বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চতর কৃষি শিক্ষা ও গবেষণার অন্যতম প্রধান প্রতিষ্ঠান। স্থলজ ও জলজ উৎপাদনের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত কৃষিবিজ্ঞানের সকল শাখাই এর কার্যক্রমভুক্ত। ‘পূর্ব পাকিস্তান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ ১৯৬১’-এর প্রেক্ষিতে ১৯৫৯ সালে জাতীয় শিক্ষা কমিশন এবং খাদ্য ও কৃষি কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে ১৯৬১ সালে এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী এই বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর এবং উপাচার্য নির্বাহী প্রধান।
অবস্থান রাজধানী ঢাকার ১২০ কিলোমিটার উত্তরে ময়মনসিংহ শহরের ৩ কিলোমিটার দক্ষিণে পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের পশ্চিম তীরে প্রায় ১২০০ একর জায়গা জুড়ে রয়েছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। এখানে আছে আরও দুটি জাতীয় গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট।
উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যসমূহ ১. কৃষির সকল শাখায় পেশাভিত্তিক উচ্চতর শিক্ষা প্রদান; ২. কৃষির বিভিন্ন বিষয়ে মৌলিক ও ফলিত গবেষণা পরিচালনা; ৩. বিভিন্ন পর্যায়ে ও বিভিন্ন ধরনে কৃষি সম্প্রসারণ ও জাতি গঠনমূলক কার্যকলাপ পরিচালনা ও তদারকি; ৪. কৃষি ও পল্লী উন্নয়নের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মী, কৃষক ও খামার নেতাদের জন্য প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা; ৫. দেশের ভিতরের ও বাইরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার মধ্যে দ্বিপক্ষীয় এবং বহুপক্ষীয় সহযোগিতা ও যৌথ উদ্যোগের জন্য প্রয়োজনীয় সুবিধাদি প্রদান।
শিক্ষা কার্যক্রম ১৯৬১ সালে দুটি অনুষদের অধীনে ২৩টি বিভাগ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কার্যক্রম শুরু করে। পশুচিকিৎসা ও কৃষি এ দুটি অনুষদ মিলে শুরুতে শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রী ছিল যথাক্রমে ৩০ ও ৪৪৪ জন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কয়েক মাস পর তৃতীয় অনুষদ হলো পশুপালন। কৃষি অর্থনীতি ও গ্রামীণ সমাজবিদ্যা অনুষদ, কৃষি প্রকৌশল ও প্রযুক্তি অনুষদ এবং মৎস্যবিজ্ঞান অনুষদ যথাক্রমে ১৯৬৩-৬৪, ১৯৬৪-৬৫ এবং ১৯৬৭-৬৮ শিক্ষাবর্ষ থেকে কার্যক্রম শুরু করে।
বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬টি অনুষদের অধীনে ৪১টি শিক্ষাদানকারী বিভাগ রয়েছে। অনুষদগুলি হলো: পশুচিকিৎসা বিজ্ঞান অনুষদ, কৃষি অনুষদ, পশুপালন অনুষদ, কৃষি অর্থনীতি ও গ্রামীণ সমাজবিদ্যা অনুষদ, কৃষি প্রকৌশল ও কারিগরি অনুষদ এবং মৎস্যবিজ্ঞান অনুষদ।
বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতক পর্যায়ে উচ্চ মাধ্যমিক-উত্তর ৪ বছরের ডিভিএম এবং অনার্সসহ বি.এসসি (এজি), বি.এসসি (এএইচ), বি.এসসি (এজি, ইকোন) এবং বি.এসসি ফিশারীজ এবং বি.এসসি (এজি ইঞ্জি) ডিগ্রি দিয়ে থাকে। মাস্টার্স ডিগ্রি পর্যায়ে বর্তমানে মোট ৩৫টি বিভাগ পরপর ৩টি সেমিস্টারে কোর্স ক্রেডিট ও গবেষণার ভিত্তিতে শিক্ষা কার্যক্রম চালাচ্ছে। পুরো ৩ বছর মেয়াদি (যা ৬ বছর পর্যন্ত বাড়ানো যেতে পারে) ডক্টরাল প্রোগ্রামে পরপর দুবছর বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থান বাধ্যতামূলক। বর্তমান ৩৪টি বিভাগ পিএইচ.ডি কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণা কমিটি (The committee for Advanced Studies & Research/CASR) স্নাতকোত্তর পর্যায়ে শিক্ষা ও গবেষণা, উন্নয়ন সমন্বয় ও তদারকির দায়িত্বে রয়েছে।
