তারনাথ, লামা

Mukbil (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ১০:০৩, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

তারনাথ, লামা তিববতী সন্ন্যাসী। History of Buddhism in India (Gya-gar-chos-‘byun) গ্রন্থের জন্য তিনি বিখ্যাত। তিববতী বিবরণীতে তাঁকে ‘Jo-nan’ তারনাথ অথবা ‘Jo-nan’ সম্প্রদায়ের rje-btsun (ভট্টারক) তারনাথ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। Jo-nan হচ্ছে Tashi-Iun-Po-এর প্রায় একশত মাইল উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত একটি স্থানের নাম এবং এটি ছিল কালচক্রতন্ত্রের প্রতি উৎসাহী বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের (Jo-nan-pa sect) শক্ত ঘাঁটি। তারনাথ ছিলেন সম্প্রদায়ের নেতা এবং কালচক্র মতবাদের ওপর কয়েকটি পথনির্দেশক গ্রন্থের রচয়িতা।

তারনাথ ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আসল নাম ছিল kun-dag’-snin-po, যার অর্থ আনন্দগর্ভ। ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে চৌত্রিশ বছর বয়সে তিনি তাঁর ইতিহাস গ্রন্থ রচনা করেন। তারনাথ স্বয়ং তাঁর গ্রন্থের জন্য একটি সংক্ষিপ্ত নাম চয়ন করেন, dgos-dod-kun-byun’, যার শাব্দিক অর্থ হচ্ছে ‘যা সকল ইচ্ছা পূর্ণ করে’। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত বিকৃত ভারতীয় সংস্করণের প্রচ্ছদ পৃষ্ঠায় মুদ্রিত ‘কার্য-কাম-সর্ব-প্রবৃত্তি-নামা’ ঐ একই ধারণা প্রকাশ করে। সুতরাং তারনাথের জন্য এ গ্র্রন্থটি একটি সাধারণ ইতিহাসের চেয়েও অধিক কিছু ছিল, অধিকন্তু এতে বৌদ্ধধর্মের মাহাত্ম্যও ছিল, যা সকল ইচ্ছা পূরণের দিকে নিয়ে যায়।

১৪৩ ফোলিও সংবলিত তিববতী ভাষায় রচিত তারনাথের ভারতে বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাস (History of Buddhism in India) তাঁর সমগ্র রচনাবলির ষোল খন্ডে স্থান লাভ করেছে। প্রথম খন্ডে রয়েছে ৩৩১ ফোলিও বিশিষ্ট আত্মজীবনী এবং দ্বিতীয় খন্ডে রয়েছে ২২ ফোলিও বিশিষ্ট কালচক্র  প্রথার ইতিহাস। দ্বাদশ খন্ডে ২০ ফোলিওতে ‘তারা’ মতবাদের ধর্ম বিশ্বাসের ইতিহাস রয়েছে।

