কার্যবিধি

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ১৯:৩৫, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

কার্যবিধি  সরকারের কার্যাবলি বণ্টন ও লেনদেনের উদ্দেশ্যে যথাযথ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রণীত বিধিমালা। কার্যবিধির ধারণা ও প্রয়োগ বস্ত্তত ভারত উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনামলেই বিকশিত হয়। মূলত এ কালপর্বে প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের দুটি দিক প্রসার লাভ করে। প্রথমত, সরকারি কাজ সম্পাদনের ধরন ও প্রক্রিয়া এবং দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/বিভাগের মধ্যে দায়িত্ব বন্টন। সংক্ষেপে, কার্যবিধি হলো সরকারি কার্যাবলির লেনদেন প্রক্রিয়া এবং মন্ত্রণালয়/বিভাগের মধ্যে দায়িত্ব বণ্টন ব্যবস্থা।

১৮৩৩ সালের চার্টার আইন প্রণয়নের পর থেকে এবং ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত কার্যবিধিতে নানা পরিবর্তন সাধিত হয়। ওই সময়ে নির্বাহি কাউন্সিলের কার্যাদি পরিচালনার নিয়মাবলি কাউন্সিলের অধিবেশনে গৃহীত প্রস্তাবসমূহের মাধ্যমেই সূত্রবদ্ধ করা হতো। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন পাস হওয়ার ফলে এ বিধিসমূহ শাসনতান্ত্রিক বা আইনগত ভিত্তি লাভ করে। এভাবে এ আইনের ৫৯ নং ধারা বাংলার গভর্নরকে সরকারি লেনদেনের জন্য বিধি প্রণয়নের ক্ষমতা প্রদান করে। এসব বিধিতে বিভাগসমূহ সংগঠন, গভর্নরের কাছে আন্তঃবিভাগীয় আলোচনার প্রক্রিয়াসহ তথ্যাদি প্রেরণ ও ঘটনাদি পেশ, মন্ত্রিপরিষদের সভা, তথ্যাদি প্রকাশ ইত্যাদি বিষয় লিপিবদ্ধ আছে। এসব বিধি ১৯৪৬ সালের ৩০ মে সামান্য সংশোধনসহ পুনরায় জারি করা হয়েছিল।

ভারত বিভাগের পর পাকিস্তানে ১৯৫৬ সালের সংবিধানের আওতায় প্রণীত কার্যবিধি ছিল ১৯৪৭ সালের আগেকার কার্যবিধির অনুরূপ। ১৯৬২ সালে গৃহীত সংবিধানের ৮১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রণীত কার্যবিধি বিভিন্ন সময়ে পরিবর্তিত হয়েছে। ১৯৭৫ সালের ১ নভেম্বর প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে কার্যবিধি প্রকাশিত হয়। বিধিসমূহ একটি রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারের উপযোগী করে তৈরি হয়েছিল, যে সরকারের অধীনে  রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত একটি মন্ত্রিপরিষদ ছিল। প্রত্যেক মন্ত্রীর উপর ন্যস্ত দায়িত্ব ছিল রাষ্ট্রপতিকে সহায়তা ও পরামর্শ প্রদান। রাষ্ট্রপতি অধীনস্থ কর্মকর্তাদের মাধ্যমেও এসব কার্য সম্পাদন করতে পারতেন।

১৯৯১ সালের নির্বাচনের পর দেশে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তিত হলে কার্যবিধিতেও পরিবর্তন ঘটানো হয়, যদিও পরিবর্তিত কার্যবিধির মৌলিক কাঠামো ও বিষয়বস্ত্ত মোটামুটি অভিন্নই থাকে। ১৯৯১ সালের ১৮ নভেম্বর এক বিজ্ঞপ্তি মারফত সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার ব্যবস্থায় ইতিপূর্বে যেসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন প্রয়োজন এখন থেকে সেগুলো প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির নিকট দাখিল করা হবে।

১৯৯৬ সালের নির্বাচনে সরকারের পরিবর্তন ঘটলে ওই বছর ১৯ অক্টোবর পুনরায় কার্যবিধি জারি করা হয়। এ পর্যায়েও মৌলিক কাঠামো ও বিষয়বস্ত্ত অপরিবর্তিতই থাকে, তবে এগুলোতে তিনটি মৌলিক সংশোধনী অন্তর্ভুক্ত হয়। প্রথমত, পূর্বতন সকল বিধিতে মন্ত্রণালয় বা বিভাগের সচিব ছিলেন অফিসিয়াল প্রধান; কিন্তু ১৯৯৬ সালের অক্টোবরে জারিকৃত বিধি অনুযায়ী ‘অফিসিয়াল’ শব্দটির পরিবর্তে ‘প্রশাসনিক’ শব্দটি প্রতিস্থাপিত হয়। অধিকন্তু এ বিধি মন্ত্রীর তত্ত্বাবধানে সচিবের দায়িত্ব পালনের অতীত প্রথারও অবসান ঘটায়। দ্বিতীয়ত, পূর্বেকার বিধিমতে বিকেন্দ্রীকৃত কর্মচারী ব্যবস্থাপনা যা সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা সীমিত করত, তাও রহিত হয়ে যায়। তৃতীয়ত, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বিধিবদ্ধ হওয়ার ফলে নির্ধারিত হয় যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতাসীন থাকাকালে প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিদের স্থলে যথাক্রমে প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টা অভিধা প্রযোজ্য হবে।