১৯৯৯-২০০০ সালে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বমোট ৪০৪ জন শিক্ষক কর্মরত ছিলেন।
ছাত্রসংখ্যা ১৯৯৯-২০০০ শিক্ষাবর্ষে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট ৪,৬৩১ জন ছাত্রছাত্রীর মধ্যে স্নাতক, মাস্টার্স ও পিএইচ.ডি পর্যায়ে ছিল যথাক্রমে ৩,৫৬৫, ৯৩৮ ও ১২৮ জন। মোট শিক্ষার্থীর ১৫% ছাত্রী।
গবেষণা সাফল্য বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত মূল দুই ধারার গবেষণার মধ্যে আছে স্নাতকোত্তর পর্যায়ের এমএস ও পিএইচডি ছাত্রছাত্রীদের গবেষণা এবং বিশ্ববিদ্যালয় বা বাইরের সংস্থার অর্থায়নে কোন সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে প্রকল্প গবেষণা। গবেষণা প্রকল্পসমূহের সুষ্ঠু সমন্বয় ও ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে ১৯৮৪ সালে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় রিসার্চ সিস্টেম এ পর্যন্ত ৩২২টি প্রকল্প সম্পন্ন করেছে এবং বর্তমানে ১১২টি প্রকল্পের কাজ চলছে।
বিশ্ববিদ্যালয় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শস্যের জাত, চাষাবাদ কৌশল ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও প্রসারে সাফল্য অর্জন করেছে। এসব প্রযুক্তি দেশের কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে সরাসরি অবদান রাখছে। উদ্ভাবিত ফসলের জাতের মধ্যে রয়েছে BAU-63 এবং BAU-16 নামে দুটি আধুনিক ধানের জাত; সম্পদ ও সম্বল নামে দুটি উচ্চ ফলনশীল সরিষা; সয়াবিনের চারটি কালটিভার ডেভিস, ব্রাগ, সোহাগ ও জি-২; মিষ্টি আলুর দুটি কালটিভার- কমলাসুন্দরী ও তৃপ্তি এবং মুখি কচুর (Colocasia esculenta) তিনটি কালটিভার- লতিরাজ, বিলাসী ও দৌলতপুরী (বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট যৌথভাবে)। চাষাবাদের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় উদ্ভাবিত প্রযুক্তিগুলির মধ্যে আরও রয়েছে বীজবপন যন্ত্র, সার ছিটানো যন্ত্র, মাটি পরীক্ষার কিট, জীবজসার (biofertilizer), বহুবর্ষজীবী পাতাজাতীয় সবজির চাষ, ধইঞ্চার জোড়কলম প্রভৃতি। বিভিন্ন ধরনের ফলের চাষে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় উদ্ভাবিত প্রযুক্তির মধ্যে রয়েছে কলা ও আনারস উৎপাদনের উন্নত প্রযুক্তি, পেয়ারা গাছের নেতিয়ে পড়া (wilt) রোগ নিয়ন্ত্রণ কৌশল, ফলের রস সংরক্ষণের আধুনিক প্রযুক্তি প্রভৃতি। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণালব্ধ বেশ কয়েকটি প্রযুক্তি মৎস্য ও পশুসম্পদ উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে, যেমন পোল্ট্রি ভেকসিন উৎপাদন, মুরগির বসন্ত ও রানিক্ষেত টিকা উদ্ভাবন, গবাদি পশুর কৃত্রিম প্রজনন, সুষম ‘পোল্ট্রি ফিড’, গরুর খাবার হিসেবে ‘ইউরিয়া মোলাসেস’-যুক্ত খড়ের ব্লক, স্কেভেনজিং পোল্ট্রির উন্নত জাত, ধানক্ষেতে চিংড়ি ও অন্যান্য মাছের চাষ, মাগুর ও শিং (Heteropneustes fossilis) মাছের কৃত্রিম প্রজনন কৌশল, মাগুর (Clarias batrachus) চাষে কৃত্রিম খাবার প্রভৃতি। উন্নত লাঙল, সোলার ড্রায়ার, কম খরচে সেচনালা প্রস্ত্তত, মাটি-সিমেন্ট ও ফেরো-সিমেন্টে তৈরি শস্যগুদাম, বায়োগ্যাস প্লান্ট প্রভৃতি ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সাফল্য অর্জন করেছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা কার্যক্রম, বিশেষভাবে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ও জীবপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে গবেষণার সুযোগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে একটি কেন্দ্রীয় গবেষণাগার নির্মাণ করা হচ্ছে।
