ঘাটু গান
ঘাটু গান বিলুপ্তপ্রায় এক প্রকার লোকগীতি। ঘাটে ঘাটে নৌকা ভিড়িয়ে এ গান গাওয়া হয় বলে এর নাম হয়েছে ‘ঘাটের গান’ বা ‘ঘাটু গান’। নটীবেশে কিশোর বালক নৃত্যসহ এ গান পরিবেশন করে। রাধাকৃষ্ণের প্রণয়লীলা ও দৈনন্দিন জীবনের বিচিত্র ঘটনা ঘাটু গানের বিষয়বস্ত্ত।
ঘাটু গানের উৎপত্তি বিষয়ে বলা হয়, ষোল শতকের প্রথম দিকে শ্রীহট্টের আজমিরিগঞ্জ নিবাসী জনৈক বৈষ্ণবাচার্য শ্রীকৃষ্ণের প্রেমে বিবাগী হয়ে বিরহিণী রাধাবেশে কৃষ্ণের আগমন প্রতীক্ষায় দিনাতিপাত করতে থাকেন। ধীরে ধীরে তাঁর বহু শিষ্য গড়ে ওঠে। শিষ্যদের মধ্যে বালক-শিষ্যদের রাধার সখী সাজিয়ে তাদের নিয়ে নেচে নেচে বিরহ সঙ্গীত গাওয়া হতো। ক্রমে ক্রমে নারীবেশী এ বালক-শিষ্যরা ঘাটু নামে পরিচিত হয় এবং এদের নিয়েই গড়ে ওঠে ঘাটুর দল।
এক বা একাধিক সুদর্শন কিশোর ঘাটু আসরের কেন্দ্রীয় চরিত্র। এরা বংশপরম্পরায় ঘাটু গান গেয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। ঘাটুদের সুকণ্ঠের অধিকারী, অল্পবয়সী এবং লম্বাকেশী হতে হয়। এদের যুবতীসুলভ রূপ-লাবণ্য, পোশাক-পরিচ্ছদ, সুমধুর কণ্ঠ, অঙ্গভঙ্গি, নৃত্য প্রভৃতি দর্শক-শ্রোতাদের মুগ্ধ করে।
ঘাটু গানে রাধাকৃষ্ণের কাহিনী থাকলেও এতে সম্পূর্ণ ধর্মীয় প্রভাবমুক্ত লৌকিক ও আদিরসেরই প্রাধান্য থাকে। প্রধানত বর্ষা মৌসুমে যখন নদী-নালা, খাল-বিল পানিতে ভরা থাকে তখন নৌকায় ঘাটু গানের আসর বসে। এ নৌকা গ্রামের ঘাটে ঘাটে ভিড়িয়ে গান শোনানো হয়। বর্তমানে লোকালয়েও ঘাটু গানের আসর বসে। অনেক সময় এক সঙ্গে একাধিক দলেরও আসর বসে। তাদের মধ্যে বিশেষ করে রাধাকৃষ্ণের বিভিন্ন দিক নিয়ে প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে গানের প্রতিযোগিতা চলে। অনুষ্ঠান শেষে বিচারক বিজয়ী দলের নাম ঘোষণা করেন।
ঘাটু দলের প্রধান অর্থাৎ মূল গায়েনকে বলে ‘সরকার’। এ গানে বাদ্যযন্ত্র হিসেবে ব্যবহূত হয় ঢোল, তবলা, বেহালা, সারিন্দা, মন্দিরা, বাঁশি, করতাল, হারমোনিয়াম প্রভৃতি। ঘাটু গানের প্রধান পৃষ্ঠপোষক গ্রামের জোতদাররা এবং এর প্রধান কর্মী সমকামী যুবকরা। এ গান প্রধানত ময়মনসিংহের পূর্বাঞ্চল, কুমিল্লা জেলার উত্তরাঞ্চল এবং সিলেট জেলার পশ্চিমাঞ্চলে এক সময় ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। বর্তমানে শিক্ষার প্রভাবে এ গানের জনপ্রিয়তা হ্রাস পেয়েছে। [শাহিদা খাতুন]
আরও দেখুন লোকসাহিত্য, লোকসঙ্গীত।