বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমী
বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমী (বার্ড) স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের অধীনে পল্লী উন্নয়ন বিষয়ে গবেষণা, প্রশিক্ষণ ও প্রায়োগিক কর্মকান্ডে নিয়োজিত একটি স্বায়ত্তশাসিত জাতীয় প্রতিষ্ঠান। এটি ১৯৫৯ সালে কুমিল্লা জেলার কোর্টবাড়িতে প্রতিষ্ঠিত হয়। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আখতার হামিদ খান।
বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমীর কার্যক্রম একটি বোর্ড অব গভর্নর্স কর্তৃক পরিচালিত হয়। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী এ বোর্ডের চেয়ারম্যান। প্রশাসনিকভাবে বার্ড স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যুক্ত। মহাপরিচালক বার্ডের প্রধান নির্বাহি কর্মকর্তা। বার্ড ৯ টি অনুষদে বিভক্ত এবং প্রতিটি অনুষদ পরিচালিত হয় একজন পরিচালকের অধীনে। প্রতিটি অনুষদ আবার দুটি প্রধান বিভাগে বিভক্ত, যথা সার্ভিস বিভাগ ও একাডেমী বিভাগ। সার্ভিস বিভাগের আওতায় রয়েছে প্রশিক্ষণ, গবেষণা, প্রকল্প এবং প্রশাসন। একাডেমী বিভাগের অধীনে রয়েছে পল্লী প্রশাসন ও স্থানীয় সরকার, পল্লী অর্থনীতি ও ব্যবস্থাপনা, পল্লী শিক্ষা ও সমাজ উন্নয়ন, গ্রামীণ সমাজবিজ্ঞান ও জনসংখ্যাতত্ত্ব এবং কৃষি ও পরিবেশ। বার্ড ক্যাম্পাসে রয়েছে ৫ টি হোস্টেল, ৪ টি কনফারেন্স কক্ষ, ২ টি ক্যাফেটারিয়া, ১ টি মসজিদ, ১ টি গ্রন্থাগার ও ১ টি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
পরিকল্পনা ও প্রকল্প তৈরির জন্য আর্থ-সামাজিক তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে বার্ড গবেষণা পরিচালনা করে। এ গবেষণা কাজ পরিচালনার জন্য বার্ডের রয়েছে মাল্টি ডিসিপ্লিনারি অনুষদ। গবেষণার ফলাফল একাডেমীতে প্রশিক্ষণ উপকরণ হিসেবে এবং উন্নয়ন কর্মসূচি প্রণয়নের জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা কমিশন ও নীতিনির্ধারকগণ কর্তৃক তথ্য-উপাত্ত হিসেবে ব্যবহূত হয়। এ ছাড়া একাডেমী এককভাবে অথবা বিভিন্ন সরকারি সংস্থা, বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচির মূল্যায়নেও নিয়োজিত।
বার্ড উন্নততর প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, প্রশাসনিক কাঠামো, উৎপাদনের সমন্বয় ও উৎপাদন প্রক্রিয়া সম্পর্কে পরীক্ষামূলক প্রকল্প তৈরি করে। এসব প্রকল্পে সম্পৃক্ত করা হয় গ্রামীণ মানুষ, গ্রামীণ প্রতিষ্ঠান, স্থানীয় পরিষদ এবং সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের। ষাটের দশকের প্রথমদিকে একাডেমী গ্রামীণ সমবায়ের একটি নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করে। প্রাথমিক পর্যায়ে কুমিল্লা সদর থানার ক্ষুদ্র কৃষকদের সমবায় সমিতির অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এতে সদস্য প্রশিক্ষণ, নিয়মিত সাপ্তাহিক সভা, ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের পাশাপাশি উচ্চফলনশীল বীজ, সার, সেচ প্রভৃতি প্রযুক্তি গ্রহণের ওপর অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। গ্রামভিত্তিক প্রাথমিক সমবায়গুলিকে থানা পর্যায়ে একত্র করে থানা কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতি গঠন করা হয়। এ সমিতি গ্রাম পর্যায়ের প্রাথমিক সমবায়গুলিকে প্রশিক্ষণ ও ঋণ সহায়তা দিয়ে থাকে এবং পণ্য গুদামজাতকরণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বাজারজাতকরণ, যান্ত্রিকীকরণ প্রভৃতি উদ্যোগ গ্রহণ করে। এ ধরনের দু’স্তরবিশিষ্ট সমবায় ফলপ্রসূ প্রমাণিত হওয়ায় ১৯৭২ সালে সরকার কর্তৃক তা গৃহীত হয় এবং বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে এই ব্যবস্থা সারা দেশে প্রবর্তিত হয়।
