নজরুল একাডেমী
নজরুল একাডেমী কাজী নজরুল ইসলামের জীবন ও রচনাভিত্তিক একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান। ১৯৫৩ সালে করাচির প্রবাসী বাঙালিরা প্রথম এ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। ১৯৬১ সালে আমীর হোসেন চৌধুরীর ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় ‘আন্তর্জাতিক নজরুল ফোরাম’ নামে অপর একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। এ.কে ব্রোহী ছিলেন এর নির্বাহী পরিষদের সভাপতি এবং মিজানুর রহমান সম্পাদক। প্রতি বছর নজরুল-জয়ন্তী পালন এবং ইংরেজি ভাষায় দু’একটি পুস্তিকা প্রকাশ ছাড়া এ প্রতিষ্ঠান উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো কাজ করতে পারেনি।
১৯৬৪ সালে কবি তালিম হোসেন এবং অ্যাডভোকেট এ.কে.এম নূরুল ইসলাম (পরবর্তীকালে বিচারপতি এবং বাংলাদেশের ভাইস প্রেসিডেন্ট) ‘নজরুল একাডেমী’ প্রতিষ্ঠার একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তাঁদের উদ্যোগে ওই বছর ২৪ মে নূরুল ইসলামের ১১ নং র্যাংকিন স্ট্রিটের বাসভবনে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে প্রথম নজরুল-জন্মবার্ষিকী উদ্যাপিত হয়। এ অনুষ্ঠানেই নজরুল একাডেমী প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবটি আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত ও একটি সাংগঠনিক কমিটি গঠিত হয়। অ্যাডভোকেট নূরুল ইসলামের বাড়ির একটি কক্ষ একাডেমীর অস্থায়ী কার্যালয় হিসেবে ব্যবহূত হতে থাকে। এর চার বছর পর ১৯৬৮ সালের ২৪ মে ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে আয়োজিত এক সভায় পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী কাজী আনোয়ারুল হক নজরুল একাডেমীর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন।
১৯৬৭ সালের ২৭ আগস্ট সাংগঠনিক কমিটির এক সভায় একাডেমীর গঠনতন্ত্র প্রণীত হয় এবং তদনুযায়ী পরবর্তী সভায় নির্বাচনের মাধ্যমে একটি কার্যনির্বাহী কমিটি গঠন করা হয়। এ পরিষদের সভাপতি ছিলেন বিচারপতি আবদুল মওদুদ এবং সাধারণ সম্পাদক তালিম হোসেন। এক পর্যায়ে খান এ সবুরকে একাডেমীর প্রধান পৃষ্ঠপোষক নির্বাচন করা হয়।
আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যনির্বাহী পরিষদ গঠনের পর ১১৭নং আউটার সার্কুলার রোডে একটি দোতলা বাড়ি ভাড়া নিয়ে একাডেমীর কার্যক্রম শুরু হয়।কেন্দ্রীয় যোগাযোগ মন্ত্রী খান এ সবুরের প্রচেষ্টায় কতিপয় বেসরকারি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের দানে প্রাপ্ত প্রায় পনেরো হাজার টাকা মূলধন করে একাডেমী তার কর্মসূচি শুরু করে।
কয়েক মাসের মধ্যেই একাডেমী বার্ষিক পঁচিশ হাজার টাকা সরকারি অনুদানও লাভ করে।
প্রধানত যে তিনটি লক্ষ্য সামনে রেখে নজরুল একাডেমী প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেগুলি হলো: ১. বাংলার মুসলিম রেনেসাঁর অগ্রদূত হিসেবে নজরুলের ভূমিকাকে তুলে ধরা; ২. পাকিস্তানি জীবনাদর্শের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আধুনিক ও প্রগতিশীল ভাবধারার সকল উপাদানকে আত্মস্থ করা এবং ৩. মুসলিম ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারের ভিত্তিতে পাকিস্তানি সংস্কৃতির বিকাশ সাধন করা। এছাড়াও একাডেমীর উদ্দেশ্য ও