীবী হউক’ (Vive la republique) যা তাঁদের এ পার্থিব জগতের রাজনৈতিক আদর্শের ইঙ্গিত প্রদান করে। বিবেকানন্দের নেতৃত্বে পরিচালিত আধ্যাত্মিক সাধনার মধ্যে বেশ কিছু অসাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিল। বরাহনগর মঠে থাকাকালীন বিবেকানন্দ তাঁর সন্ন্যাসী নাম বিবেকানন্দ গ্রহণ করেন। পরে কোনো একসময়ে ববিশানন্দনামে আরেকটি নাম গ্রহণ করেন।
বরাহনগর মঠে কিছুকাল ‘সাধনার’ অর্থাৎ আধ্যাত্মিক অনুশীলনের পর শিষ্যগণ সন্ন্যাসীদের নিয়ে আরেকটি কাজ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। আধ্যাত্মিক জ্ঞানে আলোকিত হওয়ার জন্য তাঁরা সকলে পরিব্রাজক অর্থাৎ কপর্দকহীন পর্যটক হিসেবে বিভিন্ন স্থান ভ্রমণ শুরু করেন। এ নতুন কর্মসূচিতে বিবেকানন্দ কয়েক বছরে ভারতের বিভিন্ন স্থান ভ্রমণ করেন। এ সময় তিনি জয়পুরের রাজপন্ডিতদের নিকট পাণিণির ব্যাকরণ, ক্ষেত্রবীর মহারাজার রাজপন্ডিত নারায়ণ দাসের নিকট পতঞ্জলির মহাভাষ্য এবং পোরবন্দের পান্ডুরাঙ্গের নিকট বেদান্ত পাঠ করেন। এ ভ্রমণ শেষে তাঁর এক ঘনিষ্ঠ শিষ্য তুরীয়ানন্দ তাঁকে ঈশ্বর উপলদ্ধি করেছেন কিনা জিজ্ঞাসা করেন। তিনি এর নেতিবাচক উত্তর দিয়ে বলেন তিনি একটি মাত্র জিনিস শিখেছেনলল— মানুষকে ভালোবাসা। তিনি আরও একটি বিষয় শিক্ষালাভ করেছেনল-ক্ষুধা। বিবেকানন্দ তাঁর অনুপমেয় ভঙ্গিতে দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন যে, মাঠ ও কলকারখানার শ্রমিকগণ ন্যায়সঙ্গতভাবেই এ পৃথিবীর মালিক। অধিকতর সুবিধাপ্রাপ্ত শিক্ষিত শ্রেণির কর্তব্য হচ্ছে শিক্ষার মাধ্যমে অনগ্রসর শ্রেণিকে তাদের ক্ষমতা সম্পর্কে সচেতন করা এবং প্রয়োজনীয় সেবার মাধ্যমে তাদের পর্যাপ্ত খাদ্যের ব্যবস্থা ও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী করা। বাকি বিষয়গুলি তারা নিজেরাই দেখাশুনা করবে এবং যথাসময়ে তাদের প্রাপ্য বিষয় দাবি করবে। এ উক্তির মধ্যে তাঁর ধর্ম প্রচারণার মূল উদ্দেশ্য সারাংশ আকারে বিদ্যমান রয়েছে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে সব সম্ভাবনার দেশ মনে করেন। উপরিউক্ত উদ্দেশ্যসমূহ বাস্তবায়নের জন্য একটি সংস্থা বা মিশন প্রতিষ্ঠার সকল প্রয়োজনীয় সম্পদ এখান থেকে লাভ করা সম্ভব। এছাড়া ভারতবর্ষকে শিল্পায়িত করার জন্য প্রয়োজনীয় কারিগরি জ্ঞানলাভ এখান থেকে সম্ভব।
