নটর ডেম কলেজ
নটর ডেম কলেজ ১৯৪৯ সালে ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে হলিক্রস ফাদারগণ কর্তৃক ‘সেন্ট গ্রেগরি কলেজ’ নামে প্রথমে ক্যাথলিক কলেজ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৯৫০ সালে ৬১/১ সুভাষবোস এভিনিউ’র একটি ভবনে কলেজটি স্থানান্তরিত হয় এবং একটি পূর্ণাঙ্গ কলেজ হিসেবে কাজ শুরু করে। ১৯৫৪ সালে এটি মতিঝিলের বর্তমান স্থানে স্থানান্তরিত হয় এবং মা মেরির নামানুসারে এর নামকরণ করা হয় নটর ডেম কলেজ। পবিত্র ক্রুশ সন্ন্যাস সংঘের ফাদারদের নীতি ও আদর্শ দ্বারা কলেজটি পরিচালিত হয়।
এই প্রতিষ্ঠানটি রোমান ক্যাথলিকদের দ্বারা পরিচালিত এবং গরিব-ধনী, বাঙালি, আদিবাসী, হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ সকলের জন্য উন্মুক্ত। গত শতকের পঞ্চাশের দশকে স্কুল ফাইনাল পরীক্ষায় নটর ডেম কলেজের ছাত্ররা অত্যন্ত ভাল ফলাফল অর্জন করে। ১৯৫২ থেকে ১৯৫৯ সালের মধ্যে পরপর সাতবার নটর ডেম কলেজ উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট পরীক্ষার সম্মিলিত মেধা তালিকায় প্রথম স্থান অধিকার করে।
কলেজটি প্রথমে কলা এবং বাণিজ্য বিষয়ের ক্লাস চালু করেছিল। ১৯৫৫ সালে এ কলেজে ব্যাচেলর অব আর্টস এবং ১৯৬০ সালে ব্যাচেলর অব সায়েন্স কোর্স চালু হয়। ১৯৫৫ সালে নটর ডেম কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয় এবং ১৯৫৯ সালে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাসমূহে প্রসংশনীয় সাফল্যের জন্য এটি পূর্ব পাকিস্তানএর সেরা কলেজ হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করে।
শুরু থেকেই এ কলেজে দক্ষ ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকগণ কর্তৃক পাঠদান কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে। কিন্তু ১৯৬০ সালে এখানে শিক্ষক ঘাটতি দেখা দিলে ব্রিটিশ স্বেচ্ছাসেবী সার্ভিস (ব্রিটিশ ভলানটিয়ার্স সার্ভিস ওভারসিজ) নামের একটি ব্রিটিশ সংস্থার কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন এবং তাঁরা ১৯৬৩ থেকে ১৯৭০ সাল অবধি শিক্ষকতা করেন। এ সময়ই বিখ্যাত শিক্ষাবিদ ও গবেষক ফাদার টিম সরাসরি এ কলেজের সঙ্গে সংযুক্ত হন। ফাদার হেরিংটন ছিলেন কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ। শুরু থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ৯ জন ফাদার অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ফাদার বেঞ্জামিন কস্তা।
দেশের অন্যান্য কলেজের মতোই ১৯৬৮-৬৯ সময়কালে নটর ডেম কলেজও রাজনৈতিক আন্দোলনের ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে পড়ে এবং বিশেষভাবে দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের মাসগুলিতে কলেজ প্রশাসন এক নাজুক ও পীড়াদায়ক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়। নটর ডেম কলেজ সে সময় ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকান্ডে ব্যাপকভাবে জড়িয়ে পড়ে এবং এসময় কলেজের ছাত্র-শিক্ষকবৃন্দের সম্মিলিতভাবে কাজ করার ও পরস্পরের মধ্যে আদর্শ-মূল্যবোধ সঞ্চারের এক সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি হয়।
