গণযোগাযোগ
গণযোগাযোগ মানুষ যেদিন থেকে সমাজবদ্ধ হয়ে বাস করতে শুরু করে সেদিন থেকেই সর্বসাধারণের সঙ্গে যোগাযোগের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। এমনকি আদিম জনগোষ্ঠীগুলির গোত্র প্রধানরাও সকলের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতো যাতে কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয় বা শত্রুপক্ষের দিক থেকে আসন্ন বিপদ সম্পর্কে গোত্রের সকলকে সতর্ক করা যায়। শিঙা ফুঁকে বা ঘণ্টি বাজিয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর সকলকে একত্রিত হওয়ার জন্য ডাকা হতো। বড় বড় গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে শ্রুত শব্দ আরও দূরবর্তী স্থানের উদ্দেশ্যে একইভাবে পুনঃপ্রচার করা হতো। মধ্যযুগে রাজারা রাজ্যের চতুর্দিকে অশ্বারোহী বার্তাবাহক পাঠিয়ে রাজকীয় ফরমান জারি করত। মুগল-পাঠান আমলে সুবিস্তীর্ণ ভারতবর্ষে শাসক ও শাসিতের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষায় এ পদ্ধতি ছিল দ্রুততর ও কার্যকর। তাদের প্রবর্তিত ডাক যোগাযোগ ব্যবস্থা লক্ষণীয়ভাবে দ্রুত ও দক্ষতার সঙ্গে সাম্রাজ্যের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। উনিশ শতকে টেলিগ্রাফ পদ্ধতি যোগাযোগের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা সংযোজন করে। একই সময়ে সংবাদপত্রের প্রচলন হলেও অশিক্ষা ও ক্রয়ক্ষমতার অভাবে তার ব্যাপক প্রচার ঘটে নি। কার্যকর গণযোগাযোগের বাহন হয়ে উঠতে সংবাদপত্রকে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হয়। এমনকি, আজও গ্রামীণ বাংলাদেশের প্রায় সকল পরিবার এবং এমনকি শহরগুলিতেও বহু ক্ষেত্রে সংবাদপত্রের অভিগমন ঘটে নি। এদেশে প্রত্যেক গৃহে সংবাদপত্র পৌঁছানোর নিশ্চয়তাসহ মুক্ত সমাজের ধারণাটিই এখন পর্যন্ত অস্পষ্ট।
এসব প্রতিবন্ধকতা ভেঙে দেয় রেডিও সম্প্রচার ব্যবস্থা। বিশ শতকের তৃতীয় দশকে কলকাতা, দিল্লি, মুম্বাই এবং মাদ্রাজ থেকে সীমিতভাবে শুরু হয় রেডিও সম্প্রচার, ১৯৩৯ সালে শুরু হয় ঢাকা থেকে। পরবর্তী দশকে, যেখানে বিদ্যুৎ সংযোগ আছে সেখানে রেডিও হয়ে ওঠে সাধারণ ব্যাপার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই স্বল্প খরচে ড্রাইসেল ব্যাটারি চালিত ট্রানজিস্টর রেডিও বেতার সম্প্রচারকে ব্যাপক সংখ্যক মানুষের ঘরে পৌঁছে দেয়। রাতারাতি রেডিও হয়ে ওঠে জন যোগাযোগের সর্বাধিক কার্যকর বাহন। উচ্চ শক্তিসম্পন্ন মিডিয়াম-ওয়েভ এবং শর্ট-ওয়েভ ট্রান্সমিটারে, এমনকি স্বল্পমূল্যের ট্রানজিস্টারেও, পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তের খবর যে কোনো বিধিনিষেধ বা রাষ্ট্রীয় সীমারেখা অতিক্রম করে অপ্রতিরোধ্যভাবে শ্রোতার কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। এ অর্জন গণযোগাযোগের অগ্রগতির পথের উজ্জ্বল মাইলফলক। এদেশে ১৯৬৪ সনের ডিসেম্বরে পরীক্ষামূলকভাবে