১৮৯৩ সালে শিকাগোতে একটি সর্বধর্মীয় কনফারেন্সের আয়োজন করা হয়। এ কনফারেন্সে অংশগ্রহণের জন্য ক্ষেত্রির মহারাজা তাঁকে সাহায্য করেন। সেখানে তাঁর বক্তৃতা ব্যাপক প্রভাব সৃষ্টি করে। তিনি সেখানে ভারতের অধ্যাত্মবাদী ঐতিহ্যের কথা বললেও বিশেষ কোনো ধর্ম প্রচারের চেষ্টা করেননি। তিনি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন যে, জনগণকে তাদের ধর্ম থেকে ধর্মান্তরের তিনি বিরোধী। এর পূর্বে তিনি ভারতীয় অধ্যাত্মবাদের বিশদ ব্যাখ্যা তুলে ধরার চেষ্টা করেন। সময়ের স্রোতধারায় এমন কিছু মূহুর্ত আসে যখন বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ মানুষসহ অনেকেই প্রাতিষ্ঠানিক খ্রিস্টধর্মের আচার-অনুষ্ঠানে অতৃপ্ত হয়ে এমন একটি বাণী বা বার্তা শোনার জন্য অপেক্ষা করে যা তাদের অতৃপ্ত আত্মাকে তৃপ্ত করতে পারবে। বিবেকানন্দের বাণী ও ব্যক্তিত্ব তাদের অন্তরে রেখাপাতের সৃষ্টি করে এবং এ ধর্ম ব্যাখ্যাকর্তা আরও কিছুদিন আমেরিকায় থেকে ভারতীয় অধ্যাত্মবাদের বিশেষ করে বেদান্ত ও যোগের শিক্ষাকে আরও বিশদভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য এক ধরনের বাধ্যবাধকতা অনুভব করেন। একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, তিনি যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষিত জনগণের মধ্যে ব্যাপক প্রভাব সৃষ্টি করেছিলেন। তিনি অবশ্য স্বীকার করেছেন যে, এতে কিছু হালকা উত্তেজনা, যেমন, আমেরিকার জনগণের অতি উৎসাহ, জনগণের সাদর অভ্যর্থনা ইত্যাদি থাকলেও তাদের গভীর আগ্রহের দিকটি অবমূল্যায়ন করা উচিত হবে না। দি নিউ ইয়র্ক হেরাল্ড তাঁকে ধর্ম সম্মেলন থেকে আবির্ভূত বিশিষ্ট ব্যক্তি হিসেবে বর্ণনা করে। তিনি বোষ্টন, ডেট্র্য়েট, নিউ ইয়র্ক, বাল্টিমোর, ওয়াশিংটন, ব্রুকলিন প্রভৃতি শহর থেকে বক্তৃতা করার আমন্ত্রণ লাভ করেন। বহু আমেরিকান নারী-পুরুষ তাঁর শিষ্যত্বলাভ করেন এবং বেশ কয়েকজন তারঁ সঙ্গে ভারতে চলে আসেন। তিনি আমেরিকা থেকে ইংল্যান্ডে গেলে সেখানে এক শ্রেণির বুদ্ধিজীবী ও অভিজাত সম্প্রদায় তাঁর বক্তৃতায় আকৃষ্ট হন। বিবেকানন্দ মন্তব্য করেন যে, যুক্তরাজ্যের অভ্যর্থনায় অদম্য আবেগ না থাকলেও ইংরেজ জাতির চরিত্রের সহজাত ঐকান্তিক আগ্রহের কারণে সেখানে তাঁর প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হবে। কারণ তাঁর বাণীর প্রত্যুত্তরের মধ্যে ইংরেজ জাতির গভীর মননশীলতা রয়েছে।
ব্যবহারিক উদ্দেশ্য মনে রেখেই বিবেকানন্দ যুক্তরাষ্ট্রে গমন করেন। তাঁর এ উদ্দেশ্যটি ছিল দেশের, বিশেষ করে, দেশের দরিদ্র মানুষের বস্ত্তগত উপকার সাধন। পাশ্চাত্য অভিজ্ঞতা তাঁর কাছে এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন করে। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যর মধ্যে সহযোগিতা এবং মৌলিক সাংস্কৃতিক বিনিময়ের মধ্যেই মানুষের ভবিষ্যৎ বিদ্যমান বলে তিনি উপলদ্ধি করেন। