গণি, মেজর আবদুল
গণি, মেজর আবদুল (১৯১৫-১৯৫৭) প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট প্রতিষ্ঠায় অসাধারণ ভূমিকা রাখার জন্য একজন সুখ্যাত ব্যক্তিত্ব। মেজর আবদুল গণি ১৯১৫ সালের ১ ডিসেম্বর কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার নাগাইস গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম সারাফত আলী এবং মায়ের নাম জোবেদা খাতুন। পিতা ছিলেন কৃষিজীবী। আবদুল গণি সিদলাই-এ স্থানীয় মাদ্রাসায় প্রারম্ভিক শিক্ষা শেষ করে ১৯৩৩ সালে চট্টগ্রাম হাই মাদ্রাসায় ভর্তি হন। পরবর্তীতে ১৯৩৫ সালের জুলাই মাসে তিনি খুলনা জেলা স্কুলে ভর্তি হন এবং ১৯৩৬ সালে উক্ত স্কুল থেকেই প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। আবদুল গণি ১৯৩৬ সালের এপ্রিলে কলকাতা ইসলামীয়া কলেজে ভর্তি হয়ে ১৯৩৮ সালে ইন্টারমিডিয়েট এবং ১৯৪০ সালে স্নাতক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
চট্টগ্রামে অবস্থানকালে ছাত্রাবস্থায়ই আবদুল গণি ‘গ্রীন কুর্তা’ নামে একটি সেচ্ছাসেবী সংস্থা গঠন করেন। এই দল বিভিন্ন সামাজিক কর্মকান্ডে জড়িত থাকা ছাড়াও বিভিন্ন সরকারি কর্মকান্ডে স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকা পালন করত। কলকাতায় অধ্যয়নকালে তিনি ইন্ডিয়ান টেরিটোরিয়াল ফোর্সের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ট্রেনিং কোরের ২য় ব্যাটালিয়নে যোগ দেন এবং ১৯৩৬ সালের অক্টোবর থেকে ১৯৩৯ সালের নভেম্বর পর্যন্ত সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ ও বাৎসরিক অনুশীলন শিবিরে অংশগ্রহণ করেন। আবদুল গণি ছিলেন কলকাতার বেনিয়াপুকুরস্থ সিভিক গার্ডের গ্রুপ কমান্ডার।
মেজর গণি ১৯৪০ সালের ২০ মে বেঙ্গল ফায়ার সার্ভিসে ফায়ার অফিসার হিসেবে যোগ দেন এবং কলকাতা ফায়ার ব্রিগেডে বদলী হয়ে আসেন। তিনি ১৯৪১ সালের ৮ আগস্ট সামরিক বাহিনীতে যোগদানের জন্য আবেদন করেন এবং বোর্ড অব ইন্টার সার্ভিস দ্বারা নির্বাচিত হয়ে নভেম্বর মাসে অফিসার ট্রেনিং স্কুলে প্রশিক্ষণ অংশগ্রহণের জন্য ব্যাঙ্গালুরু গমণ করেন। ১৯৪২ সালের ৮ আগস্ট আবদুল গণি মহাযুদ্ধ পরিবেশে সামরিক বাহিনীতে ইমারজেন্সি কমিশন পান এবং সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট পদে ইন্ডিয়ান পাইওনিয়ার কোরে বদলী হন।
আবদুল গণি ১৯৪২ সালের ১০ ডিসেম্বর লেফটেন্যান্ট, ১৯৪৩ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ক্যাপ্টেন এবং ১৯৫৩ সালের ৩ ডিসেম্বর অনারারী মেজর পদে পদোন্নতি পান। কমিশন পাওয়ার পর তিনি প্রথমে ৬৪ অর্টিলারি পাইওনিয়ার ব্যাটালিয়নে যোগদান করেন। এ ব্যাটালিয়নে তিনি এ্যডজুটেন্ট, কোয়ার্টার মাস্টার ও কোম্পানি কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। সবশেষে তিনি ১৪০৭ পাইওনিয়ার কোম্পানি প্রতিষ্ঠিা করার দায়িত্ব লাভ করেন এবং এর প্রথম কমান্ডার নিযুক্ত হন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে তিনি বার্মা ফ্রন্টে যুদ্ধ করেন এবং বার্মা স্টার ও ওয়ার মেডেল পদক লাভ করেন। দেশভাগের পর