১৯৭২-১৯৯৭ সময়কালে কলেজে শিক্ষার মাধ্যম ছিল বাংলা এবং পরবর্তীকালে বাংলা বাধ্যতামূলক বিষয় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত থাকলেও এটি ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষাদান পুনঃপ্রবর্তন করে। ১৯৯২ সালে কলেজটি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয়। শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার পাশাপাশি স্বাস্থ্য সচেতন, বাস্তবমুখী, দায়িত্বশীল ও সৃজনশীল করার লক্ষ্যে ১৯টি ক্লাব রয়েছে। এগুলি হলো: ডিবেটিং ক্লাব, বিজ্ঞান ক্লাব, অ্যাডভেঞ্চার ক্লাব, রোভার দল, বিজনেস ক্লাব, চেস ক্লাব, মানবিক সংঘ, নেচার স্টাডি ক্লাব, ডিগ্রি ক্লাব, যুব রেডক্রিসেন্ট দল, রোটার্যাক্ট ক্লাব, নাট্যদল, আবৃত্তি দল, হিস্টোরি ক্লাব, এসোসিয়েশস ফর মেডিকেল হেল্ফ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল হেল্থ প্রমোশন, ইন্টারন্যাশনাল আন্ডারস্ট্যান্ডিং অ্যান্ড রিলেশন ক্লাব, সাংস্কৃতিক গোষ্ঠি, লেখককুঞ্জ এবং ইংলিশ ক্লাব। কলেজ থেকে বার্ষিক বু অ্যান্ড গোল্ড এবং দ্বিমাসিক ঢাক-ঢোল নামে দুটি পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশিত হয়।
ফলাফলের উপর ভিত্তি করে কলেজ বছরের সেরা ছাত্র, বিশেষ সম্মাননা, বিভিন্ন ক্লাবে সদস্যপদ এবং ক্লাসে শতভাগ উপস্থিতির জন্য সনদপত্র প্রদান করে। অনেক সময় ক্লাবের পক্ষ থেকেও বিশেষ ও গুরুত্বপূর্ণ কাজের স্বীকৃতি প্রদান করে। কলেজ বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবস উপলক্ষ্যে বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। খেলাধুলা, বিতর্ক প্রতিযোগিতায় কলেজের ছাত্ররা নিয়মিত অংশগ্রহণ করে। প্রতিবছর কলেজের ছাত্ররা বিজ্ঞান মেলার আয়োজন করে। ১৯৯৯ সালে কলেজটি ৫০ বছর পূর্ণ করেছে। এ উপলক্ষ্যে কলেজ বর্তমান ও পুরাতন ছাত্রদের নিয়ে সুবর্ণ জয়ন্তি উৎসবের আয়োজন করে। সুবর্ণ জয়ন্তিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য কলেজের প্রতিপালিকা মাতা মেরীর প্রতিকৃতি স্থাপন করা হয়। ২০০৯ সালে পালিত হয়েছে ৬০ বছর পূর্তি উৎসব।
স্বাধীন বাংলাদেশে নটর ডেম কলেজ উন্নত শিক্ষা ও ছাত্রদের চরিত্র গঠনের কাজ অব্যাহত রাখে এবং পরিবর্তিত পরিবেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেশকিছু পরিবর্তন ঘটায়। এ কলেজে একজন শিক্ষাবিষয়ক পরিচালক নিয়োগ এবং একটি সহায়তা ও পরামর্শ বিভাগ খোলা হয়। এ ব্যবস্থা ছাত্রদের সামাজিকভাবে সচেতন হতে উদ্বুদ্ধ করে। বস্তির শিশুদের শিক্ষার জন্য নটর ডেম কলেজের একটি কর্মসূচি রয়েছে। সমাজকল্যাণ বিষয়টিকে এই কলেজে একটি বিশেষ বিষয় হিসেবে দেখা হয় এবং সেইভাবেই শিক্ষা দেওয়া হয়। এখানে ছাত্রদের জন্য উপার্জনমুখী কাজেরও ব্যবস্থা রয়েছে, যেখানে কাজ করে প্রায় ১২৫ জন ছাত্র তাদের লেখাপড়া ও থাকার ব্যয় নির্বাহ করে। নটর ডেম কলেজের নিজস্ব ছোট ক্লিনিক রয়েছে। [বেঞ্জামিন কস্তা]