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের সমসাময়িক ব্যক্তিদের মতো তিনিও মানবসভ্যতার এ সরলতম দ্বি-বিভাজনে বিশ্বাস করলেন। তাঁর নিকট পাশ্চাত্য সভ্যতা ছিল মহৎ গুণাবলিদ্বারাপূর্ণ মানুষের পার্থিব উদ্দেশ্য কেন্দ্রিক, যাকে ভারতীয় দর্শনের শ্রেণিকরণ অনুসারে রজোঃ গুণের সমাহার নামে অভিহিত করা হয়। ফলে তিনি এ বিশ্বাসে উপনীত হন যে, পাশ্চাত্য সভ্যতার সঙ্গে গভীর আধ্যাত্মিকতার সংমিশ্রণের মধ্যেই একটি নতুন বিশ্বব্যবস্থার সম্ভাবনা বিদ্যমান। তিনি বিশ্বাস করেন সত্ত্বঃ গুণ অর্জনের জন্যই মানষের মধ্যে রজোঃ গুণের বিকাশ ঘটাতে হবে। এ সত্ত্বঃ গুণ হচ্ছে মানুষের বিকাশের সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিক স্তর। পাশ্চাত্যের মানুষ এ ধরনের গুণে উত্তরণের জন্য প্রস্ত্তত ছিল। ভারতবর্ষ তমোঃ গুণ বা পাশবগুণে নিমজ্জিত হয়নি। সাংস্কৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু বিনিময় হবে ভবিষ্যতের আদর্শ পৃথিবীর ভিত্তি। দেশের বস্ত্তগত জীবনধারা পরিবর্তনের জন্য পাশ্চাত্য থেকে ভারতবর্ষ গ্রহণ করবে বাহ্যজগৎ সম্পর্কে তাদের জ্ঞানের সুফল এবং প্রযুক্তি।
তেজস্বী পাশ্চাত্যবাসীকে ভারতবর্ষের ঐতিহ্যবাহী আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকার গ্রহণের প্রস্তাব দেওয়া হবে এবং এভাবেই একটি বিস্ময়কর সংমিশ্রণের মাধ্যমে মানবতার পরিবর্তন সূচিত হবে। ভারতবর্ষে ব্যাপক ভ্রমণ এবং বীরোচিত সংবর্ধনা পাওয়ার পর তিনি ভারতবর্ষে স্থাপিত বেদান্ত সোসাইটি, রামকৃষ্ণ মিশনের শাখা খোলার জন্য ১৮৯৯ সালে আমেরিকায় গমন করেন। আমেরিকা থেকে তিনি ইউরোপে গমন করেন এবং প্যারিসে বিভিন্ন ধর্মীয় সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও উল্লেখযোগ্য ছিল। বিবেকানন্দের মনে ফরাসি দেশ গভীর রেখাপাত করে, কারণ তিনি প্রাচীন গ্রিস সভ্যতা দেখেই এখানে আসেন। তিনি ফরাসি দেশের সংস্কৃতির নান্দনিক গুণাবলি, বিশেষ করে নীতিবিগর্হিত কর্মের মধ্যেও প্রশংসনীয় গুণের উপাদান বিদ্যমান থাকার বিষয়টির উচ্চ প্রশংসা করেন। তাঁর এ মুক্তমন তাঁর সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে যে সংবেদনশীল উপাদান বিদ্যমান এবং তিনি যে সকল প্রকার সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত তাই প্রমাণ করে। ব্রিটেন থেকে তাঁর সবচেয়ে অনুরক্ত পাশ্চাত্য শিষ্য মিস মার্গারেট নোবেলের আগমন ঘটে। তিনি পরবর্তীতে ভারতীয় ভগ্নি তথা সিস্টার নিবেদিতা (উৎসর্গকৃত প্রাণ) নাম গ্রহণ করে এ নামেই পরিচিতি লাভ করেন। তিনি ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন এবং বাকি জীবন ভারতবর্ষেই অতিবাহিত করেন।
