ঠাকুর, প্রিন্স দ্বারকানাথ
ঠাকুর, প্রিন্স দ্বারকানাথ (১৭৯৪-১৮৪৬) কলকাতার জোড়াসাঁকোর সুবিদিত ঠাকুর পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা এবং ব্যবসায় বিনিয়োগকারী ও উদ্যোক্তা। দ্বারকানাথ ঠাকুরের জীবনযাপন ছিল রাজসিক ও জাঁকজমকপূর্ণ। তাই ব্রিটেনে অবস্থানকালে তাঁর সমকালীনরা তাঁকে প্রিন্স নামে অভিহিত করেন এবং এভাবেই কলকাতায়ও তিনি প্রিন্স হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এর পিতা এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুর ছিলেন ওই সকল সমকালীন বানিয়া ও মুৎসুদ্দিদের (ইউরোপীয় বণিকদের প্রতিনিধি ও কর্মকর্তা) একজন যারা বাঙালি শিল্প-বাণিজ্যের উদ্যোক্তা ও সামাজিক-রাজনৈতিক কর্মযোগীদের প্রথম প্রজন্ম সৃষ্টি করেছিলেন। ঠাকুর পরিবারের যে ব্যক্তিটি প্রথমবারের মতো যশোরের পৈতৃক বাড়ি পরিত্যাগ করে ভাগ্যান্বেষণে কলকাতায় আসেন এবং ইউরোপীয় কোম্পানিতে বানিয়া হিসেবে যোগ দেন তাঁর নাম পঞ্চানন ঠাকুর। সতেরো শতকের শেষ দিকে তিনি ফরাসি কোম্পানিতে কাজ করেন।
সেকালের বাংলার অন্যান্য কুলীন ব্রাহ্মণ পরিবারের মতো ঠাকুর পরিবারও নিজেদের কুলীন ব্রাহ্মণ হিসেবে দাবি করেন। রাজা আদিশূর বেশ কয়েকটি ব্রাহ্মণ পরিবারকে কনৌজ থেকে আমন্ত্রণ জানান। ঠাকুর পরিবার নিজেদের তাদেরই উত্তরসূরি বলে দাবি করতেন। কিন্তু গবেষকদের মতে, তাঁরা ছিলেন স্থানীয় এবং অপেক্ষাকৃত নীচুবর্ণের ব্রাহ্মণ যাঁরা পীরালি ব্রাহ্মণ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। উঁচু বর্ণের ব্রাহ্মণদের সঙ্গে তাঁদের কোনোরকম সম্পর্ক ছিল না। ঠাকুর পরিবারের আদি প্রতিষ্ঠাতা জয়রাম ১৭৬০-৬২ খ্রিস্টাব্দে পর্যন্ত চবিবশ পরগনা জেলার একজন আমিন ছিলেন। তাঁর চারপুত্রের একজন নীলমণি (মৃ. ১৭৯১) ছিলেন চট্টগ্রাম জেলার সেরেস্তাদার। তিনি অগাধ অর্থবিত্তের অধিকারী হয়ে জয়রাম নির্মিত পাথুরিয়াঘাটার পৈতৃক বাড়ি ছেড়ে জোড়াসাঁকোয় এক সুরম্য ভবন নির্মাণ করে সেখানে বসবাস করেন। এ বাড়িতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জন্মগ্রহণ করেন ও বেড়ে ওঠেন। নীলমণির পুত্র রামলোচনও একজন ধনী বানিয়া ও বাণিজ্যপতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। তিনি অপুত্রক ছিলেন বলে ভ্রাতা রামমণি ঠাকুরের পুত্র দ্বারকানাথকে দত্তক পুত্ররূপে গ্রহণ করেন। তাঁদের পারিবারিক ঠাকুর উপাধিটি গোবিন্দপুর গ্রামের মৎস্যজীবী লোকদের দেওয়া। কারণ নিম্নবর্ণের এসব জেলেরা পাল-পার্বণে পীরালি ব্রাহ্মণগণের পৌরহিত্য লাভ করাকে সৌভাগ্য বলে মনে করত।
সে যুগের সামাজিক গতিচেতনা ও নবজাগরণে ঠাকুর পরিবার উদ্যোগীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে সমাজে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করতে সক্ষম হয়। এ পারিবারিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটেই কর্মযোগী দ্বারকানাথ ঠাকুরের আবির্ভাব। কয়েক পুরুষ ধরে উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণদের সঙ্গে শ্লথ সম্পর্ক এবং জ্ঞাতিকলহের কারণে মানসিকভাবে আহত দ্বারকানাথ ঠাকুর নিজের উদ্ভাবনাশক্তি ও আত্মমর্যাদাবোধে স্থিতধী হয়ে স্বাধীন বণিকবৃত্তিতে নিয়োজিত হন। বর্ণগত বৈষম্যের কারণে ঠাকুর পরিবারের কোনো সদস্য এমনকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পর্যন্ত কোনো কুলীন ব্রাহ্মণ পরিবারের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারেন নি।
