গ্রন্থ সাহেব
গ্রন্থ সাহেব শিখদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ। এর অপর নাম আদিগ্রন্থ (First Book)। দশম গুরু গোবিন্দ সিং (১৬৬৬-১৭০৮) রচিত দশম পাদশাহী দা গ্রন্থ থেকে স্বতন্ত্রীকরণের জন্য এটি আদিগ্রন্থ নামে অভিহিত হয়। ভাই গুরুদাস গুরুমুখী লিপিতে এ গ্রন্থ প্রথম লিপিবদ্ধ করেন এবং এতে ‘জয়জয়ন্তী’ রাগ সংযোজন করেন তেগ বাহাদুর সিং। গ্রন্থটি আদ্যন্ত প্রাকৃত মাত্রাছন্দে ও মিত্রাক্ষরে রচিত। পঞ্চম গুরু অর্জুন সিং (১৫৬৩-১৬০৬) ১৬০১/৪ সালে গ্রন্থসাহেব সংকলন ও সম্পাদনা করেন।
শিখরা দশজন গুরুর আদর্শ ও শিক্ষাকে অনুসরণ করে, যাঁদের মধ্যে শিখধর্মের প্রবর্তক নানক প্রথম গুরু। প্রথম পঞ্চগুরুর শিক্ষা, চিন্তাচেতনা ও ধর্মীয় মতাদর্শ নিয়ে গ্রন্থসাহেব রচিত। গোবিন্দ সিং তাঁর পিতা নবম গুরু তেগ বাহাদুর সিং-এর (১৬২১-১৬৭৫) রচনাও এর সঙ্গে যুক্ত করেন।
গ্রন্থসাহেবে শিখ গুরুদের বাণী, নির্দেশ ও স্তোত্রগীত ছাড়াও স্বনামখ্যাত একাধিক ভক্ত-সাধকের বাণী ও মুসলমান সুফি সাধকের বক্তব্য রয়েছে। তাঁরা হলেন বাংলার জয়দেব, মূলতানের শেখ ফরিদ, মহারাষ্ট্রের নামদেব, ত্রিলোচন ও পরমানন্দ, উত্তর প্রদেশের বেণী, রামানন্দ, পিপা, সৈন, কবীর, রবিদাস, ভীষ্ম, রাজস্থানের ধন্না, অযোধ্যার সুরদাস প্রমুখ। এঁদের জীবদ্দশাতেই গ্রন্থসাহেব সংকলিত ও সম্পাদিত হয়।
গ্রন্থটির আরম্ভ ‘মূলমন্ত্র’ দিয়ে। অতঃপর সন্নিবেশিত হয়েছে পাঁচটি বাণী: জপুনীসাণু, সো-দরু, সুণিবড়া, সো-পুরখু এবং সোহিলা। ৩১টি ভিন্ন রাগ অনুসারে বাণীগুলি সজ্জিত। গ্রন্থের উপসংহারে রয়েছে ‘ভোগ’ বা ‘ভোগ দা বাণী’। অপর একটি বিন্যাসের ক্ষেত্রে জপজী, রহিরাস ও সোহিলা নামগুলি অধিকতর পরিচিত। এতে সুণিবড়া অংশ সো-দরুর অন্তর্গত, আবার সো-দরু ও সো-পুরখু অংশের যৌথরূপ রহিরাস হিসেবে বিবেচিত। ধর্মপ্রাণ শিখধর্মাবলম্বিগণ প্রভাতে জপজী, সন্ধ্যায় রহিরাস এবং শয্যাগ্রহণকালে সোহিলা পাঠ করেন। গ্রন্থসাহেবের বিষয়বৈচিত্র্যের কারণে অধুনা ভারতের একাধিক ভাষায় এটি অনূদিত হয়েছে।
গ্রন্থসাহেবের প্রথম ইংরেজি অনুবাদ করেন এর্নস্ট ট্রুম্প (১৮৭৭)। কিন্তু তিনি প্রাচ্যের এ ধর্মগ্রন্থের প্রকৃত ভাবধারা অনুধাবন করতে পারেননি। দি শিখ রিলিজিওন নামক ছয় খন্ডের বিরাট গ্রন্থে ম্যাক্স আর্থার মেকলিফ ট্রুম্পের ত্রুটিগুলি দেখিয়ে দেন এবং এর নিপুণতর অনুবাদ করেন (১৯০৯)। বাংলা ভাষায় এখনও এর পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ প্রকাশিত হয়নি। রবীন্দ্রনাথ গুরু নানকের দু-একটি শ্লোকের বঙ্গানুবাদ করেছেন। জ্ঞানেন্দ্রনাথ দত্ত গদ্যে এবং কিরণচাঁদ দরবেশ পদ্যে কয়েকটি অংশের অনুবাদ করেন। সম্প্রতি হারানচন্দ্র চাকলাদারকৃত শ্রীশ্রীগুরুগ্রন্থসাহিবজী নামে গ্রন্থসাহেবের আংশিক অনুবাদ দুই খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে (১৯৫৭ ও ১৯৬২)।
ঢাকার গুরু দুয়ারা নানকশাহীতে তুলট কাগজে হাতে লেখা একটি গ্রন্থসাহেব রয়েছে। এর লিপি গুরুমুখী। লিপিগুলি তুলনামূলকভাবে আকারে বড়, কিন্তু নিখুঁত ও দক্ষ ক্যালিগ্রাফার দিয়ে লেখানো। গ্রন্থটি দীর্ঘদিনের পুরনো। লিখিত অংশের বাইরে রঙিন বর্ডার দেওয়া। বর্ডারের বাইরে কিঞ্চিৎ লতা-পাতার অলঙ্করণ আছে। ১৯৮৫ সালে পুরান ঢাকার টোলা মহল্লার শিখ ধর্মশালা থেকে এটি এখানে আনা হয়। [সমবারু চন্দ্র মহন্ত]
আরও দেখুন শিখধর্ম।