কলাবিদ্যা

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ১৯:২৬, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

কলাবিদ্যা  কলাবিষয়ক জ্ঞান। প্রাচীনকাল থেকেই এ বিদ্যা মানুষের সাংস্কৃতিক জীবনের একটি প্রধান অঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।  রামায়ণমহাভারত, কামসূত্র, বাক্যপদীয়, কলাবিলাস, দশকুমারচরিত, সৌভাগ্যভাস্কর প্রভৃতি গ্রন্থে বিভিন্ন কলার উল্লেখ আছে। ভাগবতপুরাণের কোনো কোনো ব্যাখ্যায়ও কলার কথা বলা হয়েছে। ভাস্কর রায়ের সৌভাগ্যভাস্কর গ্রন্থে তন্ত্রপ্রভাবিত কলাবিদ্যার যে তালিকা দেওয়া হয়েছে তাতে মারণ, উচাটন প্রভৃতি তান্ত্রিক প্রক্রিয়া, এমনকি চৌর্যবৃত্তিও কলাবিদ্যার অন্তর্ভুক্ত। শুক্রনীতিসারে যে কলাবিদ্যাসমূহের নাম পাওয়া যায় সেগুলি হলো: বালকের রক্ষণাবেক্ষণজ্ঞান, ধারণবিধি ও ক্রীড়াকৌশল, সন্তরণ, বৃক্ষারোহণ, নানাদেশীয় ভাষা অনুযায়ী বর্ণের লিখনজ্ঞান, দান, প্রতিদান, প্রত্যুপকার ইত্যাদি।

কলাবিদ্যার সংখ্যা সম্পর্কে মতভেদ আছে। বাৎস্যায়নের কামসূত্রে (১.৩.১৬) ৬৪ প্রকার কলার কথা বলা হয়েছে। ক্ষেমেন্দ্র তাঁর কলাবিলাসের চতুর্থ সর্গে ৬৪ প্রকার কলার কথা বলে দশম সর্গে আবার ১০০ প্রকার কলার কথা বলেছেন। তবে কামসূত্র এবং কলাবিলাস গ্রন্থে উল্লিখিত চতুঃষষ্টি কলাই সমধিক প্রসিদ্ধ। কবীন্দ্রাচার্যসূচিপত্র থেকে জানা যায় যে, খ্রিস্টীয় সতেরো শতকের মধ্যভাগে সর্ববিদ্যাবিশারদ কবীন্দ্রাচার্যের গ্রন্থাগারে এ ৬৪ কলার প্রত্যেকটি সম্পর্কে পৃথক পৃথক গ্রন্থ সংরক্ষিত ছিল। ৬৪ কলার সংক্ষিপ্ত পরিচয় নিম্নরূপ:

