ঢাকা আহছানিয়া মিশন
ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন বাংলাদেশের একটি বেসরকারি সংস্থা এনজিও। ‘স্রষ্টার এবাদত ও সৃষ্টির সেবা’ লক্ষ্য নিয়ে ১৯৫৮ সালে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা এটি প্রতিষ্ঠা করেন। মিশনটি এখন দেশের বৃহৎ উন্নয়ন সংস্থাগুলির মধ্যে একটিতে পরিণত হয়েছে। এটি সমাজকল্যাণ পরিদফতরে একটি স্বেচ্ছাসেবামূলক সংস্থা হিসেবে নিবন্ধনকৃত।
আহ্ছানিয়া মিশন ৪টি বিভাগে উন্নয়নের জন্য কাজ করছে- শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জীবিকা ও মানবাধিকার এবং সামাজিক ন্যায়বিচার। গত তিন দশকে আহ্ছানিয়া মিশন যেসব ক্ষেত্রে সফলতা অর্জন করেছে তাহলো- অপ্রাতিষ্ঠানিক মৌলিক ও অব্যাহত শিক্ষা, কারিগরি শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন, লিঙ্গ উন্নয়ন, পরিবেশ উন্নয়ন ও সংরক্ষণ, শিশু অধিকার এবং শিশুশ্রম রোধ, ধূমপান ও মাদকাসক্ত এবং এইচআইভি/এইডস প্রতিরোধ, দারিদ্র বিমোচন, নিরাজদ পানি ও স্যানিটেশন, শিশু ও নারী পাচার রোধ, প্রশিক্ষণ, গবেষণা ইত্যাদি। ইতোমধ্যে মিশন জাতিসংঘের ইকোসোক (UN Economic and Social Council, ECOSOC) এর Consultative Status এবং ইউনোস্কের Operational Relations গ্রহণ করেছে।
ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন সাক্ষরতা ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রমের অধীনে প্রায় ৩.২ মিলিয়ন শিক্ষার্থীকে শিক্ষা প্রদান করে। মিশন বর্তমানে অব্যাহত শিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় সারা দেশে ১১৭০টি গণকেন্দ্র (কমিউনিটি ভিত্তিক শিক্ষা ও উন্নয়ন কেন্দ্র) পরিচালনা করছে। প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের আওতায় মিশন এ পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারসহ দেশে কর্মরত বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার ১,০১,১৮৬ জনকে সাক্ষরতা ও উন্নয়ন কর্মবিষয়ক প্রশিক্ষণ প্রদান করেছে। শিক্ষা উপকরণ উন্নয়নে আহ্ছানিয়া মিশন দেশের সর্ববৃহৎ বেসরকারি সংস্থা। মিশন এপর্যন্ত ২৭টি বিষয়ের ওপর গণশিক্ষা ও অব্যাহত শিক্ষা ক্ষেত্রে ২৬৩টি তথ্য, শিক্ষা ও যোগাযোগ সম্পর্কিত উপকরণ প্রণয়ন করেছে। বাংলাদেশের অধিকাংশ বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা এবং সরকারি প্রতিষ্ঠান পরিচালিত কার্যক্রমে এসকল উপকরণ ব্যবহূত হচ্ছে।
মিশন দরিদ্র মহিলাদের দারিদ্র্য-বিমোচনে এবং সার্বিকভাবে নারী উন্নয়নে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে এবং এ পর্যন্ত ১.৯ মিলিয়ন মহিলার শিক্ষা ও আর্থিক উন্নয়নে সরাসরি অংশ গ্রহণ করেছে। মিশন পানি ও স্যানিটেশন কার্যক্রমের আওতায় ৮টি উপকূলীয় জেলার ২৮টি উপজেলার ৩০০টি ইউনিয়নে ৭.৫ মিলিয়ন লোকের জন্য একটি বৃহদাকারের সেনিটেশন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে এবং আর্সেনিক মোকাবিলায় পানি পরীক্ষণে কাজ করে যাচ্ছে। অন্যদিকে পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়নে মিশন দেশের ৪৯টি জেলার ১০৭টি থানায় কাজ করছে। মিশন দেশে ক্যান্সার নির্ণয় ও চিকিৎসার জন্য ঢাকার মিরপুরে ৫০ শয্যা বিশিষ্ট আহ্ছানিয়া মিশন ক্যান্সার নির্ণয় ও চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপন করেছে। সরকার, করপোরেট শাখা ও জনসাধারণের অর্থায়নে মিশন ঢাকার উল্টরায় ৫০০ শয্যা বিশিষ্ট আর্ন্তজাতিক মানের ক্যান্সার ও সর্বজনীন হাসপাতাল নির্মাণের কাজ করছে।
