আহমদ, নুর
আহমদ, নুর (১৮৯০-১৯৬৪) আইনজীবী, রাজনীতিক। সমধিক পরিচিত নুর আহমদ চেয়ারম্যান নামে। চট্টগাম শহরের আলকরণ মহল্লায় ১৮৯০ সালের ২৫ ডিসেম্বর তাঁর জন্ম। পিতা হাজী আমজাদ আলী সওদাগর চট্টগ্রামের নামজাদা ব্যবসায়ী ছিলেন। মাতা পেয়ারজান বিবি। নুর আহমদ চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল হাইস্কুল থেকে ১৯১০ সালে প্রবেশিকা, ১৯১২ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে এফ.এ (ফার্স্ট আর্টস) এবং ১৯১৫ সালে আরবি ও ফারসি ভাষায় বি.এ (সম্মান) ডিগ্রি লাভ করেন। অতঃপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯১৬ সালে ইতিহাসে এম.এ ডিগ্রি লাভ করেন। সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে তিনি চ্যান্সেলর স্বর্ণপদক পান। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯১৭ সালে বি.এল ডিগ্রি লাভ করেন।
নুর আহমদ চট্টগ্রাম জজ আদালতে আইন ব্যবসা শুরু করেন। ১৯১৮ সালে তিনি চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যালিটির কমিশনার নির্বাচিত হন। তিনি ১৯২১ সালে মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন এবং ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত একটানা ৩৩ বছর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯২৭ সালে চট্টগ্রাম পৌর এলাকায় অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করাসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক ও জনহিতকর কর্মকান্ড পরিচালনা করেন। ১৯২৮ সালে মেয়েদের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করে তিনি প্রতি এলাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের এক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। পৌরসভা পরিচালিত অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের দায়িত্বপালন ও পাঠদান নিশ্চিত করার জন্য পৌরসভায় স্কুল পরিদর্শক নিয়োগ করা হয়। তাঁর প্রচেষ্টায় অবিভক্ত বাংলায় চট্টগ্রাম পৌর এলাকা শিক্ষার হারে সর্বোচ্চ স্থান লাভ করে। তাঁর সময়ে চট্টগ্রাম পৌরসভা পরিচালনাধীন প্রায় ৬২টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল। ১৯৬২ সালে তৎকালীন পৌরপ্রশাসক আলকরণ পৌর প্রাথমিক বালক বিদ্যালয়কে নিম্ন মাধ্যমিক স্কুলে উন্নীত করেন এবং নুর আহমদের নামে বিদ্যালয়ের নামকরণ করেন। পর্যায়ক্রমে স্কুলগুলো মাধ্যমিক স্তরে উন্নীত হয়।
পৌরবাসীর পানীয় জলের সুব্যবস্থা করতে তিনি দামপাড়ায় ওয়াটার ওয়ার্কস এবং রাস্তায় পানির কল স্থাপন করেন। রাস্তার বৈদ্যুতিক বাতির ব্যবস্থাও তাঁর সময়ে হয়েছিল। তিনি লালদিঘির দক্ষিণপাড়ে মিউনিসিপ্যাল পাবলিক লাইব্রেরির (১৯০৩) ব্যাপক উন্নয়ন করেন। আর্থিক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও শহরের গরীব জনগণের পৌর ট্যাক্স তিনি মওকুফ করেছিলেন। রাস্তাঘাট উন্নয়ন, খাল সংস্কার, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা সুনিশ্চিতকরণ ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা ছিল তাঁর সময়ের উল্লেখযোগ্য সাফল্য।
নুর আহমদ ১৯৩৭ সালে বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। অল্প সময়ের মধ্যে দক্ষ পার্লামেন্টারিয়ান হিসেবে আইন প্রণয়নে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। প্রজাস্বত্ব আইন, সূর্যাস্ত আইন বিলোপ, যৌতুক প্রথা বিলোপের প্রস্তাব, ওয়াক্ফ ও দেবোত্তর সম্পত্তি আইন পাসে তাঁর ভূমিকা অনন্য। পাকিস্তান গণপরিষদে তিনি হোমিওপ্যাথিক বিল উত্থাপন করেন যার পরিপ্রেক্ষিতে হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল বোর্ড গঠিত হয়। চট্টগ্রামে একটি মেরিন স্কুল প্রতিষ্ঠায় তাঁর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল।
নুর আহমদের রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় খেলাফত আন্দোলনে যোগদানের মাধ্যমে। পরবর্তী সময়ে তিনি মুসলিম লীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন এবং আজীবন মুসলিম লীগের রাজনীতিতে আস্থাশীল ছিলেন। তিনি ছিলেন ধর্মপ্রাণ এবং অসাম্প্রদায়িক।
ব্রিটিশ সরকার নুর আহমদকে তাঁর সমাজকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘খান সাহেব’ উপাধি দিয়ে সম্মানিত করার প্রস্তাব করলে তিনি সে প্রস্তাব বিনয়ের সাথে প্রত্যাখ্যান করেন। পাকিস্তান সরকার তাঁর আজীবন সমাজসেবার স্বীকৃতি দিয়ে ‘সিতারা এ খেদমত’ উপাধি ও মাসিক ৫০০ টাকা সাহিত্য-বৃত্তি মঞ্জুর করে। নুর আহমদ আরবি, ফারসি, ইংরেজি ও উর্দু ভাষায় দক্ষ ছিলেন। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে: Forty Great men and Women in Islam (1957); The Rising Islam (1958); Islam and its Prophet as Judged by the Non Muslims; Holy Quran Science and Modern Knowledge; Education and Educational Problems; A Short History of the Muslim Historians, Travellors, Geographers and other Works (1957); East Pakistan as it is now and Some of its Urgent Needs and Problems (1966); Glimpses of Islam.
নুর আহমদ দীর্ঘকাল চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান, দশ বছর বঙ্গীয় আইনসভার সদস্য ও সাত বছর পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য ছিলেন। ১৯৬৪ সালের ২ অক্টোবর চট্টগ্রামে তাঁর মৃত্যু হয়। চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যালিটি তাঁর জীবদ্দশায়ই তাঁর নামে শহরের প্রধান একটি সড়কের নামকরণ করে।
[আহমদ মমতাজ]