দাসী, বিনোদিনী
দাসী, বিনোদিনী (আনু. ১৮৬০-১৯৪১) অভিনেত্রী, গায়িকা। জন্ম কলকাতায়। তিনি যেখানে জন্মগ্রহণ করেন সেখানে প্রধানত যৌনকর্মীরা বাস করতেন। তাঁর পরিবার দরিদ্র এবং সম্ভবত যৌনকর্মে জড়িত ছিল। তিনি তাঁর আত্মজীবনীতে নিজেকে বারবার বারবণিতা বলে উল্লেখ করেন। পাঁচ বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয় কিন্তু স্বামীর সঙ্গে তাঁর তেমন কোনো যোগাযোগ ছিল না। ওই সময় তিনি তিনজনের রক্ষিতা ছিলেন। এঁদের মধ্যে শেষ জন তাঁকে ২৯ বছর আশ্রয় দিয়েছিলেন। রক্ষিতা রাখা ছিল ওই যুগে এক সাধারণ ব্যাপার।
তিনি উনিশ শতকের বিখ্যাত অভিনেত্রী হিসেবে পরিচিত। ১৮৭৪ সালের ডিসেম্বরে গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারে তিনি চৌদ্দ বছর বয়সে ‘দ্রোপদী’ নামে ছোট একটি চরিত্রে প্রথম অভিনয় করেন। এ থিয়েটারে তিনি ছয় বছর কাজ করেন। পাশাপাশি স্বল্প সময়ের জন্য তিনি বেঙ্গল থিয়েটারেও অভিনয় করেন। এ থিয়েটারে ছিলেন বিখ্যাত অভিনেতা ও নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষ, যাঁকে তিনি নিজের গুরু এবং দেবতা বলে আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেন। তাঁর কাছেই তিনি উঁচুমানসম্পন্ন অভিনয়কলা শেখেন এবং তাঁকে নিয়েই ১৮৮৩ সালের গোড়ার দিকে স্টার থিয়েটার স্থাপন করেন। এ জন্যে তাঁকে অসাধারণ ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। রক্ষিতা হিসেবে তিনি বিনোদিনী দাসীকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন।কিন্তু স্টার থিয়েটার গড়ে তোলার জন্যে যিনি অর্থ দিয়েছিলেন, নিজের প্রেমিককে ছেড়ে বিনোদিনীকে তাঁর রক্ষিতা হতে হয়।
এ অবস্থায় গিরিশচন্দ্রসহ তাঁর সহকর্মীদের বিরোধিতার মুখে উক্ত থিয়েটারে বিনোদিনীর পক্ষে তিন বছরের বেশি সময় কাজ করা সম্ভব হয়নি।
স্টার থিয়েটারে কাজ করার সময় তিনি খ্যাতির তুঙ্গে। উনিশ শতকের হিন্দু ধর্মীয় নেতাদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত রামকৃষ্ণ পরমহংস চৈতন্যলীলা নাটকে চৈতন্যদেবের ভূমিকায় বিনোদিনীর অভিনয় দেখার জন্যে ১৮৮৫ সালের ৭ অক্টোবর এ থিয়েটারে আসেন। তিনি এ নাটকে বিনোদিনীর অভিনয় দেখে মুগ্ধ হন এবং অভিনয় শেষে মঞ্চের পেছনে গিয়ে বিনোদিনীর অভিনয়ের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে তাঁকে আশীর্বাদ করেন। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও এ থিয়েটারে তাঁর অভিনয় দেখতে এসেছিলেন এবং তাঁর অভিনয়ের ভূয়সী প্রশংসা করেন। স্বামী বিবেকানন্দও তাঁর অভিনয়ের খুব প্রশংসা করেন। বিখ্যাত ব্যক্তিগণ কর্তৃক বিনোদিনীর অভিনয়ের প্রশংসাই নারীদের রঙ্গমঞ্চে অংশগ্রহণকে সমাজের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলে। এর আগে শিক্ষিত লোকেরা, এমনকি, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো নারীদরদী ব্যক্তিরাও ‘বেশ্যাদের’ থিয়েটারে যোগ দেওয়াকে নিন্দা করতেন।
বিনোদিনী পঞ্চাশটিরও বেশি নাটকে নববইটি চরিত্রে অভিনয় করেন এবং নারীদের অভিনয়কে সমাজের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলেন। তাঁর অভিনয়ের মাধ্যমেই বাংলা থিয়েটারের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে মাত্র পঁচিশ/ছাবিবশ বছর বয়সে তিনি অভিনয় ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। পরে বঙ্গদেশে যখন গ্রামোফোন রেকর্ড চালু হয়, তখন গায়িকা হিসেবে তাঁর দ্বিতীয়বারের মতো আর্বিভাব ঘটে।
বিনোদিনী আমার কথা নামে একটি আত্মজীবনী প্রকাশ করেন ১৯১২ সালে। এতে তিনি নিঃসংকোচে নিজের জীবনকে তুলে ধরেন। তাঁর প্রতি পুরুষদের ভালোবাসা, ঘৃণা, বিশ্বাসঘাতকতা, সর্বোপরি তাঁকে তারা কীভাবে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছেন, আত্মজীবনীতে তিনি তার বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি তাঁর এ আত্মজীবনী লেখেন সহজ, সরল এবং সাবলীল ভঙ্গিতে। তাঁর এ গ্রন্থ বাংলা আত্মজীবনীর ইতিহাসে বিশিষ্ট স্থান জুড়ে আছে। [গোলাম মুরশিদ]