নওয়াজ, আলি
নওয়াজ, আলি (১৯২৬ত-২০০৫) শিক্ষাবিদ, গবেষক ও লেখক। জন্ম ১৯২৬ সালের ২৫শে ডিসেম্বর। জন্মস্থান কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলাধীন সাহেবাবাদ গ্রাম। পিতার নাম হাসান আলী।
শৈশবেই পিতৃহারা আলি নওয়াজের শিক্ষার হাতেখড়ি স্বগ্রামে অবস্থিত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। কুমিল্লার অন্যতম প্রাচীন বিদ্যাপীঠ বুড়িচং আনন্দ উচ্চ বিদ্যালয় হতে বৃত্তিসহ ম্যাট্রিকুলেশন এবং কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। একই কলেজ থেকে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন বাংলায় স্নাতক এবং ১৯৫১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একই বিষয়ে (বাংলা ভাষা ও সাহিত্য) কৃতিত্বের সঙ্গে এমএ ডিগ্রী লাভ করেন। এমএ পাস করার পর তিনি পাকিস্তার বিমান বাহিনীতে একমাত্র বাঙালি অফিসার হিসেবে যোগদান করেন। কিন্তু প্রতিকূল পরিবেশের কারণে উক্ত পদ থেকে তাঁকে ইস্তফা দিতে হয়েছে। ১৯৫২ সালে তিনি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে যোগদান করেন। ১৯৮০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে খনার বচনের ওপর অভিসন্দর্ভের জন্যে পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন। তিনি চীনের বেইজিং বিশ্ববিদ্যালয়ের বেইজিং ভাষা ইন্সটিটিউট হতে চীনা ভাষায় ডিপ্লোমা করেন (১৯৬৫-১৯৬৬)। সেসময়ে তিনি চীনা ছাত্রদেরকেও বাংলা শেখাতেন।
আলি নওয়াজ কর্মজীবন শুরু করেন তাঁর প্রিয় বিদ্যাপীঠ কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে অধ্যাপনার মাধ্যমে। পরে করাচী সেন্ট্রাল গভর্ণমেন্ট কলেজে সহকারী অধ্যাপক এবং করাচী বিশ্ববিদ্যালয়ে খন্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে দীর্ঘ ছয় বছর অধ্যাপনা করেন। ১৯৬২ সালে তিনি অধ্যাপনার কাজে যোগদান করেন ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। সেখানে বিভাগীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় তিনি পাকিস্তানের লায়ালপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ঊর্দু সেল্-এর আদলে বাংলা সেল্-এর প্রচলন করেন এবং এর পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এসময় তিনি গারো উপজাতিদের সংস্কৃতি ও জীবনধারা বিষয়ে গবেষণা করেন পরে তাঁর গবেষণামূলক প্রবন্ধগুলো আন্তর্জাতিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তাছাড়াও তিনি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সেমিনারে বক্তব্য রাখেন। তিনি মৌলবিজ্ঞান ও ভাষা অনুষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। ১৯৭০ সালের রাজনৈতিক অরাজকতার সময় তিনি সক্রিয় ভুমিকা পালন করেন। এসময় তিনি সৈয়দ নজরুল ইসলাম (উপরাষ্ট্রপতি), সৈয়দ আবদুস সুলতান (যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের হাই কমিশনার) ও মনোরঞ্জন ধর (মন্ত্রী) এর ঘনিষ্ঠ সাহচর্যে আসেন। তাছাড়া তিনি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর অন্যতম ঘনিষ্ঠ একজন ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি মংমনসিংহ হতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং যুদ্ধের স্বপক্ষে গ্রামে গ্রামে বক্তৃতা করেন। এ জেলার আল-বদর, আল-শামস হত্যা তালিকায় তাঁর নাম তৃতীয় স্থনে রয়েছে। ১৯৮৭ সালে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি অবসর গ্রহণ করেন।
অবসর গ্রহণের অব্যবহিত পর আলি নওয়াজ ভূমি মন্ত্রণালয়াধীন ভূমিসংস্কার সেলের উপদেষ্টা হিসেবে যোগদান করেন। ভূমি মন্ত্রণালয়ে থাকাকালে তিনি বাংলাদেশের ভূমিব্যবস্থা ও ভূমিসংস্কারের ওপর ব্যাপক গবেষণামূলক কাজ করেন।
কবিতা, গান, প্রবন্ধ ও গবেষণাসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রায় ২৫টি গ্রন্থ-প্রণেতা আলি নওয়াজ সাহিত্য ক্ষেত্রে অবদানের জন্যে পশ্চিমবঙ্গ থেকে সম্মানসূচক ডি এস সি ডিগ্রী অর্জন করেন এবং ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট পার্লামেন্ট (দিল্লি) থেকে ’বাংলাদেশ সাহিত্য উন্নয়ন রত্ন’ উপাধিতে ভূষিত হন। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের সমৃদ্ধির জন্যে তিনি ভূমিসংস্কার ও খনার বচনের ওপর গবেষণা করেন। তাঁর যুগান্তকারী গবেষণাগ্রন্থ বাংলাদেশের ভূমি-ব্যবস্থা ও ভূমি-সংস্কার (ঐতিহাসিক পর্যালোচনা)-এর জন্যে তিনি ২০০৪ সালে এশিয়াটিক সোসাইটি অব্ বাংলাদেশ থেকে ’জাস্টিস্ মুহাম্মদ ইব্রাহিম গোল্ড মেডেল ২০০২’ লাভ করেন। খনার বচনের ওপর তাঁর পিএইচডি গবেষণাকর্মটি বর্ধিত কলেবরে খনার বচন ও কৃষি এবং খনার বচন, কৃষি ও বাংগালী সংস্কৃতি নামে দুটো গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। খনার বচন, কৃষি ও কৃষ্টি তাঁর সর্বশেষ প্রকাশিত গবেষণাগ্রন্থহ।
আলি নওয়াজ জীবনের শেষ প্রান্তে কাজ করছিলেন বাংলা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় ভাষায় সমউপাদান এবং এর নৃতাত্বিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে। কিন্তু কাজটি শেষ হওয়ার আগেই ২০০৫ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি হূদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তিনি ইন্তেকাল করেন। [জাহাঙ্গীর আলম]