রেনেলের মানচিত্র
রেনেলের মানচিত্র (Rennell’s Atlas) বঙ্গ ও এতদ্সংলগ্ন অঞ্চলসমূহের অন্যতম প্রাচীন মানচিত্র। বাণিজ্যিক নৌপরিচালনার সুবিধার্থে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জরিপবিদ ও প্রকৌশলী জেমস রেনেলকে বঙ্গীয় নদীব্যবস্থার জরিপ ও এর মানচিত্র প্রণয়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়। রেনেল ১৭৬৩ থেকে ১৭৭৩ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকারের তরফে বাংলার এক সেট মানচিত্র প্রস্তত করেন। তাঁর ১৭৭৯ সালে মুদ্রিত বেঙ্গল এ্যাটলাস (Bengal Atlas) বাণিজ্যিক, সামরিক ও প্রশাসনিক দৃষ্টিভঙ্গির দিক দিয়ে একটি অতিমূল্যবান কাজ। শিক্ষামূলক, প্রশাসনিক ও নৌ-পরিচালনা- প্রতিটি ক্ষেত্রেই মধ্য উনিশ শতকে পেশাগত মানচিত্রের আত্মপ্রকাশের পূর্ব পর্যন্ত রেনেলের মানচিত্রই একমাত্র নির্ভরযোগ্য নির্দেশক ছিল।
আধুনিক মানচিত্রের সঙ্গে রেনেলের মানচিত্রকে মিলিয়ে দেখলে এই অঞ্চলের নদীসমূহের গতিপথের বৈচিত্র্যময় প্রকৃতির সুন্দর একটি চিত্র ফুটে ওঠে। এতে পরিষ্কার ধরা পড়ে বর্তমান সময়ে নদীর গতিপথের সঙ্গে রেনেলের সময়কার নদীর গতিপথসমূহের উলেখযোগ্য পার্থক্যটি। সেদিনকার বঙ্গীয় বদ্বীপে গঙ্গা ও যমুনার গতিপথ ছিল পৃথক। এতে দেখা যাচ্ছে ব্রহ্মপুত্র নদী তখন বর্তমানের পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের গতিপথ ধরে প্রবাহিত হতো। সে সময়ে তিস্তা সরাসরি দক্ষিণ বরাবর প্রবাহিত হয়ে বহু শাখানদীতে বিভক্ত হয়ে গঙ্গায় গিয়ে মিশেছিল। কিন্ত বর্তমানে তিস্তা নদী যমুনার উত্তরাংশের সঙ্গে একীভূত হয়েছে। রেনেলের সময়ে করতোয়া বগুড়াকে পাশ কাটিয়ে ব্রহ্মপুত্রে পতিত হতো। কিন্ত আজ এটি বাঙ্গালী নদীর সরাসরি অনুগামী হয়ে আরও উজানে ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে মিলিত হচ্ছে। রেনেলের মানচিত্রে মেঘনা ও গঙ্গার সঙ্গমস্থলটি চিহ্নিত হয়েছিল দক্ষিণ লক্ষ্মীপুরে। কিন্ত বর্তমানে এটি চাঁদপুরে সরে এসেছে।
১৯৫৬ সালে জে.পি মর্গান ও ডবিও.জি ম্যাকিনটায়ার বঙ্গীয় অববাহিকার কোয়াটারনারি ভূগঠনের উপর ব্যাপক গবেষণা চালিয়ে দেখান যে, নদীর গতিপথসমূহের বৈচিত্র্যময় প্রকৃতির পিছনে এই অঞ্চলের সাম্প্রতিক বিভিন্ন উত্থান ও অবনমন সক্রিয়ভাবে ক্রিয়াশীল। ১৭৮৭ সালের বন্যা ও একই সময়ে সংঘটিত ভূমিকম্পের যুগপৎ কারণে তিস্তা নদীর গতিপথ বদলে গিয়েছিল এবং এই পরিবর্তনই সম্ভবত নতুন করে বরেন্দ্র অঞ্চলের উত্থান ও হেলন (tilting) ঘটিয়েছিল। বরেন্দ্র ও মধুপুর অঞ্চলের প্রতিপূরণ উত্থানের (compensatory uplift) কারণে ব্রহ্মপুত্রের গতি পরিবর্তন সংঘটিত হয়, আর এই প্রতিপূরণ উত্থানের পিছনে কাজ করেছিল ঐ দুই অঞ্চলের মধ্যবর্তী এলাকার বসে যাওয়া। অনেকের ধারণা এই পরিবর্তন ১৭২০ থেকে ১৮৩০ সালের মধ্যে ঘটে থাকবে। যমুনা নদীর বর্তমান ধারাটি সৃষ্টি হওয়ার ফলশ্রুতিতে গড়াই নদী আজকের গতিপথ লাভ করেছে- যাতে গঙ্গার পানি সহজে বঙ্গোপসাগরে পতিত হতে পারে। গঙ্গা এবং এর শাখা ও উপনদীসমূহের পরিবর্তিত গতিপথসমূহ বঙ্গীয় বদ্বীপের গঠন ও বিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত।
এককথায় রেনেলের প্রণীত মানচিত্র একদিকে বঙ্গীয় বদ্বীপের নদীসমূহের গতিপথের ইতিহাসের এবং অপরদিকে এই অঞ্চলের ভূ-প্রাকৃতিক পরিবর্তনের একটি সংক্ষিপ্তসার। [সিফাতুল কাদের চৌধুরী এবং মনিরুল হক]