১৯৯৬ সালের কার্যবিধিতে ৫টি অধ্যায়, ৭টি তপসিল রয়েছে। পৃথকভাবে প্রকাশিত ১নং তপসিলে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বিভাগের মধ্যে দায়িত্ব বা করণীয় বিষয়সমূহের বন্টন আলোচিত হয়েছে। প্রথম অধ্যায়ে বিভিন্ন পরিভাষার সংজ্ঞা, কার্যবন্টন, কার্যাদি লেনদেনের ধরন এবং আদেশ, দলিল ও চুক্তি স্বাক্ষরের প্রক্রিয়া বর্ণিত হয়েছে। দ্বিতীয় অধ্যায়ে আছে কোনো বিষয় সরাসরি রাষ্ট্রপতির নিকট এবং রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর নিকট প্রেরণ এবং রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রেরিত বিষয়সহ শুধু প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রেরিত সূত্র ও বিষয়সমূহ উপস্থাপনের প্রক্রিয়া। তৃতীয় অধ্যায়ে বর্ণিত হয়েছে আন্তঃমন্ত্রণালয় পরামর্শের পদ্ধতি এবং কোনো কোনো বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, সংস্থাপন মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের বাধ্যতামূলক পরামর্শের ধরন। চতুর্থ অধ্যায়ে রয়েছে মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকের পদ্ধতি, এবং এতে আছে মন্ত্রিপরিষদের সামনে উপস্থাপনীয় বিষয়াদি, মন্ত্রিপরিষদ কর্তৃক কার্যাদি সম্পাদনের পদ্ধতি, মন্ত্রিপরিষদ কমিটিসমূহ, মন্ত্রিপরিষদের নিকট বিষয়াদি উপস্থাপনের ধরন, মন্ত্রিপরিষদ কমিটিসমূহের বৈঠক, মন্ত্রিপরিষদের সিদ্ধান্তসমূহ কার্যকরকরণ, মন্ত্রিপরিষদের দলিলাদির হেফাজত, সময় সময় মন্ত্রণালয় বা বিভাগসমূহ কর্তৃক কর্মকান্ডের রিপোর্ট পেশ ইত্যাদি। পঞ্চম অধ্যায়ে আছে সরকারি তথ্যাদি সংরক্ষণ ও জ্ঞাপন, বিদেশি সরকার ও সংস্থাসমূহের সঙ্গে যোগাযোগ প্রক্রিয়া এবং প্রতিরক্ষা সদর দপ্তরের সঙ্গে পত্রাদি আদান প্রদানের মতো বিবিধ বিষয়। এটি বিশেষ ক্ষেত্রে বা নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে প্রয়োজনবোধে বিধিসমূহ পালন না করার বা ব্যতিক্রম ঘটানোর এখতিয়ার প্রধানমন্ত্রীকে দিয়েছে।

নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার (২০০৭-২০০৮) আমলে কার্যবিধিতে একটি নতুন বিধি সংযোজিত হয়। এ নতুন বিধিতে প্রধান উপদেষ্টাকে বিশেষ সহকারি নিয়োগের ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। সংবিধানের আওতায় নিয়োগযোগ্য দশজন উপদেষ্টার কাজের চাপ হ্রাস করার লক্ষে এ ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

কার্যবন্টন  সংবিধানের ৫৫(৬) অনুচ্ছেদের বিধান অনুযায়ী কার্যবিধিতে সংযুক্ত ১নং তপশিলে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যে দায়িত্বের বন্টন উল্লিখিত হয়েছে। বিশেষভাবে, এ সংবিধানিক ধারা কার্যত রাষ্ট্রপতিকে সরকারি কার্যাবলির বন্টন ও পরিচালনার বিধিমালা তৈরির ক্ষমতা দিয়েছে এবং এ বিধানবলেই কার্যবিধি প্রণীত হয়েছে। কার্যবিধির ৩(২) বিধি অনুযায়ী মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ‘মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর মধ্যে কার্যাবলির বন্টন’ শিরোনামে তপসিল ১ পৃথকভাবে প্রকাশ করেছে।

কার্যবিধির ১নং তপশিলে প্রত্যেক মন্ত্রণালয় ও বিভাগের বিষয়গুলো বন্টনের ব্যবস্থা বর্ণিত রয়েছে। প্রতিটি মন্ত্রণালয়/বিভাগ ১নং তপশিলের আওতায় বন্টনকৃত ক্ষেত্র বা বিষয়ের মধ্যেই তাদের কার্যকলাপ সীমিত রাখবে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কাজকর্ম যাতে পুনরাবৃত্ত না হয় সেজন্য এ ব্যবস্থা। অবশ্য প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে অভিন্ন সিদ্ধান্তে পৌঁছার জন্য মন্ত্রণালয়সমূহ/বিভাগগুলোর জন্য আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এ বৈঠক কার্যবিধির বিধান অনুযায়ী বাধ্যতামূলক।  [এ.এম.এম শওকত আলী]