(১) গীত  কলাসমূহের মধ্যে প্রথমেই এর স্থান; (২) বাদ্য ঘন, বিতত, তত ও শুষির এ চার প্রধান বাদ্য যথাক্রমে কাংস্য, পুষ্কর, তন্ত্রী ও বেণু দ্বারা বাদিত হয়; (৩) নৃত্যকরণ, অঙ্গহার, বিভাব, ভাব, অনুভাব ও রস এ ছয় প্রকার; (৪) আলেখ্য চিত্রকলা; এটি রূপ, প্রমাণ, ভাব, লাবণ্যযোজন, সাদৃশ্য এবং বর্ণিকাভঙ্গভেদে ছয় প্রকার; (৫) বিশেষকচ্ছেদ্য ললাটে  তিলক রচনা; (৬) তন্ডুল-কুসুমবলি-বিকার তন্ডুলচূর্ণ দ্বারা আল্পনা দেওয়া; (৭) পুষ্পাস্তরণ ফুলশয্যা রচনা করা; (৮) দশনবসনাঙ্গরাগ দন্ত, বস্ত্র ও দেহের সৌন্দর্যবৃদ্ধিকরণ; (৯) মণিভূমিকাকর্ম মণিপ্রস্তরাদি দ্বারা মেঝে, চত্বর প্রভৃতি প্রস্ত্তত করা; (১০) শয়নরচনা কালভেদে, রুচিভেদে, ঋতুভেদে ও অবস্থাভেদে শয্যা প্রস্ত্তত প্রণালী; (১১) উদকবাদ্য জলতরঙ্গাদি বাদ্য; (১২) উদকাঘাত জলক্রীড়া; (১৩) চিত্রযোগ অপরের দৌর্ভাগ্যীকরণ বিদ্যা; (১৪) মাল্যগ্রন্থন বিভিন্ন প্রকার ফুল দিয়ে মালা গাঁথা ও অলঙ্কার তৈরি করা; (১৫) শেখরকাপীড়যোজন শিরোভূষণ নির্মাণ; (১৬) নেপথ্যপ্রয়োগ বিভিন্ন প্রকার রঙ্গরচনা; (১৭) কর্ণপত্রভঙ্গ হাতির দাঁত ও শঙ্খাদি দ্বারা কর্ণালঙ্কার প্রস্ত্তত প্রণালী; (১৮) গন্ধযুক্তি গন্ধদ্রব্য প্রস্ত্তত প্রণালী; (১৯) ভূষণযোজন অলঙ্কার যোগ; (২০) ঐন্দ্রজাল জাদুবিদ্যা; (২১) কৌচুমারযোগ রূপবৃদ্ধিকরণ বিদ্যা; (২২) হস্তলাঘব কর্মকুশলতা, অর্থাৎ দ্রুত হাতে কাজ করা; (২৩) বিচিত্র-শাকযূষ-ভক্ষ্য-বিকারক্রিয়া ভক্ষ্যাদি খাদ্যদ্রব্য প্রস্ত্তত প্রণালী; (২৪) সূচিবাণকর্ম সূচিকর্ম; (২৫) সূত্রক্রীড়া নালিকামধ্যে সূত্র সঞ্চালনাদি কার্য; (২৬) বীণাডমরুকবাদ্য তন্ত্রবিদ্যা; (২৭) প্রহেলিকা অর্থ গোপন রেখে কাব্য রচনা করা; (২৮) প্রতিমালা ক্রীড়া ও বাদচালন-বিষয়ক; (২৯) দুর্বাচকযোগ শব্দ ও অর্থ উভয় দিক দিয়ে যা খুব কঠিন তাই দুর্বাচকযোগ; এটি ক্রীড়া ও বাদচালনার্থে ব্যবহূত হয়; (৩০) পুস্তকবাচন সুর করে পুস্তকপাঠ; (৩১) নাটকাখ্যায়িকা দর্শন নাট্যবিষয়ক জ্ঞান; (৩২) কাব্যসমস্যাপূরণ একটি চরণ বা শব্দ নিয়ে অবশিষ্ট চরণাদি পূরণ করা; (৩৩) পট্টিকাবেত্রবয়ন বেত দ্বারা পেটরা, খট্বা প্রভৃতি বয়ন করা; (৩৪) তক্ষকর্ম কুন্দকর্ম ও সুতাতৈরি; (৩৫) তক্ষণ শয্যা-আসনাদি নির্মাণের জন্য চাঁছা-ছোলার কাজ; (৩৬) বাস্ত্তবিদ্যা গৃহনির্মাণাদি কাজ; (৩৭) রূপ্যরত্নপরীক্ষা স্বর্ণাদি পরীক্ষা ও সেসবের ব্যবহারজ্ঞান; (৩৮) ধাতুবাদ ধাতুর পাতন, শোধন ও ব্যবহারজ্ঞান; (৩৯) মণিরাগাকরজ্ঞান স্ফটিকাদি মণির রঞ্জনবিদ্যা ও ব্যবহারজ্ঞান; (৪০) বৃক্ষায়ুর্বেদযোগ বৃক্ষ রোপণ, পালন ও চিকিৎসা; (৪১) মেষ-কুক্কুট-লাবক-যুদ্ধবিধি ভেড়া, মোরগ প্রভৃতিকে যুদ্ধ শেখানো এবং সেসব দিয়ে খেলা দেখানো; (৪২) শুক-সারিকা-প্রলাপন টিয়া, ময়না প্রভৃতি পাখিকে মনুষ্যভাষায় শিক্ষিত করা; (৪৩) উৎসাদন-সংবাহন-কেশমর্দন-কৌশল মর্দনবিষয়ক বিভিন্ন কলাকৌশল; (৪৪) অক্ষরমুষ্টিকাকথন সাংকেতিক লিখনপদ্ধতি; (৪৫) ম্লেচ্ছিতবিকল্প শুদ্ধ শব্দ দ্বারা গ্রথিত হয়েও যা কুটিলাক্ষর বিন্যাসে অস্পষ্টার্থ; এটি গোপন বিষয় জানানোর পদ্ধতিবিশেষ; (৪৬) দেশভাষাবিজ্ঞান বিভিন্ন ভাষাজ্ঞান; (৪৭) পুষ্পশকটিকা এক ধরনের সংকেতবিদ্যা; এতে পুষ্পকে কেন্দ্র করে প্রশ্নোত্তর করা হয়; (৪৮) নিমিত্তজ্ঞান যেকোনো নিমিত্ত অবলম্বনে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেওয়া; এটাও এক ধরনের সংকেতবিদ্যা; (৪৯) যন্ত্রমাতৃকা যন্ত্রের ব্যবহারবিধি সংবলিত শাস্ত্রবিশেষ; (৫০) ধারণমাতৃকা শ্রুতিধর হওয়ার উপায়; (৫১) সংপাঠ্য কারও সঙ্গে অশ্রুতপূর্ব কোনো গ্রন্থপাঠ; (৫২) মানসী মানসচিন্তাতত্ত্ব; (৫৩) কাব্যক্রিয়া কাব্যরচনা; (৫৪) অভিধানকোষ বিভিন্ন শব্দের সঠিক অর্থ জানা; (৫৫) ছন্দোজ্ঞান কবিতার মাত্রা বা তালজ্ঞান; (৫৬) ক্রিয়াকল্প কাব্য ও অলঙ্কারজ্ঞান; (৫৭) ছলিতকযোগ ছদ্মবেশ রচনা; (৫৮) বস্ত্রগোপন বস্ত্র পরিধানের কৌশল; (৫৯) দ্যূতবিশেষ তাসাদির ক্রীড়া প্রদর্শন; (৬০) আকর্ষক্রীড়া পাশা খেলা; (৬১) বালক্রীড়নক বালকদের কন্দুকাদি খেলার সামগ্রী নির্মাণ; (৬২) বৈনয়িকীবিদ্যা আচারশাস্ত্র; হাতি, ঘোড়া, সিংহ, বাঘ প্রভৃতি বন্য প্রাণীকে পোষ মানানো ও খেলা শেখানোর বিদ্যা; (৬৩) বৈজয়িকীবিদ্যা বিজয় লাভের উপায় এবং (৬৪) বৈয়ামিকীবিদ্যা ব্যায়াম শিক্ষা।

