ধামাইল গান
ধামাইল গান ধামাইল (ধামালী) মূলত নারীদের আচারকেন্দ্রিক নাচ-গান। সিলেট ও ময়মনসিংহ জেলায় হিন্দু মেয়েরা ব্রত, পালা-পার্বণ ধর্মীয় অনুষ্ঠানে এবং জন্ম, বিবাহ প্রভৃতি সামাজিক উৎসবে ঘটা করে ধামাইল নাচ-গান করে থাকে। বাড়ির খোলা আঙ্গিনায় বিশ-পঁচিশ জন নারী গোল হয়ে দাঁড়িয়ে এরূপ কৃত্যানুষ্ঠান প্রদর্শন করে। সুরের দিক থেকে ভাটিয়ালি ঠাটের অন্তর্গত হলেও এতে দীর্ঘ টান বা মীড়ের দোলা নেই। করতালি দ্বারা গানের তাল রক্ষা করা হয়, স্বতন্ত্র বাদ্যযন্ত্রের প্রয়োজন হয় না। নাচের পদক্ষেপে বিশিষ্টতা আছে- সামনে মাথা নিচু করে ও উপরে মাথা তুলে ঝুঁকে পর্যায়ক্রমে করতালি দেওয়া হয়। সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় করতালিকে ‘থাপরি’ বলে। করতালির সাথে সমতা রেখে সামনে ও পেছনে পদক্ষেপ বদল করে বৃত্তাকার ঘুর্ণনে নাচতে হয়।
পেছনের পায়ের সম্মুখভাগ মাত্র মাটি স্পর্শ করে, গোড়ালি থাকে উপরে; এভাবে পর্যায়ক্রমে ডান ও বাম পায়ের বদল ঘটাতে হয়। ধামালী রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক আদিরসাত্মক গান। গানের নমুনা:
(১) যমুনা পুলিনে শ্যাম নাগর ত্রিভঙ্গ,
এমন মধুর মুরলী ধনি দহিতেছে অঙ্গ।
আয় ললিতে, আয় বিশাখে/শ্যামকে এনে দে।
যায় যদি রাইর কুলমান পাই যদি তারে,
আমার মন হইয়াছে উড়াল পাখী/ প্রাণে প্রেম তরঙ্গ \
এটি রাধাকৃষ্ণবিষয়ক কথোপকথনমূলক লোকগীতি। একে ‘কৃষ্ণ ধামাইল’ বলে। রাধাকৃষ্ণের প্রেম ছাড়া পার্থিব বিষয় নিয়েও ধামাইল গানের প্রচলন আছে। একে ‘লৌকিক ধামাইল’ বলে।
(২) আজ কেন রে যৈবন তুই
মিছে পাগল করিস রে, হায়।
ধোপ কাপড়ে কালির ফোঁটা, মাধব
যাবে যৌবন, রবে খোঁটা।...
আড়ায় যেমন ময়না রে পোষে,
ও মাধব, ছুটে গেলি আর না আসে।
আড়ায় যেমন ময়না রে পাখী,
ও মাধব, তাই দেখি প্রাণ বেঁধে রাখি\- ফরিদপুর
উত্তরবঙ্গে ঘটনার বর্ণনা, পাত্র-পাত্রীর আলাপচারিতা, উক্তি-প্রত্যুক্তি সম্বলিত লৌকিক ধারার ধামালী গান আজও প্রচলিত আছে।
ধামাইল প্রাচীন ধারার লোকসংগীত। পন্ডিতগণ মনে করেন যে, চৌদ্দ শতকের কবি বড়ু চন্ডীদাস লোক-প্রচলিত ধামালী ও ঝুমুর গানের আঙ্গিক থেকে প্রেরণা লাভ করে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ রচনা করেন। রঙ্গ-কৌতুক বা চাতুরী অর্থে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে ধামালী শব্দের ব্যবহার আছে।- ‘ধামালী বুলিতে কাহ্নে দিহলি আস।/ বাসলী শিরে বন্দী গাইল চন্ডীদাস\’ (দানখন্ড) ষোল শতকে দৌলত উজির বাহরাম খানের ‘লায়লী-মজনু’ কাব্যে নাচ-গান অর্থে ‘ধামাল’ শব্দের ব্যবহার আছে- ‘বালেমু সুবদনী/ দোহঁ মিলি নিরজনি/ খেলত রঙ্গে ধামাল।’ (পৃ.৯৮) সতেরো শতকে কাজী দৌলত ‘সতীময়না লোর-চন্দ্রানী’ কাব্যে একই অর্থে ‘ধামারী’ শব্দের ব্যবহার করেছেন- ‘খেলায় বঁধুর সনে প্রেমের ধামারী।’ (পৃ. ১১৭) এসব উক্তি ধামালী গান-নাচের প্রাচীনতা ও জনপ্রিয়তাকে সূচিত করে। [ওয়াকিল আহমেদ]