তারনাথের বৌদ্ধধর্মের বিবরণ মূলত লোককাহিনী নির্ভর হওয়া সত্ত্বেও প্রাচীন ও মধ্য যুগের ইতিহাস ও সংস্কৃতির বিভিন্ন দিক অনুসন্ধানকারী আধুনিক পন্ডিতগণ একে উপকারী বলে মনে করেন। অদ্ভুত গল্পের  সঙ্গে তারনাথ তাঁর রচনায় বিস্ময়কর পরিমাণে ঐতিহাসিক তথ্য এবং কৌতূহলোদ্দীপক ভারতীয় লোককাহিনী সন্নিবেশিত করেছেন, যা অন্যান্য উৎসসমূহে সহজলভ্য নয়। এ ইতিহাস রচনার উদ্দেশ্য ছিল আর্যদেশে কিভাবে ‘সত্যধর্ম’ প্রসার লাভ করেছিল তার বিবরণ প্রদান করা। অজাতশত্রুর রাজত্বকাল থেকে তের শতকে তুর্কীদের আক্রমণ পর্যন্ত সময়ের বর্ণনা বিধৃত হয়েছে। এ বিবরণটি ধারাবাহিকও নয় এবং এতে কোন বৈজ্ঞানিক নিয়মও অনুসৃত হয় নি। বাংলায় পাল রাজাদের  উত্থান এবং কতিপয় পালরাজা সম্পর্কে তাঁর বিবরণ লোককাহিনী ভিত্তিক তথ্যাদির মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। তিনি পূর্ববঙ্গের চন্দ্র রাজাদের সম্পর্কেও তথ্যাদি প্রদান করেছেন, যদিও তাঁদের নাম ও কালানুক্রম লিপি উৎসে প্রাপ্ত তথ্য হতে ভিন্নতর। তথাপিও দেখা যায় যে, অনেক ক্ষেত্রেই তিনি অপরাপর প্রামাণিক সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যাদির সমর্থনমূলক তথ্য সরবরাহ করেছেন। বিক্রমশীলা মহাবিহার এবং এর অধ্যাপকমন্ডলী সম্পর্কে তাঁর বিবরণ কৌতূহলোদ্দীপক। তারনাথের রচনা পূর্ণ ইতিহাস হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়। এটি বড়জোর একটি খসড়া, প্রয়োজনরয়েছে আরও ব্যাপক অনুসন্ধানের। হিউয়েন-সাং-এর ভ্রমণ এবং ভারতে বৌদ্ধধর্মের বাস্তব অবলুপ্তির অন্তর্বর্তী সময়ের বর্ণনা সংবলিত অধ্যায়গুলির  মধ্যেই রয়েছে এ গ্রন্থের বিশেষ গুরুত্ব।

বৌদ্ধধর্মের উৎপত্তিস্থলে এর অবনতি সম্পর্কে তাঁর পর্যবেক্ষণমূলক আলোচনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বৌদ্ধধর্মের সর্বশেষ পর্যায় সম্পর্কে তারনাথ বিস্তারিত বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন, যে সময়ে এ ধর্ম প্রায় সম্পূর্ণরূপে ঐসব বিশ্বাস ও অনুষ্ঠানসমূহের কাছে আত্মসমর্পন করেছিল যে সবকে বাতিল করে বুদ্ধ স্বয়ং তার মৌলিক ধর্মীয় আদর্শ প্রচার করেছিলেন। প্রচলিত হিন্দুধর্ম থেকে এ ধর্মের পার্থক্য নির্ণয় অসাধ্য হয়ে উঠেছিল। বৌদ্ধধর্ম প্রচলিত সর্বদেবতাবাদী, অধিকাংশ ক্ষেত্রে নতুন নামে, দেবদেবীর পূজা অর্চনার বিস্তারিত রূপ ধারণ করেছিল এবং সকল প্রকার ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানাদিতে লিপ্ত হয়েছিল, যেগুলি সম্পর্কে স্বয়ং বুদ্ধ ঘৃণা প্রকাশ করেছিলেন। তারনাথ উল্লেখ করেছেন যে, বিক্রমশীলা বিহারে একজন বলি-আচার্যেরও ব্যবস্থা করা হয়েছিল, কিংবা বুদ্ধজ্ঞানপদ রাজা ধর্মপালকে তাঁর বংশের দীর্ঘ  স্থায়ীত্বের জন্য নয় লক্ষ দুহাজার তোলা রূপা ব্যয় করে ’হোমা’ অনুষ্ঠান করতে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। একজন ধর্মপ্রাণ বৌদ্ধ তারনাথ এ ধর্মের সর্বশেষ পর্যায়ের মতবাদে পূর্ণ বিশ্বাসী ছিলেন এবং তাঁর কাছে পৃষ্ঠপোষকতার অভাব এ পরিণতির একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ বলে মনে হয়েছিল।

জার্মান (A Schiefner) এবং রূশ (VP Vasil’ev) ভাষায় তারনাথের ভারতে বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাস ১৮৬৯ সালে অনূদিত হয় ও তা সেন্ট পিটার্সবার্গ হতে প্রকাশিত হয়। লামা চিম্প এবং অলোক চট্টোপাধ্যায় বইটির সম্পূর্ণ ইংরেজি অনুবাদ করেন এবং দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় তা  ১৯৭০ সালে প্রকাশিত হয়।  [আবদুল মমিন চৌধুরী]