আলী, আফতাব
আলী, আফতাব (১৯০৭-১৯৭২) লস্কর (সীম্যান), শ্রমিক নেতা, রাজনীতিবিদ। ১৯৪৭-পূর্ব সময়ে আফতাব আলী ছিলেন ভারতীয় লস্করদের কলকাতা কেন্দ্রিক ইউনিয়নসমূহের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা। তিনি ১৯০৭ সালে সিলেটে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৩০-এর দশকে আফতাব আলী কলকাতা, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রের বন্দরসমূহে কর্মরত ভারতীয় লস্কর শ্রমিকদের একজন বিখ্যাত নেতায় পরিণত হন। তাঁর পিতা ছিলেন একজন ব্যবসায়ী যার স্টিমার কলকাতা ও সিলেটের মধ্যে চলাচল করতো। ১৮ বছর বয়সে যখন সিলেট সরকারি কলেজে দশম শ্রেণির ছাত্র, তখন পালিয়ে কলকাতায় চলে যান। সেখানে তিনি সিলেটে জন্মগ্রহণকারী ভারতবর্ষের বিখ্যাত জাতীয়তাবাদী নেতা বাগ্মী বিপিন চন্দ্র পাল-এর রাজনৈতিক কর্মীতে রূপান্তরিত হন। এক পর্যায়ে তিনি লস্কর হিসেবে একটি জাহাজে চাকরি নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। অল্পসময়ের মধ্যে তিনি লস্কর শ্রমিকদের একজন শক্তিশালী নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯৩০ ও ১৯৪০-এর দশকে আফতাব আলীর নেতৃত্বে দেশে এবং আন্তর্জাতিক ফোরামে শ্রমিক ইউনিয়ন বামধারার ট্রেড ইউনিয়নিজমের মাধ্যমে লস্কর শ্রমিকদের সম্পর্কে গৎবাঁধা (setreotype) ধারণা পরিবর্তনের প্রচেষ্টা চালান। ১৯৫০ এবং ১৯৬০-এর দশকে আফতাব আলী পূর্ব পাকিস্তানের একজন অন্যতম রাজনীতিবিদ হিসেবেও ভূমিকা পালন করেন।
কলকাতায় আফতাব আলী বামধারার রাজনৈতিক ও চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. আব্দুল মোত্তালিব মালিককে লস্করদের ট্রেড ইউনিয়নে যোগ দিতে অনুপ্রাণিত করেন। যার ফলে ১৯৩৬ সালে ডা. আব্দুল মালিক লস্করদের শ্রমিক আন্দোলনে যোগ দেন। আফতাব আলীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ডা. মালিক ইন্ডিয়ান কোর্টার্স মাস্টারস ইউনিয়ন ও কলকাতাস্থ ইন্ডিয়ান সেইলরস ইউনিয়নের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৩০-এর দশকের শেষে আফতাব আলী অল ইন্ডিয়া সীম্যান ফেডারেশন (এ.আই.এস.এফ) প্রতিষ্ঠা করেন, যার সভাপতি হন তিনি নিজে এবং ডা. মোত্তালিব মালিক নির্বাচিত হন সম্পাদক। উল্লেখ ডা. মালিক ১৯৪৭-১৯৭১ সালে একাধিকবার মন্ত্রী এবং সর্বশেষ ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর ছিলেন।
এআইএসএফ-এর সভাপতি হিসেবে আফতাব আলী ব্রিটিশ ও অন্যান্য পশ্চিমা শ্রমিক ইউনিয়নের সংস্পর্শে আসেন। আফতাব আলীর আগে ভারতীয় লস্করদের ট্রেড ইউনিয়নিজম এতই অনুন্নত ছিল যে, ব্রিটেনের শ্রমিক ইউনিয়নগুলো তাঁদের সমকক্ষ হিসেবে তো বিবেচনাই করতো না এমনকি এদের ন্যূনতম স্বীকৃতিও প্রদান করতো না। অনেকক্ষেত্রে ব্রিটিশ শ্রমিক শ্রেণির লোকেরা ভারতীয় লস্করদের প্রতি তাদের স্বজাতি মালিক এবং সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের মতো আচরণ করতো। ‘কালো বা বাদামীদের চেয়ে সাদারাই শ্রেষ্ঠ, এমনতর চিন্তা ব্রিটিশ শ্রমিকদের মধ্যে বদ্ধমূল ধারণা হিসেবে কাজ করতো। এআইএসএফ-এর নেতা হিসেবে আফতাব আলী বিশ্বব্যাপী বামধারার যে ট্রেড ইউনিয়নের নেটওয়ার্ক ছিল তার সাথে সম্পর্ক তৈরি করেন এবং বামপন্থী ট্রেডইউনিজমের মাধ্যমে ব্রিটিশ ডক ইউনিয়নসমূহের বর্ণবাদী ও বৈষম্যমূলক আচরণের বিষয়টি সবার নজরে আনেন। এ জন্যে তিনি মূল ক্ষেত্র হিসেবে বেঁছে নেন আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)-এর বিভিন্ন সভা ও অধিবেশনকে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, ১৯৩৫ দশকে আইএলও সমুদ্রগামী জাহাজের শ্রমিকদের কাজের পরিধি এবং দৈনিক কতঘণ্টা তারা কাজ করবে তার উপর একটি নীতিমালা তৈরির জন্যে জেনেভায় একাধিক সভা আহবান করে। ব্রিটেন ব্যতীত বিশ্বের সকল পশ্চিমা শ্রমিক ইউনিয়ন আইএলও-তে প্রস্তাব করে সমুদ্রে শ্রমিকরা সপ্তাহে ৫৬ ঘণ্টা কাজ করবে এবং সমুদ্রবন্দরে করবে ৪৮ ঘণ্টা কাজ। ব্রিটেনের প্রস্তাব ছিল আরো বেশি সময় শ্রমিকরা কাজ করুক। যাহোক আফতাব আলী আইএলও-এর অধিবেশনে দীর্ঘ বক্তৃতায় পশ্চিমা ইউনিয়নসমূহের সম্মিলিত প্রস্তাবকে সমর্থন জানান। উল্লেখ্য, ১৯২০-এর দশকে ভারতীয় লস্করদের জন্যে ব্রিটেনসহ পশ্চিমা জাহাজে কাজ করার পরিবেশ অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ও অমানবিক ছিল। এ ব্যাপারে আইনি কাঠামোও ছিল তাদের প্রতিকূলে। কারণ জেনোয়া কনফারেন্স (১৯২০)-এর নীতিমালায় বলা হয়েছিল যে, দক্ষিণ এশিয় লস্করদের প্রতি ব্যতিক্রমী পদক্ষেপ নেয়া যাবে এবং তাদের অধিকার শ্বেতাঙ্গ শ্রমিকদের মতো হবে না।
১৯৩৬ সালে আইএলও-এর জেনেভা কনফারেন্সকে সামনে রেখে আফতাব আলী তার সংগঠনের পক্ষ থেকে বেশ কিছু দাবিনামা উত্থাপন করেন। তার মধ্যে ছিল (ক) ভারতীয় লস্কর শ্রমিকদের মতই শেতাঙ্গ শ্রমিকদের প্রতি একই রকম ব্যবহার করতে হবে এবং উভয়ের অধিকার হবে সমান সমান। (খ) কোনো অবস্থাতেই তাদেরকে বিনা বেতনে অতিরিক্ত ঘণ্টা কাজ করানো যাবে না এবং (গ) অতিরিক্ত কাজের জন্যে অর্থ প্রদান করতে হবে। ব্রিটিশ সরকার এবং তাদের শ্রমিক ইউনিয়নের বিরোধিতা সত্ত্বেও দীর্ঘ বিতর্কের পর অন্যান্য পশ্চিমা দেশের সমর্থনের ফলে আফতাব আলী উত্থাপিত দাবিসমূহ অধিবেশনে পাস হয়ে যায়। অধিবেশনে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর প্রতিনিধিরা এই মর্মে অভিমত পোষণ করে যে, সমুদ্রগামী জাহাজে শ্রমিকদের কাজের ঘণ্টা অবশ্যই যুক্তিসঙ্গত হতে হবে এবং জাতি ও নৃগোষ্ঠী নির্বিশেষে সকল শ্রমিকদের কাজের অধিকার হবে সমান, কারো প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করা যাবে না। বিভিন্ন দেশের বক্তব্যকে একত্রিত করে একটি আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব পাস হয়। এ ছাড়াও শ্রমিকদের কল্যাণের জন্যে একটি সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করা হয়। যেমন