ঝাউদিয়া মসজিদ
ঝাউদিয়া মসজিদ কুষ্টিয়া শহর থেকে প্রায় ২১ কিমি দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং কুষ্টিয়া ঝিনাইদহ মহাসড়ক থেকে প্রায় ৬.৫ কিমি সরাসরি পশ্চিমে অবস্থিত। এ মসজিদ এবং নিকটবর্তী ধ্বংসোন্মুখ একটি সমাধির কারণেই ঝাউদিয়া এলাকাটি বিশেষভাবে পরিচিত। স্থানীয় জনগণের বিশ্বাস এ মসজিদ ও সমাধি উক্ত সমাধিতে শায়িত জনৈক সুফী সাধকের কীর্তি। এ সাধকের নাম ও সময় জানা যায় না, কিন্তু হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে নিকটবর্তী এলাকার মানুষ বিশেষ করে শুক্রবারসহ প্রতিদিন এখানে সমবেত হয়ে তাঁর অনুকম্পা ও সহানুভূতি অর্জনের উদ্দেশ্যে বিশেষ প্রার্থনা করে।
মসজিদটির আমূল সংস্কার সাধন করা হয়েছে এবং এর পূর্বদিকে একটি বারান্দা সংযোজন করা হয়েছিল। সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এটি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছে। মসজিদটির আদিরূপ ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে পূর্বদিকের বারান্দাটি ভেঙে ফেলা হয়েছে এবং এতে অল্প কিছু সংস্কারও করা হয়েছে।
সম্পূর্ণ ইটের তৈরি এ মসজিদ একটি নিচু বাঁধানো প্লাটফর্মের পশ্চিম অর্ধাংশ জুড়ে বিস্তৃত। প্লাটফর্মের বাকি অংশ পলেস্তারায় আচ্ছাদিত এবং একে ঘিরে রয়েছে একটি নিচু দেওয়াল, যার ফলে এ অংশ একটি উন্মুক্ত অঙ্গনের রূপ নিয়েছে। বেষ্টনী প্রাচীরের পূর্ব দিকের মাঝ বরাবর একটি প্রবেশ তোরণ রয়েছে। অঙ্গনের বাইরের দিকের দুই কোণে রয়েছে গম্বুজ আচ্ছাদিত অষ্টভুজাকৃতির প্যাভিলিয়ন। এগুলির চারটি প্রধান দিকে রয়েছে উন্মুক্ত খিলানপথ।
গম্বুজ আচ্ছাদিত প্যাভিলিয়নগুলি ঢাকার সাতগম্বুজ মসজিদ ও দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট দুর্গের মসজিদ-এর চারকোণে নির্মিত গম্বুজ আচ্ছাদিত ফাঁপা পার্শ্ববুরুজের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। মূল মসজিদটির পরিকল্পনা আয়তাকার। বাইরে থেকে এর পরিমাপ ১৬.১৫ মি × ৬.১০ মি। পূর্ব দেওয়ালে রয়েছে তিনটি খিলানযুক্ত প্রবেশপথ যার সবগুলিই উন্মুক্ত হয়েছে একটি করে অর্ধগম্বুজ ভল্টের নিচে। উত্তর ও দক্ষিণ দেওয়ালেও একটি করে খিলানপথ ছিল, তবে বর্তমানে সেগুলিকে ইট দিয়ে তৈরি জালি নকশার সাহায্যে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কিবলা দেওয়ালে রয়েছে তিনটি অর্ধ অষ্টকোণাকৃতির মিহরাব। কেন্দ্রীয় মিহরাব ও পূর্ব দেওয়ালের কেন্দ্রীয় প্রবেশপথের বাইরের দিকে প্রচলিত রীতি অনুযায়ী রয়েছে দুপ্রান্তে ক্ষুদ্রাকৃতির মিনার (Turret) শোভিত আয়তাকার প্রক্ষেপণ। এ মিনারগুলি ছাদের বপ্র (Parapet) ছাড়িয়ে উপরে উঠে গেছে এবং এগুলির শীর্ষে রয়েছে কলস নকশার শীর্ষচূড়া (Finial) শোভিত ছোট ছোট ছত্রী। মসজিদের অভ্যন্তরভাগ পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত দুটি প্রশস্ত আড়খিলান (Transverse Arch) এর সাহায্যে তিনটি সমান বর্গাকার ‘বে’। প্রতিটি ‘বে’র উপরে রয়েছে একটি করে সামান্য কন্দাকৃতির গম্বুজ। প্রশস্ত আড়খিলানদুটি এবং মিহরাব ও প্রবেশপথগুলির উপর থেকে নির্মিত বন্ধ খিলান গম্বুজগুলির ভার অষ্টকোণাকৃতির ড্রাম (Drum) বহন করছে। এ পিপার উপর সরাসরি স্থাপিত গম্বুজগুলির শীর্ষে রয়েছে পদ্মকলস নকশার দৃষ্টিনন্দন শীর্ষচূড়া। বপ্র ছাড়িয়ে উঠে যাওয়া চারকোণের পার্শ্ববুরুজগুলির ভিত্তিতে রয়েছে কলস নকশা আর শীর্ষে কলস-নকশার শীর্ষ চূড়াশোভিত নিরেট ছত্রী।
পূর্বদিকের সম্মুখভাগে প্রবেশপথগুলির আয়তাকার ফ্রেমে রয়েছে গভীর আয়তাকার খোপ নকশা (Panel)। বপ্র এবং গম্বুজের পিপার বাইরের অংশ বদ্ধ পদ্ম-পাঁপড়ি নকশার সারি দিয়ে অলঙ্কৃত। মিহরাব ও প্রবেশপথের খিলানগুলির স্প্যান্ড্রিলে রয়েছে পলেস্তারার অলঙ্করণ যেখানে মোটিফ হিসেবে জ্যামিতিক নকশা, ছোট ছোট পুষ্পিত বৃক্ষলতা এবং পরস্পর সংযুক্ত প্যাঁচানো স্ক্রল পরিলক্ষিত হয়।
পরিকল্পনা, নির্মাণশৈলী ও অলঙ্করণের কিছু কিছু বৈশিষ্ট্যের আলোকে এ মসজিদের সঙ্গে দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট দুর্গের মসজিদ (১৭৪০-৪১ খ্রি.) এবং নোয়াখালীর বজরা মসজিদের (১৭৪১-৪২ খ্রি.) ঘনিষ্ঠ সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। এ মিলের কথা মনে রেখে অনুমান করা যায় যে, মসজিদটি সম্ভবত আঠারো শতকের মাঝামাঝি কোনো এক সময়ে নির্মিত হয়েছিল। [এম.এ বারি]