অত্যন্ত আধ্যাত্মিক উৎসাহ নিয়েই ভারতবর্ষ বিবেকানন্দকে অভ্যর্থনা জানায়। মাদ্রাজ এবং কলকাতা উভয় শহরেই ঘোড়ার গাড়িগুলিকে ঘোড়ার পরিবর্তে নিজেরা টেনে সারা শহর প্রদক্ষিণ করে। কেউ হয়তো এ কথা স্বীকার করবেন যে, পাশ্চাত্যে একজন স্বদেশবাসীর সাফল্যে এরূপ মাত্রাতিরিক্ত প্রতিক্রিয়ার মধ্যে এক ধরনের উপনিবেশিক মানসিকতা রয়েছে। কিন্তু এটাও ঠিক যে, তাঁর সাফল্য যুবমানসে প্রকৃতপক্ষেই প্রভাবের সূচনা করেছিল।
পরে তিনি দেশসেবার জন্য, বা আরও সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে, উপেক্ষিত জনগণের সেবার জন্য নিবেদিতপ্রাণ যুবক-যুবতীদের নিয়ে একটি সংঘ গড়ে তোলার কাজে মনোনিবেশ করেন। এ যুব বাহিনীকে উপাসনায় পরিচালনাকারী সন্ন্যাসী এবং সন্ন্যাসিনীর মতো জীবনযাপন করতে হবে, কারণ পারিবারিক জীবন দেশসেবায় আত্মার পূর্ণ উৎসর্গের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। ১৮৯৭ সালে তিনি ক্যাথলিক মিশনের মডেল অনুসারে রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠা করেন। এর দুই বছর পর এ প্রতিষ্ঠানের ভৌত কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে কলকাতার উপকণ্ঠে বেলুর মঠ প্রতিষ্ঠিত হয়। ভারতের আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকার জ্ঞানলাভ করার লক্ষ্যে তিনি বেদান্ত এবং শ্রীরামকৃষ্ণের শিক্ষা প্রচারের জন্য উদ্বোধন নামে একটি বাংলা এবং প্রবুদ্ধ ভারত নামে একটি ইংরেজি পত্রিকা প্রকাশ করেন। দ্বিতীয়বার আমেরিকা ও ইউরোপ ভ্রমণের পর তিনি মাত্র কয়েক বছর জীবিত ছিলেন। এ সময়ের মধ্যেই স্বামীজী রামকৃষ্ণ মিশনের অধীন বেশ কয়েকটি মিশন প্রতিষ্ঠা করেন। এরমধ্যে রয়েছে রামকৃষ্ণ সেবাশ্রম, রাকৃষ্ণ হোম, রামকৃষ্ণ পাঠশালা ইত্যাদি। এ কয়েক বছর তিনি ব্যাপকভাবে ভারতবর্ষের সমস্যা এবং ভারতীয় যুবকদের বিভিন্ন কর্তব্য নিয়ে চিন্তাভাবনা করেন। এ সম্পর্কিত তাঁর বক্তৃতা এবং রচনাবলি নিয়ে রামকৃষ্ণ মিশন আট খন্ড বাংলা ও আট খন্ড ইংরেজি গ্রন্থ প্রকাশ করে। তাঁর বাংলা রচনাবলি বাংলা ভাষার মধ্যে সুন্দর ও বলিষ্ঠ কথ্য গদ্য ভাষার প্রথম উদাহরণ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একবার মন্তব্য করেছিলেন ভবিষ্যতে বাঙালিরা তাদের গদ্যের জন্য এ ভাষা ব্যবহার করবে। তাঁর রচনাবলির মধ্যে অনেকগুলি এখনো ব্যাপকভাবে পঠিত হয়। এগুলির মধ্যে রয়েছে: পরিব্রাজক (১৯৯৯), প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য (১৯০৩), ভাববার কথা (১৯০৫), বর্তমান ভারত (১৯০৫), কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ, রাজযোগ ইত্যাদি। ভবিষ্যৎ জাতির জন্য ক্ষতিকর সবকিছুকেই তিনি