রবার্ট গুটলার ফারগুসন নামক একজন ব্রিটিশ আইনজীবীর অধীনে শিক্ষানবিশ হিসেবে দ্বারকানাথ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সম্পর্কিত আইন এবং কলকাতা সুপ্রিম কোর্ট, সদর ও জেলা আদালতের যাবতীয় আইন ও কার্যপ্রণালী বিষয়ে অধ্যয়ন করেন। ১৮১৫ সালে তিনি সফলভাবে আইন ব্যবসা শুরু করেন। অচিরেই তিনি পিতা রামলোচনের নিকট থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত জমিদারির সীমানা প্রসারে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। ১৮৩০ সালে দ্বারকানাথ রাজশাহী জেলার কালীগ্রামের জমিদারি এবং ১৮৩৪ সালে পাবনার শাহজাদপুরের জমিদারি নিলামে ক্রয় করেন। তাঁর জমিদারিতে বেশ কিছু অংশীদার ও সহ-অংশীদার ছিলেন। কিন্তু তিনি বহরমপুর, পান্ডুয়া, কালীগ্রাম ও শাহজাদপুরে চারটি বড় জমিদারির মালিক ছিলেন এবং এগুলিতে তাঁর কোনো অংশীদার ছিল না। ১৮৪০ সালে সেগুলি তিনি তাঁর সন্তান ও তাঁদের উত্তরাধিকারীদের ট্রাস্ট করে দেন। দ্বারকানাথ ঠাকুরের জমিদারি পরিচালনার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল। তিনি এটিকে সামন্ততন্ত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখে মূলধনের সৃষ্টিশীল প্রসার হিসেবে বিবেচনা করেন। এক্ষেত্রে তিনি সমকালীন জমিদারদের চেয়ে ব্যতিক্রম ছিলেন। জমিদারি পরিচালনার জন্য তিনি কয়েকজন ইউরোপীয় বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করেছিলেন।
দ্বারকানাথের জীবনে সৌভাগ্যের অগ্রযাত্রা শুরু হয় ১৮২৮ সালে তাঁর সেরেস্তাদারের চাকরি লাভের মধ্য দিয়ে। পরবর্তী সময়ে লবণ ও আফিমের আবগারি বোর্ডে দীউয়ানের পদ লাভ করে তাঁর আরও উন্নতি হয়। দীউয়ান হিসেবে তিনি বারো বছর চাকরি করেন। চাকরির পাশাপাশি লবণ প্রস্ত্ততকারক ও অন্যান্যদের মধ্যে অর্থ লগ্নি করে তিনি মহাজনি ব্যবসায় যোগ দেন। তাঁর সহকর্মী ও সমসাময়িক ব্যক্তিবর্গ এ কাজটিকে প্রকারান্তরে উৎকোচ গ্রহণের শামিল বলে মনে করতেন। ঘটনাক্রমে একবার দ্বারকানাথকে এ জন্য অভিযুক্ত করা হয়। কিন্তু যথাযথ প্রমাণের অভাবে তিনি কোর্ট থেকে সসম্মানে অব্যাহতি লাভ করেন। মহাজনি ব্যবসা ছাড়াও তিনি বিখ্যাত ম্যাকিনটশ অ্যান্ড কোম্পানির সঙ্গে যৌথভাবে রপ্তানি বাণিজ্যে মূলধন বিনিয়োগ করেন। ১৮২৯ সালে প্রতিষ্ঠিত ইউনিয়ন ব্যাংক-এরও তিনি অংশীদার ছিলেন। জমিদারি পরিচালনাসহ দ্বারকানাথের এসব কর্মকান্ড কোম্পানির অধীনে চাকরি করার পাশাপাশি চলতে থাকে।
১৮৩৫ সালে সরকারের পক্ষ থেকে দ্বারকানাথকে সম্মানসূচক ‘জাস্টিস অব দি পীস’ পদ প্রদান করা হয়। তখন থেকেই এ পদটি প্রথমবারের মতো ভারতীয়দের জন্য চালু হয়। ১৮৪০ সালের মধ্যে দ্বারকানাথ তাঁর মূলধনি কারবারের সাফল্যের শিখরে উপনীত হন। তিনি জাহাজ ব্যবসা, রপ্তানি বাণিজ্য, বীমা, ব্যাংকিং, কয়লা খনি, নীলচাষ, শহরের গৃহায়ণ প্রকল্প এবং জমিদারি তালুকে অর্থ বিনিয়োগ করেন। তাঁর ব্যবসার তদারকি করার জন্য তিনি কয়েকজন ইউরোপীয় ম্যানেজার নিযুক্ত করেন।