ওই প্রস্তাবের ১৩ নং অনুচ্ছেদ বলা হয় যে, সরকারসমূহ, শিপিং কোম্পানিসমূহ এবং সংগঠনসমূহ যারা সমুদ্রগামী জাহাজের শ্রমিকদের কল্যাণে তহবিলগুলি পরিচালনা করেন তাদের প্রতি জোরালো সুপারিশ করা হচ্ছে যে, তারা যেন কোনো বিশেষ জাতির নৌ শ্রমিকদের প্রতি পক্ষপাত না করেন। বরং প্রত্যেকের উচিত আন্তর্জাতিক সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্বের আলোকে উদারভাবে কাজ করা। তবে ব্রিটিশরা জেনেভা কনফারেন্সে পাসকৃত প্রস্তাবসমূহকে কেবল প্রত্যাখানই করেনি, পক্ষান্তরে তারা ভারতীয় লস্করদের জন্যে অতিরিক্ত কর্মঘণ্টার জন্যে আলোচনা অব্যাহত রাখে। তারা প্রস্তাব করে যে, ভারতীয় লস্করদের জন্যে কর্মঘণ্টা হবে সমুদ্রে সাপ্তাহিক ৬৪ ঘণ্টা এবং বন্দরে ৫৬ ঘণ্টা। আফতাব আলীর নেতৃত্বে এআইএসএফ ব্রিটিশদের এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে আলোচনা অব্যাহত রাখে। ইতিমধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় এবং ভারতীয় শ্রমিকদের সমুদ্রগামী জাহাজে কাজ করার চাহিদাও বৃদ্ধি পায়। আফতাব আলী এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দীর্ঘদিনের অর্থনৈতিক দাবিপূরণের লক্ষ্যে লন্ডন, গ্লাসগো, লিভারপুল, কার্ডিফ এবং অন্যান্য ব্রিটিশ বন্দরে কর্মরত ভারতীয় শ্রমিকদের ধর্মঘট আহবান করেন।
১৯৩৯ সালের নভেম্বরে লন্ডনে অভিবাসী ভারতীয়দের সংগঠন ইন্ডিয়া লীগ-এর সম্মেলনে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, ভারতীয় লস্করদের প্রতি যে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হচ্ছে তার প্রতিবাদে ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী, শিপিং মন্ত্রণালয়, ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ইন্ডিয়া কমিটির সাধারণ সম্পাদক সি সি পোলে এমপি এবং লেবার পার্টির সংসদীয় কমিটি বরাবর প্রতিবাদলিপি প্রেরণ করা হবে। ১৯৩৯ সালের ডিসেম্বরে ব্রিটিশ সরকার ও এআইএসএফ-এর মধ্যে সমঝোতা অনুযায়ী ধর্মঘটের অবসান হয়। ১৯৪০ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যখন বিস্তৃত হয়, ভারতীয় লস্করদের চাহিদাও অনেকাংশে বৃদ্ধি পায়। এই অবস্থায় ব্রিটিশ সরকার লস্কদের সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করে এবং সকল ভারতীয় লস্করদের আটলান্টিক অতিক্রমকারী জাহাজে কাজ করার অনুমতি দেয়া হয়। পূর্বে নির্বাচিত লস্করদের জন্যে কেবল এই সুযোগ উন্মুক্ত ছিল।
১৯৪০-এর দশকের শুরুতে আফতাব আলী আমেরিকা মহাদেশে যোগাযোগ স্থাপন করেন। তিনি ওই সময় আইএলও-এর সম্মেলনে অংশ নিতে বেশ কিছুদিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছিলেন। তিনি তখন ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান মার্চেন্ট নেভী ক্লাব-এর সাধারণ সম্পাদক ইব্রাহিম চৌধুরীর সাথে সাক্ষাৎ করে যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় লস্করদের কল্যাণের