কঠোরভাবে সমালোচনা করেছেন এবং এজন্য তিনি বিরোধিতারও সম্মুখীন হয়েছেন। তিনি খ্রিস্টান মিশনারিদের সমালোচনা করেছেন, কারণ তাঁর মতে ধর্মান্তরিত হওয়া এবং নিজের বিশ্বাস থেকে অন্য বিশ্বাসে দীক্ষিত হওয়া ঘৃণার বিষয়। এ ব্যাপারে ভারতীয় খ্রিস্টান মিশনারিদের তিনি কঠিন আঘাত হেনেছিলেন। তাঁর সময় অধিকাংশ শিক্ষিত ভারতীয়দের নিকট থিওসফিক্যাল আন্দোলন এক ধরনের সমালোচনা-ঊর্ধ্ব পরম পবিত্র বিষয় ছিল। কারণ ম্যাডাম ব্লাভাস্কি, কর্ণেল ওলকট, মিসেস অ্যানি বসন্ত প্রমুখ হিন্দু আধ্যাত্মিকতাকে উদার কণ্ঠে প্রশংসা করেছেন। খ্রিস্টান মিশনারি এবং ইঙ্গ-ভারতীয় সংবাদপত্রগুলি পরাধীন ভারতবাসীকে বিরামহীনভাবে সমালোচনা করার কারণে তাদের অহংবোধ সংকুচিত হয়ে পড়ে। কিন্তু কতিপয় বিখ্যাত শ্বেতাঙ্গ ব্যক্তির সমালোচনার কারণে তারা উজ্জীবিত হয়ে ওঠেন। কিন্তু বিবেকানন্দ এ উভয় গোষ্ঠীর উদ্ভট ‘আধ্যাত্মিক’ দাবির প্রতিবাদ করেন। তাঁরা বিশ্বাস করতেন যে, পরমাত্মার বাসস্থান তিববতে এবং মাঝেমধ্যে শুধু থিওসফিক্যাল সোসাইটির নেতাদের দেখা দেন। এছাড়া পাশ্চাত্য ভ্রমণের সময় তারা যে অপকর্ম করেছিলেন তিনি তারও প্রতিবাদ করেন। তিনি এসব বিষয়ে নিশ্চুপ থাকতে অস্বীকার করেন, আর এ কারণেই তাঁর অনেক শত্রুও সৃষ্টি হয়। তিনি ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলনেরও তীব্র বিরোধিতা করেন। কারণ তাঁর দৃষ্টিতে এগুলির মধ্যে এক ধরনের দুর্বলতা বা পৌরুষহীনতা রয়েছে। তিনি অমৃত বাজার পত্রিকার স্বদেশ প্রেমিক প্রতিষ্ঠাতা শিশিরকুমার ঘোষ ও তাঁর পরিবারের নেতৃত্বে পরিচালিত বাংলায় নব-বৈষ্ণব আন্দোলনের কঠোর সমালোচক ছিলেন। বিবেকানন্দের মৃত্যুর পর অমৃত বাজার পত্রিকা এরূপ সংক্ষিপ্ত সংবাদ পরিবেশন করে: জনগণের নিকট বিবেকানন্দ নামে পরিচিত নরেন দত্ত মৃত্যুবরণ করেছেন।
দেশমাতৃকার সেবার জন্য বিবেকানন্দ যুবসমাজকে জীবন উৎসর্গ করার আহবান জানান। এ পৃথিবীর বৈধ উত্তরাধিকারী অধিকার বঞ্চিতদের সেবা করাই তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, কারণ তারাই মানবসভ্যতার প্রকৃত স্র্ষ্টা। তিনি রামকৃষ্ণের সাথী শিষ্যদের এ আহবান জানান তারা যেন মানচিত্র, ভূগোলক ও ম্যাজিক লণ্ঠন নিয়ে সাধারণ মানুষের নিকট যান এবং তাদের এ পৃথিবী এবং পৃথিবীতে তাদের স্থান ও মর্যাদা সম্পর্কে শিক্ষা দেন। তারা যদি নিজেদের শক্তি সম্পর্কে একবার সচেতন হয়,তাহলে তারা মুক্তির জন্য নিজেরাই কর্মসূচি প্রণয়ন করতে পারবে। দরিদ্রের সেবার আহবানের তিনি যথাযথ সাড়া পেয়েছিলেন, কারণ রামকৃষ্ণ মিশনে কখনো স্বেচ্ছাসেবকের অভাব হয়নি।