কর্মসূচি হিসেবে অন্য যেসব বিষয় নির্ধারণ করা হয়, সেগুলি হলো: ১. নজরুলের সমগ্র রচনা ও জীবনীর উপকরণ সংগ্রহ, সংকলন, গবেষণা ও প্রকাশ করা; ২. নজরুলসঙ্গীতের বাণী ও সুর সংগ্রহ, সংকলন, স্বরলেখন ও প্রকাশ করা; ৩. নজরুলসঙ্গীতের চর্চা, প্রচার, প্রামাণ্য স্বরলিপি প্রণয়ন ও সংকলন এবং নতুন রেকডিং; ৪. সাহিত্য ও সঙ্গীতে নজরুলের সৃষ্টিসম্ভার অনুবাদ, সাংস্কৃতিক যোগাযোগ ও অন্যান্য মাধ্যমে দেশ-বিদেশে তুলে ধরা; ৫. নজরুলের সৃষ্টিসম্ভার মূল্যায়ন ও তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গবেষণা, চিন্তাধারা ও সৃষ্টিশীলতার নিয়মিত প্রকাশ-মাধ্যম হিসেবে একাডেমীর সাময়িকী প্রকাশ; ৬. বিশেষভাবে নজরুলের অবদানভিত্তিক এবং সাধারণভাবে দেশের সাহিত্য, শিল্প ও সংস্কৃতির ঐতিহ্যনির্ভর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের প্রগতিশীল বিকাশের উপযোগী কার্যক্রম গ্রহণ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদি পরিচালনা; ৭. একাডেমীর উদ্দেশ্য ও আদর্শের সহায়ক গ্রন্থাদি প্রণয়ন, প্রকাশ এবং এজন্য পূর্ণাঙ্গ মুদ্রণ ও প্রকাশনালয় প্রতিষ্ঠা; ৮. অধ্যয়ন, গবেষণা, প্রশিক্ষণ এবং সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে সুবিধা দানের জন্য পাঠাগার, বিদ্যালয় ও মিলনায়তন প্রতিষ্ঠা এবং ৯. একাডেমীর উদ্দেশ্য ও কার্যক্রমের সহায়ক অন্য যেকোনো কর্মসূচি গ্রহণ করা। এ দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে একাডেমী ১৯৬৮ সাল থেকে দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে শুরু করে। তার একটি হলো সঙ্গীত বিদ্যালয়, অপরটি শিশুদের জন্য কিন্ডারগার্টেন স্কুল। পরবর্তীকালে দেশের খ্যাতিমান প্রায় সকল নজরুলসঙ্গীত শিল্পী এ সঙ্গীত বিদ্যালয়ের সঙ্গে জড়িত হন।
প্রতিষ্ঠার পর থেকেই নজরুল একাডেমী তার মুখপত্র হিসেবে নজরুল একাডেমী পত্রিকা প্রকাশ করে আসছে। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পত্রিকার এগারটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। নজরুল-বিষয়ক গবেষণামূলক প্রবন্ধ ছাড়াও জাতীয় সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক প্রবন্ধও এ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৯৭১-এর পর পত্রিকাটির প্রকাশনা অনিয়মিত হলেও এখনও টিকে আছে। বিভিন্ন সময়ে আকবরউদ্দীন, শাহাবুদ্দীন আহমদ প্রমুখ এর সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন। পত্রিকা প্রকাশের পাশাপাশি নজরুলগীতি সংগ্রহ, তার স্বরলিপি তৈরি ও প্রকাশের কাজও চলছে।
বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি সঙ্গীত-শিক্ষাদান কার্যক্রমে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। তবে নজরুল-সংক্রান্ত মূল্যবান দলিলপত্র, গ্রামোফোন রেকর্ড এবং নজরুলসঙ্গীতের বাণী ও সুর সংগ্রহের কাজ অব্যাহত রয়েছে। এসবের কিছু কিছু ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিতও হচ্ছে। বাংলাদেশে নজরুল-গবেষণার ক্ষেত্রে নজরুল একাডেমী পথিকৃতের ভূমিকা পালন করছে। বর্তমানে একাডেমী নজরুলের জন্মজয়ন্তী ছাড়াও রবীন্দ্রনাথের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীসহ দেশের প্রতিটি জাতীয় অনুষ্ঠান সমান গুরুত্বের সঙ্গে পালন করছে। [মোহাম্মদ আবদুল হাই]