ইউরোপীয় ও স্বদেশী বন্ধুদের উৎসাহে অনুপ্রাণিত হয়ে দ্বারকানাথ ঠাকুর তাঁর বন্ধু ও দার্শনিক রাজা রামমোহন রায় এর মতো ব্রিটেন যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১৮৪২ সালের ৯ জানুয়ারি তিনি নিজস্ব স্টিমার ‘দি ইন্ডিয়া’ যোগে সুয়েজের পথে যাত্রা করেন। তাঁর সফরসঙ্গী ছিলেন ইউরোপীয় চিকিৎসক ডা. ম্যাকগাওয়ান, তাঁর ভাগ্নে চন্দ্রমোহন চ্যাটার্জী, ব্যক্তিগত সহকারী পরমানন্দ মৈত্র, তিন জন হিন্দু ভৃত্য ও একজন মুসলমান বাবুর্চি। বিলেতে তাঁকে রাজকীয় সংবর্ধনা জ্ঞাপন করেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী রবার্ট পীল, বোর্ড অব কন্ট্রোলএর প্রেসিডেন্ট লর্ড ফিটজার্যাল্ড, প্রিন্স এলবার্ট, কেন্ট-এর রাজকুমারী এবং রানী ভিক্টোরিয়া। ২৩ জুন তিনি রানীর সঙ্গে রাজকীয় সৈন্যবাহিনী পরিদর্শন করে অতিবাহিত করেন। ৮ জুলাই রানী তাঁকে নৈশভোজে আপ্যায়ন করেন। দ্বারকানাথ সম্পর্কে রানী তাঁর ডায়রিতে লেখেন ‘ব্রাহ্মণ ভদ্রলোক বেশ ভাল ইংরেজি বলেন এবং তিনি একজন বুদ্ধিমান ও চমৎকার মানুষ’ (কুইন ভিক্টোরিয়া’স জার্নাল, জুলাই ৮, ১৮৪২)।
১৫ অক্টোবর দ্বারকানাথ ইংল্যান্ড থেকে প্যারিসে যান। ২৮ অক্টোবর ফ্রান্সের রাজা লুই ফিলিপ তাঁকে সেন্ট ক্লাউডে এক সংবর্ধনা দেন। ১৮৪২-এর ডিসেম্বরে তিনি কলকাতা প্রত্যাবর্তন করেন। উনিশ শতকের চল্লিশের দশকের গোড়ার দিকের ব্যবসায়িক মন্দা এবং দ্বারকানাথের নবলব্ধ আড়ম্বরপূর্ণ জীবনযাপন এ দু’য়ে মিলে তাঁর ব্যবসাক্ষেত্রে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ফলে তিনি অনেক ব্যক্তি ও কোম্পানির কাছে ঋণী হয়ে পড়েন। এ ঋণের বোঝা তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত ক্রমাগতভাবে বাড়তেই থাকে। পরিণামে তাঁর পুত্র দেবেন্দ্রনাথকে পিতার ঋণের দায় বহন করতে হয় এবং গোটা পরিবারকে দায়মুক্ত করতেই তাঁর সারাজীবন কেটে যায়। মহামন্দায় কেবল দ্বারকানাথই নন, আরও অনেক ব্যবসায়ীর জীবনে চরম বিপর্যয় নেমে আসে।
বস্ত্তত, ১৮৩০-৩৩-এর মহামন্দায় দ্বারকানাথের যেমন উত্থান ঘটে তেমন ১৮৪৫-৪৮-এ তিনি এর শিকারও হন। অবশ্য তাঁর শ্রেষ্ঠ সাফল্য নিহিত রয়েছে অন্যত্র। ব্যবসা-বাণিজ্যে ইউরোপীয়দের সঙ্গে সহযোগিতা চলে আসছিল দীর্ঘদিন ধরেই। কিন্তু দ্বারকানাথই প্রথম বাঙালি যিনি ইউরোপীয়দের সমকক্ষ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন। স্বীয় যোগ্যতাবলে ব্রিটিশ বণিকদের বাণিজ্য জগতে একজন সমান অংশীদার রূপে নিজের অবস্থান প্রতিষ্ঠা করে দ্বারকানাথ প্রচলিত নিয়মের ব্যত্যয় ঘটান। [সিরাজুল ইসলাম]
গ্রন্থপঞ্জি Blair B Kling, Partner in Empire: Dwarkanath Tagore and the Age of Enterprise in Eastern India, Calcutta, 1981; NK Sinha, The Economic History of Bengal 1793 – 1848, III, Calcutta, 1984.