জন্যে কীভাবে কাজ করা যায়, সে সম্পর্কে আলোচনা করেন। ব্রিটেনের গোয়েন্দা বিভাগ-ঐ সময় আফতাব আলীর উপর কড়া নজর রাখে এবং সরকারের নিকট একটি গোপনীয় রিপোর্ট পেশ করে। এতে বলা হয় যে, আফতাব আলী আইএল্ও-এর সম্মেলন উপলক্ষে এখন ফিলাডেলফিয়ায় অবস্থান করছেন যা ১৯৪৪ সালের মে মাসে শেষ হয়েছে। এখানে তিনি ফোর্ড মটর কোম্পানির প্রাক্তন কর্মচারী ইব্রাহিম চৌধুরীর সাথে গোপন বৈঠক করেন। আমেরিকায় অবস্থানরত ব্রিটিশ গোয়েন্দারা আরো জানান যে, এরা উভয়ই পূর্ব পরিচিত এবং লন্ডনে যে ইন্ডিয়া লীগ রয়েছে উভয়ই তার সদস্য। তবে ওই সময় যুক্তরাষ্ট্রের নৌশ্রমিকদের সংগঠন ন্যাশনাল ম্যারিটাম ইউনিয়ন (এনএমইউ) ভারতবর্ষের স্বাধীনতার আন্দোলনকে সমর্থন ও সহানুভূতির চোখে দেখতো। এই অবস্থার সুযোগ নিয়ে আফতাব আলী এনএমইউ-এর নেতৃবৃন্দের সাথে একটি কার্যকর সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। আফতাব আলীর এই তৎপরতা ব্রিটিশ সরকারকে রিপোর্ট করে গোয়েন্দারা মন্তব্য করেন যে, এনএমইউ-এর সাথে আফতাব আলীর এই যোগাযোগ কিভাবে অগ্রসর হয় সে সম্পর্কে তারা কড়া নজর রাখবেন।
সীম্যান ইউনিয়নের মূল নেতা হিসেবে আফতাব আলী কর্তৃক উত্থাপিত অর্থনৈতিক দাবিদাওয়ার সাথে যুক্ত হয়েছিল রাজনৈতিক সংগ্রামের বিষয়টি। বস্ত্তত রাজনৈতিক মুক্তির বিষয়টি আরো ব্যাপক এবং এটা কেবল ট্রেড ইউনিয়নের মতো কিছু অর্থনৈতিক দাবিনামায় সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। সেজন্য অর্থনৈতিক সুযোগ সুবিধার বিষয়গুলিকে বৃহত্তর গন্ডিতে নিয়ে যাওয়ার প্রয়াস ছিল আফতাব আলীর। যেমন তিনি ব্রিটেন প্রবাসী ভারতীয় রাজনৈতিক কৃষ্ণ মেননের আমন্ত্রণ গ্রহণ করে ১৯৩৯ সালের ২৩ আগস্ট গ্লাসগো ট্রেড কাউন্সিলের মিটিং-এ যোগ দিতে যুক্তরাজ্যে গমন করেন। উল্লেখ্য, কৃষ্ণমেনন ১৯৩৪ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত যুক্তরাজ্যের অন্যতম প্রধান দল লেবার পার্টির সদস্য হিসেবে সেন্ট প্যানকার্স বরার (Ward) কাউন্সিলর ছিলেন। ১৯৪৭ সালের পর তিনি যুক্তরাজ্যে ভারতের প্রথম হাই কমিশনার নিযুক্ত হন। তবে ১৯৩০ ও ১৯৪০-এর দশকে কৃষ্ণ মেনন যদিও লেবার পার্টির সদস্য ছিলেন তথাপি তার মূল লক্ষ্য ছিল অভিবাসী ভারতীয় বিশেষত লস্কর শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষা এবং তাদেরকে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত করা। এ কারণেই আফতাব আলীর সাথে তাঁর ঘনিষ্ট সম্পর্ক তৈরি হয়। আফতাব আলী যখন কৃষ্ণ মেননের সাথে লন্ডনসহ ব্রিটেনের বন্দরনগরীতে রাজনৈতিক কর্মকান্ডে লিপ্ত, তখন কমিউনিস্ট পার্টি অব ব্রিটেনের নেতা বি.এফ ব্রা্ডলি ম্যানচেস্টারে বৈঠকরত ব্রিটিশ কমিউনিস্ট ও ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের সাথে আলোচনার জন্য আফতাব আলীকে সেখানে আমন্ত্রণ জানান। আফতাব আলী আলোচনায় মিলিত হয়ে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা এবং লস্কর শ্রমিকদের অধিকারের প্রতি তাদের সমর্থন কামনা করেন। এরপর তিনি লন্ডনে ফিরে এসে সুরত আলী ও তশিল মিয়ার সহায়তায় লন্ডনে তার সংগঠনের একটি শাখা প্রতিষ্ঠা করেন।
