বসু, বিনয়কৃষ্ণ
বসু, বিনয়কৃষ্ণ (১৯০৮-১৯৩০) যুগান্তর পার্টির একজন বিপ্লবী। ১৯০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর মুন্সিগঞ্জ জেলার রোহিতভোগ গ্রামের (রূপান্তরে রৌতভোগ বা রাইতভোগ) এক মধ্যবিত্ত কায়স্থ পরিবারে তাঁর জন্ম। বাবা প্রকৌশলী রেবতীমোহন বসু এবং মা ক্ষীরদাবাসিনী দেবী।
বিনয়ের প্রাথমিক শিক্ষা ঢাকাতেই শুরু হয় এবং তিনি মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা পাস করার পর মিটফোর্ড মেডিকেল স্কুলে (বর্তমান স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ) প্রবেশ করেন। তিনি যুবক বয়সেই ঢাকার সুপরিচিত বিপ্লবী হেমচন্দ্র ঘোষের দ্বারা প্রভাবিত হন এবং যুগান্তর পার্টির সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রক্ষাকারী একটি গুপ্ত সংগঠন ‘মুক্তি সংঘ’-এ যোগদান করেন। বিপ্লবী কর্মকান্ডের জন্য তাঁর মেডিকেল শিক্ষাজীবন অসমাপ্ত থেকে যায়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর হেমচন্দ্র কলকাতায় তাঁর বিপ্লবী কর্মকান্ড শুরু করেন। ১৯২৮ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে সুভাষচন্দ্র বসু মেজর সত্য গুপ্তের নেতৃত্বে ‘বঙ্গীয় স্বেচ্ছাসেবী’ নামে একটি দল গঠন করেন। সুভাষ নিজে এর জিওসি হন। বিনয় ও গ্রুপের অনুসারী তাঁর আরও কয়েকজন সহযোগী নতুন বিপ্লবী সংগঠনে যোগদান করেন। খুব শীঘ্রই তিনি গ্রুপের একজন একনিষ্ঠ কর্মী হয়ে ওঠেন এবং ঢাকায় বঙ্গীয় স্বেচ্ছাসেবী দলের আঞ্চলিক ইউনিট গঠন করেন। বঙ্গীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন খুব অল্প সময়ের মধ্যেই একটি কার্যকর বিপ্লবী সংগঠনে পরিণত হয় এবং বিশ শতকের ত্রিশের দশকের প্রথমদিকে সংগঠনটি ‘অপারেশন ফ্রিডম’ শুরু করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বাংলার বিভিন্ন কারাগারে পুলিশের অত্যাচারের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ প্রতিবাদ জানানোর জন্যই ঢাকার বঙ্গীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এরূপ অবস্থান নেয়।
মেডিক্যাল স্কুলের ছাত্রাবস্থায় বিনয়কৃষ্ণকে সংগঠন থেকে তাঁকে প্রথম শত্রুর ওপর আঘাত হানার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। ১৯৩০ সালের আগস্টে বিনয় জানতে পারেন যে, পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেল ল’ম্যান মেডিকেল স্কুল হাসপাতালে একজন চিকিৎসাধীন উর্দ্ধতন পুলিশ কর্মকর্তাকে দেখতে আসবেন। ১৯৩০-এর ২৯ আগস্ট বিনয় সাধারণ বাঙালি পোশাকে প্রহরা ভেদ করে হাসপাতালের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন এবং খুব কাছ থেকে ল’ম্যানকে গুলি করেন। ঘটনাস্থলেই ল’ম্যান এর মৃত্যু হয় এবং পুলিশের সুপারিন্টেন্ড হডসন মারাত্মকভাবে আহত হন। বিনয় পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে কলকাতায় দলের গোপন আস্তানায় পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। পুলিশ তল্লাশি শুরু করে এবং বিনয়ের মাথার দাম পাঁচ হাজার টাকা ঘোষণা করে। সুভাষ বোস এসময় তাঁকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিতে চাইলে তিনি তা দৃঢ়তার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেন।
অল্প কয়েকমাসের মধ্যেই বিনয় তাঁর দলবল সহ আবার সক্রিয় হয়ে ওঠেন। কারাগারের ইন্সপেক্টর জেনারেল কর্ণেল এন.এস সিম্পসন বন্দিদের উপর তাঁর অমানবিক অত্যাচারের জন্য বিপ্লবীদের চক্ষুশূলে পরিণত হন। বিপ্লবীরা শুধু তাঁকেই হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয় নি, সেই সঙ্গে সেক্রেটারিয়েট বিল্ডিং আক্রমণ করে ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করতে প্রয়াসী হয়। ১৯৩০ সালের ৮ ডিসেম্বর দীনেশ গুপ্ত এবং বাদল গুপ্ত সহ বিনয় ইউরোপীয় পোশাক পরে রাইটার্স বিল্ডিং-এ প্রবেশ করেন এবং সিমসনকে গুলি করে হত্যা করেন। নিষ্ঠুর কার্যকলাপের জন্য পরিচিত ট্যুইনাম, প্রেন্টিস, নেলসন প্রমুখ কয়েকজন কর্মকর্তা বিপ্লবিদের গুলিতে আহত হন।
অভিযানে সফল হলেও সঙ্গীসহ বিনয় ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যেতে পারেন নি। পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেল এবং পুলিশ কমিশনারের নেতৃত্বে পুলিশ বাহিনী তাঁদের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। তরুণ বিপ্লবীগণ কিছু সময়ের জন্য এই অসম যুদ্ধ চালিয়ে যান। পুলিশের হাতে আত্নসমর্পণ না করে বাদল পটাসিয়াম সায়ানাইড খেয়ে এবং বিনয় ও দীনেশ রিভলভারের গুলিতে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। বাদল সঙ্গে সঙ্গে মারা যান। আহত বিনয় ১৯৩০ সালের ১৩ ডিসেম্বর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। দীনেশ হাসপাতালে সুস্থ হয়ে উঠলেও বিচারে তাঁকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়। এভাবে বিনয় ও তাঁর বিপ্লবী সঙ্গীগণ আত্মোৎসর্গ করেন। তাঁদের নিষ্ঠাবোধ ও আত্মত্যাগ পরবর্তীকালে বাঙালি জাতির অনুপ্রেরণার উৎসে পরিণত হয়। [রাজশেখর বসু]
গ্রন্থপঞ্জি Hemendranath Dasgupta, Bharater Biplab Kahini, II and III, Calcutta, 1948; RC Mazumder, History of the Freedom Movement in India, III, Calcutta 1963; Ganganarayan Chandra, Abismaraniya, Calcutta, 1966.