বিবেকানন্দ জাতির যুবসমাজকে যে আহবান জানিয়েছিলেন তার অন্য একটি দিক ছিল যদিও সেটি তার বক্তব্যে সুস্পষ্টরূপে প্রকাশ পায়নি। এক বিরাট সংখ্যক আদর্শবাদী যুবসমাজ জাতির সেবার আহবানকে স্বদেশমুক্তির জন্য জীবন উৎসর্গের আহবান হিসেবে ব্যাখ্যা করে। বিশেষ করে ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের পর বিবেকানন্দের এ বার্তা এক নতুন বিপ্লবী অনুপ্রেরণার সৃষ্টি করে। দাবি করা হয় বিবেকানন্দ প্রত্যক্ষভাবে বিপ্লবী কর্মকান্ডকে উৎসাহিত করেছেন। অবশ্য এ দাবির সত্যতা সন্দেহাতীত নয়। একথা সত্য ভারতে ব্রিটিশ শাসনকে তিনি অত্যন্ত ঘৃণা করতেন এবং তিনি একবার বালগঙ্গাধর তিলককে বলেছিলেন চাপেকর ভ্রাতৃদ্বয়ের সম্মানে স্বর্ণমূর্তি নির্মিত হওয়া উচিত। এ চাপেকর ভ্রৃাতৃদ্বয় ভারতে প্রথম বিপ্লবী যারা এক ব্রিটিশ কর্মকর্তাকে গুপ্তহত্যা করার কারণে তাদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়। অন্যদিকে রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্ক থাকার বিষয়টিকে তিনি সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন। তবে সন্দেহাতীত বিষয়টি হচ্ছে বাংলার বিপ্লবী যুবসমাজ তাঁর আদর্শকে সামনে রেখেই ফাঁসিকাষ্ঠে জীবন উৎসর্গ করেছে এবং পরোক্ষভাবে তাঁরই নির্দেশে গীতার বাণীকে ব্যাখ্যা করেছে দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য আত্মউৎসর্গের আহবান হিসেবে।
ঐতিহাসিকদের পরবর্তী প্রজন্ম এবং রাজনীতিতে চরমপন্থী হিন্দুদের একাংশ বিবেকানন্দকে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধেও হিন্দুধর্মের পুনর্জাগরণের একজন বড় কর্মী হিসেবে আখ্যায়িত করে। কেউ কেউ যুক্তি প্রদান করেন যে, প্রথম কয়েক দশকের সংস্কার-আন্দোলন রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের প্রভাবেই উজ্জীবিত হয়েছিল। অবশ্য এসব প্রশ্নে নানা যুক্তি থাকতে পারে। প্রথমত, হিন্দু পুনর্জাগরণবাদীদের একটি প্রধান ধারণা পাশ্চাত্যের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারসমূহের পূর্বেই হিন্দুদের সেসব বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান ছিল—এরূপ দাবি নিয়ে তিনি কৌতুক করেন এবং একে উদ্ভট বলে আখ্যায়িত করেন। দ্বিতীয়ত, মধ্যবিত্তের সংস্কার আন্দোলন সম্পর্কে তিনি সন্দিহান ছিলেন, কারণ এসব বিষয়ে মধ্যবিত্ত শ্রেণির আন্তরিকতা নিয়ে তাঁর সংশয় ছিল। ভারতবাসী দ্বারা ভারতীয় ঐতিহ্যের সমালোচনাকে তিনি অপছন্দ করতেন। বাল্য বিবাহের মতো এবং হিন্দু আচার-অনুষ্ঠানের বিষয়গুলি সম্পর্কে তিনি অত্যন্ত সমালোচনা মুখর ছিলেন। বড় বড় তীর্থক্ষেত্রে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে প্রচুর