এদিকে কলকাতার খিদিরপুরে ভারতীয় লস্করদের বিভিন্ন স্তরের মধ্যে একটি অভ্যন্তরীণ সংকট বিরাজমান ছিল। এই স্তর কাঠামোর সর্বোচ্চ শিখরে ছিল ‘বাড়িওয়ালাগণ’। ১৯৩০-এর দশকে আফতাব আলীর নেতৃত্বে সীম্যান ইউনিয়ন এসব বাড়িওয়ালাদের বিরুদ্ধে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এসব বাড়িওয়ালারা ছিল সিলেটের ব্যবসায়ী যারা খিদিরপুরে বাড়ি ক্রয় করে এগুলোকে এক সঙ্গে অনেক লস্করের বসবাসের উপযোগী বোর্ডিং হাউজ-এ রূপান্তরিত করেন। উনিশ শতকের শেষে এসব বাড়িয়ওয়ালারা কলকাতায় তাদের ব্যবসা শুরু করেছিল। ১৮৯৭-৯৮ সালে খিদিরপুরে একজন বিখ্যাত বাড়িওয়ালা ছিলেন আয়েন উল্লাহ নামে একজন ব্যক্তি যিনি তার দর্জিদোকানকে একটি বোর্ডিং হাউজে রূপান্তরিত করেন এবং ক্রয়সূত্রে পরে একাধিক বাড়ির মালিক হয়ে যান। এসব বাড়িওয়ালা সিলেট থেকে কলকাতায় এসে যেসব লস্কর জাহাজে কাজ পাওয়ার অপেক্ষায় থাকতো তাদেরকে বিনা অর্থে থাকতে দিতেন এবং ভবিষ্যতে সুদসহ এই অর্থ আদায় করতেন। প্রথম দিকে এই ব্যবস্থা বাড়িওয়ালা ও লস্কর উভয়ের জন্যে মঙ্গলজনক ছিল। এই ব্যবস্থায় একজন লস্করের পেছনে থাকা ও খাওয়াবাবদ জাহাজযাত্রার পূর্ব পর্যন্ত যে খরচ হতো তা বাড়িওয়ালার ‘রেডবুকে’ লেখা থাকতো এবং যখন কলকাতায় জাহাজিরা ফিরতি যাত্রায় বেতনসহ ফিরে আসতেন, তখন তারা বাড়িওয়ালাদের পাওনা অর্থ পরিশোধ করতেন। তবে ১৯৩০-এর দশকে বাড়িওয়ালা লস্করদের কাছে উচ্চহারে সুদসহ বেশি অর্থ আদায় করতে থাকেন। এই অবস্থায় আফতাব আলী তার ইউনিয়নকে নিয়ে বাড়িওয়ালাদের এই শোষণের বিরুদ্ধে কতিপয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এরফলে বাড়িওয়ালাদের উচ্চহারে সুদসহ অর্থ আদায় বন্ধ হয়ে যায়।
১৯৩৭-৩৮ সালে আফতাব আলীর নেতৃত্বাধীন ভারতীয় শ্রমিক ইউনিয়ন সাফল্যের শীর্ষ শিখরে অবস্থান করে। শিপিং এজেন্ট, শিপিং কর্মকর্তা, সারেং (লস্করদের নেতা) এবং বাড়িওয়ালাসহ সবাই আফতাব আলীর নেতৃত্ব ও পরামর্শকে গুরুত্ব দিত। সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলি একত্রিত হয়ে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, লস্কর শ্রমিকদের জন্যে একটি অভিন্ন নীতিমালা থাকবে এবং সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো তা মেনে চলবে। আফতাব আলী তাঁর সংগঠনের পক্ষ থেকে কয়েকজন প্রতিনিধি নির্বাচন করেন যাদের কাজ ছিল মূলত অভিন্ন নীতিমালা সবাই মেনে চলছে কিনা তা পর্যবেক্ষণ করা। আফতাব আলী তাঁর কঠোর পরিশ্রম এবং ট্রেড ইউনিয়নের কর্মতৎপরতার ফলে লস্কর শ্রমিকদের কর্মপরিবেশের উন্নতি হয় এবং তাদের আয়-রোজগারও বৃদ্ধি পায়।
১৯৭২ সালে লন্ডনে আফতাব আলীর মৃত্যু হয়।
[আশফাক হোসেন]