টেলিভিশনের যাত্রা শুরু হলেও তা সাধারণ্যে পৌঁছাতে দীর্ঘ সময় চলে যায়। প্রথমত ট্রান্সমিশন শক্তি ছিল অত্যন্ত কম, দ্বিতীয়ত টিভি ছিল উচ্চমূল্যের সামগ্রী। উচ্চবিত্তরাই কেবল এটির ক্রয় ক্ষমতার অধিকারী ছিল এবং প্রতিবছর উচ্চ লাইসেন্স ফি দিতে সক্ষম ছিল। তৃতীয়ত এজন্য প্রয়োজন ছিল বিদ্যুৎ সংযোগের। এ কারণগুলি টেলিভিশনের ব্যাপক যোগাযোগ মাধ্যম হয়ে ওঠার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। এমনকি আজও উচ্চ হারে তিন বছরের লাইসেন্স ফিসহ একটি টেলিভিশন সেট ক্রয় একজন সাধারণ মানুষের সাধ্যের বাইরে এবং পল্লী বিদ্যুতায়ন কার্যক্রমের মন্থর গতির ফলে টিভি অনিবার্যতই শহুরে মাধ্যম হয়ে রয়েছে যদিও ট্রান্সমিশন শক্তিতে স্থানীয় টিভি সম্প্রচার এখন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলকেও ছুঁয়ে যেতে সক্ষম। কিন্তু ইতোমধ্যেই নতুন উপগ্রহ প্রযুক্তি টিভি মাধ্যমকে, রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত স্থানীয় বিষয় ভাবনা-সীমার বাইরে গোটা বিশ্বপরিসরে ছড়িয়ে দিয়েছে। বাড়ির ছাদের ওপর স্থাপিত ডিশ অ্যান্টিনা অথবা একটি ডিশ অ্যান্টিনা থেকে বহু সেটে সংযোজনযোগ্য কেবল্ সংযোগের মাধ্যমে যে কেউ তার টিভিতে কোনো বিধি-নিষেধের দ্বারা বাধাগ্রস্ত না হয়েই পৃথিবীর যে কোনো প্রান্ত থেকে যে কোনো প্রান্তের উচ্চ বিশ্লেষণ শক্তিসম্পন্ন ডিজিটাল শব্দ ও ছবি ধারণ করতে পারে।
সম্প্রতি এতে আরও যুক্ত হয়েছে দ্রুত যোগাযোগ প্রযুক্তি ইন্টারনেট, যা পৃথিবীকে সত্যিকার অর্থেই একটি ছোট্ট বিশ্বগ্রামে পরিণত করেছে। সারা বিশ্ববাসী ইন্টারনেটের মাধ্যমে রেডিও এবং টেলিভিশনের সম্প্রচারিত অনুষ্ঠানমালা দেখতে ও শুনতে পারে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে সংবাদপত্র এবং সাময়িকিও পড়া যায়। সামান্য খরচে জনসাধারণ ইলেকট্রনিক মেইল-এর মাধ্যমে ব্যাপকভাবে সংবাদ, দলিলপত্র, চিত্র আদান-প্রদান করছে এবং ইন্টারনেট-এর মাধ্যমে (শ্রবণগোচরভাবে) কথা প্রেরণ করছে বা শুনছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে একই সময়ে এককভাবে একজনকে অথবা প্রতিষ্ঠানকে কিংবা বহুজনকে পত্র প্রেরণ করা যায়। এতে দূর-দূরান্তরে থেকেও মানুষ অত্যন্ত কম খরচে ও কম সময়ে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছে। ইন্টারনেটের কল্যাণে যে কেউ তার কম্পিউটারে লক্ষ লক্ষ গ্রন্থ বা সাময়িকী কিংবা পৃথিবীর যে কোনো স্থানের সংবাদপ্রত্র বা মতামত এবং চলচ্চিত্র দেখতে পারে, শুনতে পারে অতিসম্প্রতি প্রচারিত গান। ইন্টারনেট পদ্ধতিতে ওয়েবপেজ খুলে তথ্য ছড়িয়ে দেওয়া যায় বা সন্ধান করা যায় বাণিজ্যিক লেনদেন, কেনাকাটা, জাদুঘর, ভ্রমণ, সবরকমের তথ্য সংরক্ষণ ইত্যাদি। এ প্রযুক্তি, অল্প কয়েক দশক আগেও ছিল ধারণাতীত, যা বাংলাদেশেও দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। [এনামুল হক]