গাজন
গাজন একটি লোকউৎসব। নিম্ন শ্রেণির লোকের মধ্যে এর প্রচলন অধিক। চৈত্র সংক্রান্তি থেকে শুরু করে আষাঢ়ী পূর্ণিমা পর্যন্ত সংক্রান্তি কিংবা পূর্ণিমা তিথিতে এ উৎসব উদযাপিত হয়। এর সঙ্গে বিভিন্ন পৌরাণিক ও লৌকিক দেবতার নাম সম্পৃক্ত, যেমন শিবের গাজন, ধর্মের গাজন, নীলের গাজন ইত্যাদি। তবে এ উৎসবের মূল লক্ষ্য সূর্য এবং তার পত্নীরূপে কল্পিত পৃথিবী। সূর্যের সঙ্গে পৃথিবীর বিবাহ দেওয়াই এ উৎসবের উদ্দেশ্য।
গাজন উৎসবের পেছনে কৃষক-সমাজের একটি সনাতন বিশ্বাস কাজ করে। চৈত্র থেকে বর্ষার প্রারম্ভ পর্যন্ত সূর্য যখন প্রচন্ড উত্তপ্ত থাকে তখন সূর্যের তেজ প্রশমন ও বৃষ্টি লাভের আশায় অতীতে কোনো এক সময় কৃষিজীবী সমাজ এ অনুষ্ঠানের উদ্ভাবন করেছিল। গ্রাম্য শিবমন্দিরকে কেন্দ্র করে এর আয়োজন চলে। যারা পূর্ব থেকে কোনো মানত করে এতে অংশগ্রহণ করে তাদের বলা হয় সন্ন্যাসী বা ভক্ত্যা। তারা হবিষ্যান্ন ভোজন করে এবং উতুরি (উত্তরীয়) ও একখন্ড বেত্র ধারণ করে। এভাবে তারা মন্দির প্রাঙ্গণে নানা প্রকার কৃচ্ছ্রসাধনের মাধ্যমে দেবতাকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করে। এসব কৃচ্ছ্রসাধনের মধ্যে রয়েছে তারকাটায় জিহবা ফোঁড়া, কাঁটার উপরে ঝাঁপ দেওয়া, আগুনের উপর দিয়ে হাঁটা ইত্যাদি।
চড়ক গাজন উৎসবের একটি প্রধান অঙ্গ। এ উপলক্ষে এক গ্রামের শিবতলা থেকে শোভাযাত্রা বের করে গ্রামান্তরের শিবতলায় নিয়ে যাওয়া হয়। একজন শিব ও একজন গৌরী সেজে নৃত্য করে এবং অন্যান্য ভক্ত্যারা নন্দী, ভৃঙ্গী, ভূতপ্রেত, দৈত্যদানব প্রভৃতি সেজে শিব-গৌরীর সঙ্গে সঙ্গে নাচে। এ সময় শিব সম্পর্কে নানা রকম লৌকিক ছড়া আবৃত্তি করা হয়, যাতে শিবের নিদ্রাভঙ্গ থেকে শুরু করে তাঁর বিয়ে, কৃষিকর্ম ইত্যাদি বিষয়ের উল্লেখ থাকে। এ অনুষ্ঠান সাধারণত তিন দিনব্যাপী চলে। চৈত্র সংক্রান্তির গাজন উপলক্ষে কোথাও কোথাও কালীনাচ হয়। অসুরবধ উপলক্ষে কালীর নৃত্য এর বিষয়। এটি বাংলার লোকনৃত্যের একটি বিশিষ্ট নিদর্শন। [দুলাল ভৌমিক]