হান্টার কমিশন
হান্টার কমিশন সরকারিভাবে ইন্ডিয়ান এডুকেশন কমিশন (১৮৮২) নামে পরিচিত। এটি ছিল আধুনিক ভারতের ইতিহাসে প্রথম শিক্ষা কমিশন। ভারত সরকার কর্তৃক গঠিত এ কমিশনের কাজ ছিল ১৮৫৪ সালের উড-এর শিক্ষা প্রস্তাবের সময় থেকে ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার পর্যালোচনা এবং পরবর্তী অগ্রগতি সাধনের জন্য করণীয় সম্পর্কে সুপারিশ করা। সরকার আরেকটি উদ্দেশ্যে এ তদন্ত শুরু করতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল এবং তা ছিল ১৮৫৪ সালের ডেসপ্যাচের সুপারিশমালা বাস্তবায়নে সরকারের ব্যর্থতার অভিযোগে ইংল্যান্ডে মিশনারিদের বিক্ষোভ পর্যালোচনা করা। সরকার কর্তৃক প্রাথমিক শিক্ষার উপর অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করার কারণে কমিশনের মূল অংশ থেকে উচ্চ শিক্ষাকে বাদ দেওয়া হয় এবং তার পরিবর্তে প্রাথমিক শিক্ষার উপরই প্রধানত দৃষ্টি নিবদ্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হয়।
স্যার উইলিয়ম উইলসন হান্টারকে সভাপতি করে গঠিত এ কমিশনের অন্যান্য সদস্যগণ ছিলেন আনন্দমোহন বসু, এ.ডব্লিউ ক্রফট্ (Director of Public Instruction, Bengal), ভূদেব মুখোপাধ্যায়, মহারাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর, কাশীনাথ ত্রিম্বক তীলং এবং স্যার সৈয়দ আহমদ খান। অবশ্য সৈয়দ আহমদ খান পরবর্তীসময়ে তাঁর পুত্র সৈয়দ মুহম্মদের পক্ষে নিজের নিযুক্তি প্রত্যাহার করে নেন।
কমিশন ১৮৮৩ সালের অক্টোবর মাসে রিপোর্ট পেশ করে। প্রাথমিক শিক্ষা বিষয়ক এর ছত্রিশটি সুপারিশ প্রাথমিক শিক্ষার মন্থর অগ্রগতির ক্ষেত্রে নতুন গতিশীলতা আনয়ন করে। কমিশনের রিপোর্টে বলা হয় যে, যখন শিক্ষার প্রত্যেকটি শাখাই যথার্থভাবে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দাবি করতে পারে, তখন দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে গণপ্রাথমিক শিক্ষা, এর শর্তাবলি, বিস্তার ও এর উৎকর্ষকে শিক্ষা ব্যবস্থার অংশ হিসেবে ঘোষণা দেওয়া এবং প্রাথমিক শিক্ষার প্রতি সরকারের পূর্বেকার প্রচেষ্টার তুলনায় আরও ব্যাপকভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করা উচিত। এ কমিশন সুপারিশ করে যে, (১) প্রাথমিক শিক্ষাকে জনগণের শিক্ষা হিসেবে বিবেচনা করতে হবে এবং জীবন ঘনিষ্ঠ বিষয়সমূহের ওই শিক্ষা মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রদান করা হবে এবং তা কোনক্রমেই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা ব্যবস্থার অংশ হবে না; (২) আইনের মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষার সম্ভাব্য সর্বোচ্চ বিস্তৃতি নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে; (৩) স্কুলগুলিকে প্রাথমিক শিক্ষা বিকাশের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করে যেখানে দেশীয় স্কুল রয়েছে সেখানে সেগুলিকে সহযোগিতা প্রদান এবং সেগুলির মানোন্নয়নের ব্যবস্থা করতে হবে; (৪) প্রাথমিক শিক্ষাকে জনশিক্ষার সামগ্রিক ব্যবস্থার ওই অংশ হিসেবে ঘোষণা করতে হবে, যেখানে শিক্ষা খাতে নির্দিষ্টকৃত স্থানীয় অর্থের উপর এর প্রায় একচেটিয়া দাবি রয়েছে এবং প্রাদেশিক রাজস্বের উপরও তার বড় রকমের দাবি আছে এবং (৫) পৌর ও স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকার (Municipal and Local Self-Government Boards) উভয়কেই স্বতন্ত্র স্কুল ফান্ড রাখতে হবে। কমিশনের আরও কিছু সুপারিশ ছিল- যেমন, পরিদর্শন ও তত্ত্বাবধান, সম্ভবপর স্থানে নৈশ বিদ্যালয় স্থাপন, গ্রামীণ পরিবারের সুবিধানুযায়ী বিদ্যালয়ে অবস্থানের সময় নির্ধারণ, ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান প্রভৃতির ব্যবস্থা করা।
কমিশন এও বিশ্বাস করে যে, সমাজের সুষম অগ্রগতির জন্য প্রাথমিক শিক্ষার মতো উচ্চ শিক্ষারও সমভাবে প্রয়োজন আছে এবং এ কারণে কমিশন মাধ্যমিক শিক্ষা বিষয়েও তেইশটি সুপারিশ করে। কমিশন সুপারিশ করে যে, স্থানীয় সমর্থন পাওয়া যাক বা না যাক, প্রাথমিক শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে, কিন্তু ইংরেজি মাধ্যমিক স্কুলসমূহকে স্থানীয় সহযোগিতা লাভের সাপেক্ষে সমর্থন দিতে হবে। ভারত সরকার কমিশনের দেওয়া প্রায় সকল সুপারিশই অনুমোদন করে। [জাহেদা আহমেদ]