প্রশিক্ষণ কৃষি গবেষণা, প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন কর্মকান্ডে নিয়োজিত কর্মকর্তা ও গবেষকদের চাকরিকালীন প্রশিক্ষণদানের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে ১৯৭৬ সালে স্নাতক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (Graduate Training Institute/GTI) প্রতিষ্ঠিত হয়।
কৃষি অর্থনীতি ও গ্রামীণ সমাজবিদ্যা অনুষদ ১৯৬৫ সালে প্রতিষ্ঠিত সামাজিক অর্থনৈতিক গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর মাধ্যমে সম্পদ বরাদ্দ, বিভিন্ন কৃষিপ্রযুক্তির অর্থনৈতিক দিক, কৃষিপণ্যের মূল্য নির্ধারণ ও বাজারজাতকরণ, কৃষিঋণ ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা, গ্রামীণ প্রতিষ্ঠান, বিশেষত সমবায় প্রভৃতি বিষয়ের ওপর গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা ও প্রশিক্ষণের আয়োজন করে। পল্লী অঞ্চলের সমস্যা সমাধানে গৃহীত অনুসিদ্ধান্তের বিভিন্ন দিকের ওপরও ব্যুরো গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে।
কৃষি প্রকৌশল ও কারিগরি অনুষদের সঙ্গে যুক্ত গবেষণা, পরীক্ষণ ও পরামর্শদান ব্যুরো (The Bureau of Research, Testing and Consultation) কৃষি প্রকৌশলের ক্ষেত্রে গবেষণা ও প্রশিক্ষণে উৎসাহ যোগায় এবং অভিন্ন ক্ষেত্রে পরীক্ষণ ও পরামর্শ ধরনের বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের সেবা প্রদান করে।
ভৌত অবকাঠামো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল ও ক্রমবর্ধমান কর্মকান্ডের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ক্যাম্পাসে গড়ে তোলা প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর মধ্যে রয়েছে দুটি প্রশাসনিক ভবন, ৬টি অনুষদ কমপ্লেক্স, ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র কমপ্লেক্স, সম্প্রসারণ কমপ্লেক্স, ছাত্রছাত্রীদের জন্য ১০টি আবাসিক হল (ছাত্রীদের জন্য ১টিসহ), একটি দ্বিতল কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার (মোট বই সংখ্যা ১,৬৮,২৭৭ এবং চলতি জার্নাল সংখ্যা ৪০০), একটি আধুনিক মিলনায়তন (আসন সংখ্যা ২,০০০), একটি সম্মেলন হল, একটি জিমনেসিয়াম, একটি স্টেডিয়াম ও ক্রীড়া কমপ্লেক্স, একটি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, একটি প্রকল্প কমপ্লেক্স এবং শিক্ষক কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য ৬৫৭টি আবাসিক ইউনিট। ক্যাম্পাসে দুর্লভ উদ্ভিদসমূহের সংগ্রহসহ একটি ‘বোটানিক্যাল গার্ডেন’ রয়েছে। জাতীয় উদ্ভিদ সম্পদ রক্ষাকল্পে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফলজ উদ্ভিদের একটি বাগানও গড়ে তোলা হয়েছে। ক্যাম্পাসে একটি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণে একটি স্মৃতিসৌধ রয়েছে।
ছাত্রকল্যাণ বিভাগ ছাত্রছাত্রীদের কল্যাণ ও পরামর্শ প্রদান সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় দেখাশোনার জন্য একটি ছাত্রবিষয়ক বিভাগ আছে। এ বিভাগের অধীনে একটি ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (Teacher Student Centre/TSC) রয়েছে যা ছাত্র, শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রদের মধ্যে সম্প্রীতি বজায় রাখাসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনে সহায়তা দেয়।
সহায়ক কর্মিদল বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট ২,১৯৮ জন সহায়ক কর্মীর মধ্যে ২৩৭ জন কর্মকর্তাসহ আছেন তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির যথাক্রমে ৭১৮ ও ১,২৪৩ কর্মচারী। [মোহাম্মদ হোসেন]