বিকেন্দ্রীকৃত ও সমন্বিত পল্লী প্রশাসনের মডেল হিসেবে থানা প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়। জাতিগঠনমূলক বিভাগ ও গ্রামীণ জনসাধারণের সংগঠনের (যেমন স্থানীয় পরিষদ, সমবায়সমূহ) মধ্যে কার্যকর সমন্বয় সাধন এ কেন্দ্রের লক্ষ্য। জনগণ ও সরকার হলো উন্নয়নের অংশীদার এবং থানা প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন কেন্দ্র এ অংশীদারিত্ব উন্নয়নে প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো জোগায়। ১৯৬৩ সালে সরকার পর্যায়ক্রমে সারা দেশে এ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার কর্মসূচি গ্রহণ করে এবং এক সময়ে সব থানায় কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৮২ সালে থানা পরিষদের অধীনে বিকেন্দ্রীকৃত প্রশাসন ব্যবস্থা চালুর ক্ষেত্রে এ কেন্দ্র ভিত্তি হিসেবে ব্যবহূত হয়েছিল।
এসব ভৌত অবকাঠামোর উন্নয়নে একাডেমী একটি পরীক্ষামূলক প্রকল্পের মাধ্যমে গ্রামবাসী ও স্থানীয় পরিষদগুলিকে সম্পৃক্ত করে, যা পরবর্তীকালে গ্রামীণ পূর্ত কর্মসূচি হিসেবে আখ্যায়িত হয়। গ্রামবাসী ও স্থানীয় পরিষদ প্রতিনিধিদের দ্বারা স্থানীয় পর্যায়ে প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন সম্পন্ন হয়। এসব প্রকল্প বন্যা প্রতিরোধ এবং যোগাযোগ সহজতর করা ছাড়াও ভূমিহীনদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে। এ কর্মসূচির সাফল্যের ফলে এটি ১৯৬২-৬৩ সালে সারা দেশে চালু করা হয়।
বাংলাদেশে ডিসেম্বর থেকে মার্চ মাস সাধারণত শুষ্ক মৌসুম। খালবিল, নদীনালা এবং ভূগর্ভস্থ উৎসসমূহে পানির সহজলভ্যতা সত্ত্বেও সেচব্যবস্থার অভাবে চাষাবাদ ব্যাহত হত। প্রযুক্তি ও যথাযথ সংগঠনের অভাবে ভূপৃষ্ঠ ও ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করে তা নালার মধ্য দিয়ে সরবরাহের সহজ কাজটাও আয়ত্তের বাইরে ছিল। গবেষণা এলাকায় (কুমিল্লা সদর থানা) গ্রামীণ সমবায়গুলির ব্যবস্থাপনায় লিফট পাম্পের সাহায্যে পৃষ্ঠপানি এবং নলকূপের সাহায্যে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারের ওপর একাডেমী পরিচালিত পরীক্ষণ এসময় একটি নতুন ধানচাষ মৌসুমের (বোরো) সূচনা ঘটায়। পরীক্ষণ কর্মসূচির বাস্তবায়ন এবং সেচ-প্রযুক্তির পরিচালনায় সমবায়ী ও থানা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের যৌথ উদ্যোগের প্রয়োজনীয়তার দরুণ একটি নতুন প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠে, যা ১৯৬৯ সালে দেশব্যাপী থানা সেচ কর্মসূচি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
বাংলাদেশের পল্লী অঞ্চলে মানুষের আর্থ-সামাজিক সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া একাডেমীর গবেষণা কাজের একটি প্রধান লক্ষ্য। এক্ষেত্রে বার্ড কৃষি, সমবায়, দারিদ্র্য, ক্ষুদ্রঋণ, গ্রামীণ ভৌত অবকাঠামো, গ্রামীণ শিল্প, উন্নয়ন যোগাযোগ, সুশাসন, জেন্ডার, পরিবেশ উন্নয়ন, স্থানীয় সরকার, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, শিক্ষার গুণগত উন্নয়ন, স্বাস্থ্য-পুষ্টি, সমাজ পরিবর্তন ইত্যাদি বিষয়ে ৭০৪ টি গবেষণা পরিচালনা করেছে। এ ছাড়া ২০০৮-২০০৯ অর্থ বছরে বার্ডের ২৫ টি নতুন গবেষণা প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে খামার ব্যবস্থাপনা ও গ্রামীণ পরিবারের জীবিকার ধরন নিরূপণ, গ্রামীণ এলাকায় বয়স্কদের ওপর সেফটিনেট কর্মসূচির প্রভাব নির্ণয়, দারিদ্র্য নিরসন কার্যক্রমে সুশাসনের অবস্থা নিরূপণ, পল্লী উন্নয়নে তথ্য-প্রযুক্তি কৌশল, কৃষি ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সিভিডিপি’র অবদান, কৃষি পণ্যসমূহের ভেল্যু চেইন বিশ্লেষণ, কুমিল্লা মডেল রিভিজিটিং প্রভৃতি। বার্ডের গবেষণা বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়ন এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে দাতা সংস্থার অর্থায়নে সম্পন্ন হয়।