মিশন বেসরকারি পর্যায়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ভিত্তিক দেশে আহ্ছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, বেসরকারি খাতে প্রথম খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজ স্থাপন, কর্মজীবী শিশু-কিশোরদের জন্য বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট ও আহ্ছানউল্লা ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজি এবং আহ্ছানিয়া মিশন কলেজ স্থাপন করে। মিশন সুফিবাদ চর্চার জন্য আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম নামে একটি প্রতিষ্ঠানও স্থাপন করে। মাদক দ্রব্যের মরণ নেশা থেকে দেশের যুবসমাজকে বাঁচানোর জন্য মিশন সারা দেশে তামাক ও তামাক জাতীয় দ্রব্যের কুফল ও এইচআইভি/এইডস সম্পর্কে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির কাজ করে যাচ্ছে। তাছাড়া এটি ধাত্রী প্রশিক্ষণ কার্যক্রম এবং তাদের প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যামূলক কর্মকান্ড পরিচালনা করছে।
বর্তমানে মিশন মাদকাসক্ত যুবকদের উন্নয়নের মূলধারায় পুনর্বাসনের জন্য ঢাকা, ময়মনসিংহ ও যশোরে ৪ টি মাদকের চিকিৎসা এবং পুনর্বাসন কেন্দ্র পরিচালনা করছে। নারী ও শিশু পাচার রোধে কাজ করছে। দেশের সীমান্তবর্তী ৬ টি জেলার ১৭ টি উপজেলায় এ কার্যক্রম বিস্তৃত। পাচার হতে উদ্ধারকৃত নারী ও শিশুদেরকে আশ্রয় এবং পুনর্বাসনের লক্ষ্যে মিশন যশোরে একটি ৪০ শয্যা বিশিষ্ট আশ্রয়গৃহ স্থাপন করেছে।
মিশন সামাজিক ব্যবসা হিসেবে হজ্জ্ব ফাইন্যান্স কোম্পানি, আহ্ছানিয়া মিশন বুক ডিস্ট্রিবিউশন হাউস (বইবাজার), বুটিক ফ্যাশন হাউস নাগরদোলা এবং আহ্ছানিয়া-মালয়েশিয়া হজ্জ্ব মিশন চালু করেছে।
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন ‘সবার জন্য শিক্ষা’সহ বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করছে। মিশন এ পর্যন্ত ৬৫টি আন্তর্জাতিক কর্মশালার মাধ্যমে এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক দেশের ৬৮০ জনশিক্ষা কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ দিতে সক্ষম হয়েছে।
দেশে-বিদেশে আহ্ছানিয়া মিশনের গৌরবোজ্জ্বল ও কৃতিত্বপূর্ণ কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ মিশন জাতিসংঘ এসক্যাপ-এর হিউম্যান রিসোর্স ডেভলোপমেন্ট অ্যাওয়ার্ড (১৯৯৪), ইউনেস্কোর এশিয়া প্যাসিফিক কালচারাল সেন্টার-জাপান (The Asia-Pacific Cultural Centre for UNESCO, ACCU) গ্রান্ড প্রাইজ (১৯৯৬), ইউনেস্কো আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা অ্যাওয়ার্ড (২০০৩), গ্লোবাল ডেভলোপমেন্ট নেটওয়ার্ক অ্যাওয়ার্ড (২০০৩) এবং আরব গল্ফ ফান্ড ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজ (২০০৪) লাভ করে। জাতীয় পর্যায়ে মিশন বাংলাদেশের সরকার কর্তৃক স্বাধীনতা পদক (২০০২) এবং ড. মুহম্মদ ইব্রাহিম স্মৃতি স্বর্ণ পদক (২০০৬) অর্জন করে।
এছাড়া মিশন নব্যসাক্ষরদের জন্য আমাদের পত্রিকা নামে একটি মাসিক দেয়াল ম্যাগাজিন, আলাপ নামে একটি মাসিক ম্যাগাজিন এবং মিশনবার্তা নামে একটি ত্রৈমাসিক পত্রিকা প্রকাশ করে। [কাজী রফিকুল আলম]