অসুস্থতার কারণে মেজর গণি স্বক্রিয় সার্ভিস থেকে অবসর গ্রহণ করলে, তাঁকে নবগঠিত পাকিস্তান ন্যাশনাল গার্ডে বদলী করা হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে সৃষ্ট ১২৫৬ ও ১৪০৭ পাইওনিয়ার কোম্পানি দুজন বাঙালি মুসলমান দ্বারা গঠিত ছিল। মেজর গণি জালনায় অবস্থিত ইন্ডিয়ান পাইওনিয়ার কোর সেন্টারে ১৪০৭ পাইওনিয়ার কোম্পানি গঠনকালে সুদূরপ্রসারি পরিকল্পনা অংশ হিসেবে পদাতিক বাহিনীর যোগ্য বাঙালি সৈনিকদের তাঁর কোম্পানির জন্য নির্বাচন করেন। এ ব্যাপারে কর্নেল আর.আর মরিয়ারর্টি তাঁকে সহযোগিতা করেন। দেশভাগের অনতিপূর্বে মেজর গণি পাকিস্তানের সেনা প্রধান জেনারেল স্যার ফ্রাঙ্ক মেসার্ভিকে বাঙালি দ্বারা গঠিত দুইটি পাইওনিয়ার কোম্পানির সৈনিকদের নিয়ে একটি বাঙালি পদাতিক পল্টন প্রতিষ্ঠার অনুরোধ করেন। জেনারেল মেসার্ভি ১৭ আগস্ট এ বিষয়ে সম্মতিসূচক বক্তব্য রাখেন। ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বরে পাইওনিয়ার কোম্পানি দুইটি ঢাকায় সমবেত হয়। ১৯৪৮ সালের জানুয়ারি মাসে লে. কর্নেল ভি.জে.ই পিটারসন পাইওনিয়ার কোম্পানিদ্বয় থেকে নির্বাচিত বাঙালি সৈনিকদের নিয়ে পদাতিক ব্যাটালিয়ন (ইস্ট বেঙ্গল রেজিমন্টে) গঠনের কাজ শুরু করেন।
সেনাসদর থেকে মেজর গণিকে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমন্টে ট্রেনিং কোম্পানির এ্যড্জুটেন্ট/কোয়ার্টার মাস্টার নিযুক্তি দিয়ে বাঙালি পল্টনএ সৈনিক ভর্তির দায়িত্ব দেয়া হয়। মেজর গণির প্রচেষ্টায় ১৯৪৮ ও ১৯৪৯ সালে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথম ও দ্বিতীয ব্যাটালিয়ন প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৯৪৯ সালের জুলাই মাসে মেজর গণি ইস্ট পাকিস্তান রিক্রটিং অফিসে সহকারী রিক্রটিং অফিসার এবং ১৯৫১ সালে রিক্রটিং অফিসার হিসেবে নিয়োগ পান। রিক্রটিং দায়িত্ব পালনের জন্য তিনি সারাদেশ ভ্রমণ করেন এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগ দেওয়ার জন্য বাঙালি তরুণদের উদ্বুদ্ধ করেন। ১৯৫২ সালের মার্চ মাসে তিনি পাকিস্তান ন্যাশনাল গার্ড ব্যাটালিয়নে ফেরৎ যান এবং ১৯৫৩ সালের জুলাই পর্যন্ত সেখানে কর্মরত থাকেন। ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর তিনি সেনাবাহিনীর চাকরি হতে অবসর গ্রহণ করেন। সামরিক বাহিনীতে চাকুরিকালে মেজর গণি ফুটবল, হকি, ক্রিকেট, সাতার ও বিলিয়ার্ড খেলতেন। বাংলাদেশে ক্যাডেট কলেজ চালু করার বিষয়েও মেজর গণি বিশেষ অবদান রাখেন।
অবসর গ্রহণের পর মেজর গণি রাজনীনিতে যোগ দেন এবং ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক আইন সভায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিয়ে নির্বাচিত হন। ১৯৫৭ সালের নভেম্বর মাসে তিনি পশ্চিম জার্মানির ফ্রাঙ্কফ্রুটে বিশ্ব প্রাক্তন সৈনিক সংস্থার অধিবেশনে (World Veteran Soldiers' Conference) যোগ দেন এবং সেখানেই ১২ নভেম্বর হূদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। মেজর গণিকে ময়নামতি সেনানিবাসে সমাধিস্থ করা হয়। [মুহাম্মদ লুৎফুল হক]