অর্থব্যয়ের মতো বিষয়কে তিনি কখনোই অনুমোদন করতেন না। এ সম্পর্কে তাঁর উপদেশ ছিল সকল মন্দির ও উপাসনালয়ের মালপত্র গঙ্গানদীতে নিক্ষেপ করা উচিত এবং আমাদের সব শক্তি অধিকার বঞ্চিতদের সেবায় নিয়োগ করা উচিত, কারণ তারাই হচ্ছে দেবতারূপী অবতার। বিদেশ ভ্রমণকালে তিনি হিন্দুদের আচার-আনুষ্ঠান সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকতেন। কারণ তিনি তাঁর সমাজের অসঙ্গতিগুলি দেশের বাইরের জনসমক্ষে প্রকাশ করতে চাননি। কিন্তু স্বদেশে তিনি গুরুত্বহীন বিষয়ে ফাঁকা-হিন্দুসংস্কার দিয়ে বিশুদ্ধ ধর্মীয় রীতিনীতি পালনের তীব্র সমালোচক ছিলেন। ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি হিন্দু পুনর্জাগরণবাদী অধিবক্তাদের চেয়ে ভিন্ন ছিল। ব্রিটিশ ঐতিহাসিক কর্তৃক মধ্যযুগীয় ভারতের ভুল ব্যাখ্যার কারণে আধুনিক ভারতীয় জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে ভুল ধারণার সৃষ্টি হয়: অনেকে এ যুগকে মুসলিম স্বৈরশাসকের যুগ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। বিবেকানন্দের একটি উক্তির মধ্যে এরূপ অপব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায়। তিনি বরং এর বিপরীতে বারবার ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে তাঁর উদাত্ত প্রশংসা ব্যক্ত করেছেন। কারণ একমাত্র এ ধর্মেই ঈশ্বরের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য কোনো মধ্যস্থতার প্রয়োজন নেই। তিনি আশা প্রকাশ করেন ভবিষ্যৎ ভারতবাসীদের মুসলিম দেহ এবং বৈদান্তিক আত্মা থাকবে। এ প্রসঙ্গে তিনি কিছু মুগল বাদশাহদের হিন্দু দেব-দেবী আরাধনার কথা উল্লেখ করেন যা কিনা ভারতীয় সংস্কৃতির অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্যের প্রতি এক ধরনের শ্রদ্ধা নিবেদন। মুগল সাম্রাজ্যের ঐতিহ্যময় প্রতিভা সম্পর্কে বিকোনন্দের অত্যন্ত গৌরব ছিল যা ভগ্নি নিবেদিতা উল্লেখ করেছেন। সাম্প্রতিককালের হিন্দুধর্মের গোঁড়া বিষয় নিয়ে কোনো প্রকার বক্তব্য বা ইঙ্গিত আমরা তাঁর মধ্যে লক্ষ করি না।
সাধারণ মানুষের নবজীবনদানের উদ্দেশে সেবামূলক কাজ করা এবং সকল প্রকার কুসংস্কার থেকে মুক্তি এবং অমানবিক কর্ম থেকে মুক্ত হয়ে একটি দৃঢ় জাতিসত্ত্বা গঠন করা ছিল তাঁর লক্ষ্য। তাঁর স্বদেশ সেবামূলক আবেদনে ভারতের আদর্শবাদী যুবসমাজ অনুপ্রাণিত হয়েছিল, এমনকি দেশের স্বাধীনতার জন্য তারা মৃত্যুবরণ করতেও অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু তাঁর সাধারণ মানুষের নবজীবনলাভের বার্তাটি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এটি সফল করার সময় এখনো আসেনি। [তপন রায় চৌধুরী]