আরিফিল মসজিদ
আরিফিল মসজিদ ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলার সরাইল সদর উপজেলার প্রায় অর্ধ-কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থিত। মসজিদটি যে এলাকায় অবস্থিত সে এলাকাটি সুফি শাহ আরিফের স্মরণে আরিফিল নামে অভিহিত করা হয়। মসজিদটি বর্তমানে বেশ ভাল অবস্থায় সংরক্ষিত আছে। এটি এখন বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি সুরক্ষিত নিদর্শন।
সাগরদিঘি বলে কথিত একটি বড় পুকুরের দক্ষিণতীরে উঁচু একখন্ড জমির পশ্চিম প্রান্তে মসজিদটি নির্মিত। মসজিদটি আয়তাকার (২৪.৩৮ মি x ৯.৩০ মি); এর দেওয়ালগুলি প্রায় ১.৬০ মি পুরু। মসজিদের সম্মুখে পূর্বদিকে একটি বাঁধানো অঙ্গন আছে। অঙ্গনটি নিচু দেওয়াল দিয়ে ঘেরা এবং এর পূর্ব দিকে রয়েছে একটি আধুনিক প্রবেশপথ। চারটি প্রকান্ড অষ্টভুজাকৃতির বুরুজ, যা মসজিদের বাইরের চার কোণকে সুদৃঢ় করে অনুভূমিক বপ্রের অনেক উপরে উঠে গেছে এবং এর শীর্ষে রয়েছে কলসচূড়াসহ শিরাল ছোট গম্বুজ। এ মসজিদে পাঁচটি প্রবেশপথ আছে। এর তিনটি পূর্বদিকে এবং উত্তর ও দক্ষিণ দিকে একটি করে। পূর্বদিকের মাঝের প্রবেশ পথটি পার্শ্ববর্তী প্রবেশপথ দুটির চেয়ে বড়। এটি অর্ধগম্বুজাকৃতির খিলান ছাদের নিচে অভিক্ষিপ্ত ফাঁকাস্থানের মধ্যে ছিল। অবশিষ্ট প্রবেশপথগুলি ধারাবাহিক দুটি খিলান নিয়ে গঠিত এবং এ খিলান দুটির মধ্যবর্তী স্থান খিলান ছাদে আবৃত। পূর্বদিকের প্রবেশপথ বরাবর তিনটি অর্ধ-অষ্টভুজাকৃতির মিহরাবসহ পশ্চিম দেওয়াল অভ্যন্তরীণভাবে কুলুঙ্গিত করা হয়েছে। সবকটি মিহরাবের গভীরতা ও প্রশস্ততা সমান। কিন্তু শুধু মাঝের মিহরাবটি পেছনদিকে একটি আয়তাকার অভিক্ষেপ প্রদর্শন করছে। মাঝের মিহরাব ও মাঝের প্রবেশপথের এ অভিক্ষেপগুলি প্রান্তস্থিত শোভাময় বৃত্তাকারের ছোট বুরুজ দ্বারা চিহ্নিত। ভিত্তিতে কলস নকশা থাকায় এ ছোট বুরুজগুলি অনুভূমিক বপ্রের উপরে উঠে গেছে এবং এর শীর্ষে কলসচূড়াসহ ছোট গম্বুজগুলি শোভা পাচ্ছে।
মসজিদের অভ্যন্তরভাগ একটি বড় আয়তাকার কক্ষ নিয়ে গঠিত এবং দুটি চতুর্কেন্দ্রিক তেরছা খিলানের মাধ্যমে এটি তিনটি সমান ‘বে’তে বিভক্ত। মসজিদটির ছাদ প্রতিটি ‘বে’-র উপরে একটি করে নির্মিত মোট তিনটি গম্বুজ দ্বারা আচ্ছাদিত। গম্বুজগুলি সরাসরি অষ্টকোণাকার পিপার উপর স্থাপিত এবং এর শীর্ষভাগ চমৎকার প্রস্ফুটিত পদ্ম ও কলসচূড়া দ্বারা শোভিত। এ পিপাগুলির ভার নিচে পর্যায়ক্রমে তেরছা খিলান, মিহরাব ও প্রবেশপথগুলির উপর নির্মিত বদ্ধ খিলান এবং প্রতিটি ‘বে’-র উপরের কোণাগুলির উপর স্থাপিত ত্রিভুজাকৃতি পেন্ডেন্টিভসমূহ বহন করছিল। ইটের তৈরী এরূপ বিশালাকৃতির ইমারতটি বর্তমানে মসৃণভাবে আস্তর ও চুনকাম করা।
কিন্তু তা সত্ত্বেও এর আদি অলংকরণের অনেক কিছুই এখনও বিদ্যমান। কোণার বুরুজগুলি আলঙ্কারিক বন্ধনী দ্বারা কয়েকটি অংশে বিভক্ত। অনুভূমিক বপ্র এবং অষ্টভুজাকৃতির পিপাগুলির বাইরের দিকগুলি বদ্ধ মেরলোনের সারি ও অষ্টকোণাকার পিপার দ্বারা সজ্জিত। দেওয়ালগুলির বাইরের দিকটা সমান্তরাল ও খাড়াভাবে বিন্যস্ত আয়তাকার খোপ-নকশা দ্বারা কর্বুরিত করা। পূর্ব ফাসাদে উল্লম্ব খোপনকশাগুলি অভ্যন্তরে খাজসহ বদ্ধখিলান মটিফ ধারণ করে আছে।
বহু খাঁজবিশিষ্ট খিলানসহ সকল মিহরাবই কিছুটা অভিক্ষিপ্ত আয়তাকার ফ্রেমের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। এ ফ্রেমগুলি প্যাঁচানো লতা দ্বারা নকশাকৃত আর উপরের দিকটা বদ্ধ মেরলোনের সারি দ্বারা সজ্জিত। অভ্যন্তরে মাঝের প্রবেশপথ এবং উত্তর ও দক্ষিণ দেওয়ালের প্রবেশপথের ডান এবং বাম উভয় দিকেই গভীর খিলান চোরকুঠরি রয়েছে। গম্বুজগুলির পিপার অভ্যন্তরীণ ভিতসমূহ খিলান কুলুঙ্গির সারি দিয়ে সজ্জিত। অন্যদিকে প্রত্যেক গম্বুজের চূড়ায় অঙ্কন করা হয়েছে বড় এক সারি গোলাপ নকশা। মাঝের মিহরাবের কুলুঙ্গির অর্ধ-গম্বুজাকৃতির খিলান ছাদ ও মাঝের খিলানপথ চমৎকারভাবে পলেস্তারায় ‘মুকার্নাস’ কার্য দ্বারা সুশোভিত।
স্থানীয় জনশ্রুতি অনুযায়ী শাহ আরিফ নামে একজন দরবেশ এ মসজিদটি নির্মাণ করেন। কিন্তু সঠিকভাবে জানা যায় না যে, তিনি কান সময়ে এ অঞ্চলে য্রসিদ্ধ হন এবং এবং কখন তাঁর মৃত্যু হয় । দরবেশ অথবা নির্মাতা যিনিই হউন না কেন, মসজিদটি নকশায় এবং অন্যান্য নির্মাণ কৌশলাদিতে ঢাকার খাজা শাহবাজ মসজিদ এর সঙ্গে যথেষ্ট সাদৃশ্যপূর্ণ। এ জন্য নির্মাণ কৌশলাদির বিবেচনায় এ মসজিদ সতেরো শতকের শেষ ভাগে নির্মিত হয়েছিল বলে ধরে নেওয়া যায়। [এম.এ বারি]