উপর্যুক্ত চৌষট্টি প্রকার কলার মধ্যে কয়েকটির ব্যবহার সর্বাধিক। সেগুলি হলো: গীত, নৃত্য, বাদ্য, লিপিজ্ঞান, উদারবচন, চিত্রবিদ্যা, পুস্তকরচনা, তিলকাদিরচনা, মালাগাঁথা, রন্ধনবিদ্যা, সূচিকর্ম, রত্নজ্ঞান, জীবনোপায় জ্ঞান, পশুপাখির চিকিৎসা, ঐন্দ্রজালবিদ্যা, ক্রীড়াকৌশল, মানুষচেনা, বিচক্ষণতা, সংবাহন (গাত্রমর্দন), শরীরসংস্কার, কর্মকৌশল ইত্যাদি। তবে কামসূত্রে প্রবৃত্তির জন্য বা মানব জীবনে পরিপূর্ণতা অর্জনের জন্য এ চৌষট্টি কলার সবগুলিরই চর্চা করা আবশ্যক।

নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রে কলাবিদ্যা অর্জনের প্রয়োজনীয়তার কথা বিভিন্নভাবে বলা হয়েছে। নারীদের ক্ষেত্রে কলাবিদ্যার দ্বারা গুণের আতিশয্য বা প্রাধান্য জন্মে। ফলে তারা পেশাগত জীবনে অনেক অর্থ ও যশখ্যাতি লাভ করতে পারে। কলাবিদ্যায় পারদর্শিনী রমণী পুরুষকে, বিশেষত স্বামীকে স্ববশে আনতে পারে; স্বামীর মৃত্যু হলে, স্বামী দেশান্তরিত হলে কিংবা কোনো বিপদে পড়লে; অথবা নিজে দেশান্তরিত হলে, দুর্ভিক্ষে পড়লে কিংবা অন্য কোনো সমস্যায় পড়লে উপরিউক্ত কোনো একটি বিদ্যা দ্বারা অর্থোপার্জন করে বিপদ থেকে মুক্তি পেতে পারে এবং সুখে জীবিকা নির্বাহ করতে পারে। পুরুষরা কল্যাবিদ্যা অর্জন করলে বহুভাষী ও প্রিয়ভাজন হয়। এ বিদ্যা তাদের আরও বেশি আকর্ষণীয়, গুণবান, রমণীমনোমোহন এবং ভাগ্যবান করে। তবে কলাবিদ্যা প্রয়োগের সময় বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে হবে; দেশ, কাল, পাত্র বিচার করে তবেই এ বিদ্যা প্রয়োগ করা বিধেয়; অন্যথায় এর গ্রহণযোগ্যতা থাকে না। যেমন মেষ, মোরগ প্রভৃতির লড়াই এক সময় সকলের অত্যন্ত প্রিয় ছিল; ক্রীড়করা তাদের ক্রীড়া প্রদর্শন করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করত। কিন্তু যুগের পরিবর্তনের ফলে বর্তমানে এর তেমন উপযোগিতা নেই। এ খেলায় এখন আর সকলে আকর্ষণবোধ করে না, তাই অর্থও দেয় না। বর্তমানে বিশেষত শহর এলাকায় মেয়েদের কেশবিন্যাস, অলঙ্কার পরিধান, পোষাক নির্মাণ ও পরিধান, রন্ধন, আলপনা, মেহেদির ব্যবহার ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিশেষ আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়।  [মোঃ মাসুদ পারভেজ]