মানব সম্পদ উন্নয়নে প্রশিক্ষণ বার্ডের অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। মূলত সরকারি কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে বার্ড যাত্রা শুরু করেছিল। বার্ড একই সঙ্গে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের প্রশিক্ষণ এবং তৃণমূল পর্যায়ের লোকদেরও প্রশিক্ষণ দেয়। জাতীয় পর্যায়ের প্রশিক্ষণার্থীদের মধ্যে রয়েছে সরকারি কর্মকর্তা, পল্লী উন্নয়নের সঙ্গে জড়িত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা, স্থানীয় সরকার ও সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। এ ছাড়া বার্ড নিয়মিত সেমিনার, কর্মশালা ও সম্মেলনের আয়োজন করে। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত বার্ড ২,২০,৪১৫ জনকে প্রশিক্ষণ দান করেছে। বর্তমানে গড়ে প্রতি বছর ১৫০-১৮০ টি প্রশিক্ষণ কোর্সে ৬,০০০ প্রশিক্ষণার্থী অংশগ্রহণ করে থাকে।
বার্ডের গবেষণার ক্ষেত্রে পরীক্ষামূলক প্রকল্প হচ্ছে প্রায়োগিক গবেষণা। এটি নিরবচ্ছিন্ন গবেষণার মাধ্যমে পল্লী এলাকার বিরাজমান সমস্যার বাস্তব এবং কার্যকর সমাধান বের করে। এ ধরনের একটি প্রকল্প হলো কুমিল্লা মডেল প্রকল্প যা পল্লী উন্নয়নে কুমিল্লা পদ্ধতি নামে পরিচিত। এ ছাড়া সামাজিক উন্নয়নের ধারণাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে বার্ড আরও যে সকল কর্মসূচি গ্রহণ করেছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ইমামদের মাধ্যমে পরিচালিত ফিডার স্কুল, বাণিজ্যিকভাবে জন্মনিরোধ সামগ্রী বিতরণ, ধাত্রী প্রশিক্ষণ কর্মসূচি, নারী সম্প্রসারণ কর্মী ব্যবস্থার প্রবর্তন, পল্লী বিদ্যুতায়ন কর্মসূচির বাস্তবায়ন, গ্রামীণ কৃষকদের মধ্যে ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ, আদর্শ কৃষক পদ্ধতির মাধ্যমে কৃষি সম্প্রসারণ, যুব উন্নয়ন কর্মসূচির প্রবর্তন প্রভৃতি। বার্ডের এ সকল প্রকল্প পরীক্ষা নিরীক্ষার পর পল্লী উন্নয়নের ক্ষেত্রে জাতীয় পর্যায়ে সরকার বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে। বার্ডের প্রায়োগিক গবেষণার সাম্প্রতিক কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন কর্মসূচি (সিভিডিপি) যা জাতীয় পর্যায়ে সরকারি কর্মসূচি হিসেবে বাস্তবায়িত হচ্ছে। প্রাথমিক পর্যায়ে (২০০৫-২০০৯) বৃহত্তর ৪টি বিভাগের ২১ টি উপজেলা এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে (২০০৯-২০১৪) ৬টি বিভাগের ৫৯ টি জেলার ৬১ টি উপজেলার ৩,৯৭৫ টি গ্রাম এর অন্তর্ভুক্ত। সমবায়ের এ নতুন মডেল প্রকল্পের প্রধান বৈশিষ্ট্য ‘এক গ্রাম এক সমিতি’ নীতির মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করা।
ইকো-টয়লেট বার্ড উদ্ভাবিত একটি স্বাস্থ্যসম্মত, পরিবেশবান্ধব এবং দীর্ঘস্থায়ী পদ্ধতি। এতে মানব বর্জ্যকে সারে রূপান্তরিত করা হয়। বাংলাদেশের প্রায় ৩৫ ভাগ ইউনিয়নে একটি করে ইকো-টয়লেট স্থাপিত হয়েছে। এ ছাড়া বার্ড উদ্ভাবিত কম্পিউটার ভিত্তিক ডাটাবেইসের মাধ্যমে দারিদ্র্য মনিটরিং পদ্ধতি মঙ্গা অঞ্চলের ৪টি জেলায় প্রয়োগ করা হয়েছে।
পল্লী উন্নয়নের ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৮৬ সালে বার্ড স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার লাভ করে। [এম.এস ইসলাম এবং গোলাম মোস্তাকিম]