সংস্কৃতি সংসদ
সংস্কৃতি সংসদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন। মুক্ত বুদ্ধির চর্চা ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটানোর লক্ষ্যে ১৯৫১ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তী সময়ে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতি সংসদ’ নামে এর পুনঃনামকরণ করা হয়। মূলত সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারা ও রুশবিপ্লব প্রভাবিত আদর্শ দ্বারা সংসদ পরিচালিত হতো। এটি ছিল সাম্রাজ্যবাদ ও স্বৈরাচারবিরোধী, অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রগতিশীল মননশীলতায় বিশ্বাসী এবং গণআন্দোলনভিত্তিক একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান।
সংস্কৃতি সংসদ গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন জনাব ওবায়দুল হক সরকার, আনওয়ারুল আজীম, হাসান হাফিজুর রহমান, এ.জেড.এম ওবায়দুল্লাহ খান, মুনীর চৌধুরী ও খান সারওয়ার মুরশিদ। পূর্ব বাংলার তরুণ বুদ্ধিজীবী, কবি, সাহিত্যিক, সংস্কৃতিসেবী, সাংবাদিক ও গবেষকরা বিভিন্নভাবে এ সংসদের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সংসদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন খান সারওয়ার মুরশিদ এবং সাধারণ সম্পাদক মুস্তাফা নূরউল ইসলাম।
পাকিস্তান আমলে পূর্ব বাংলার সংস্কারমুক্ত সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের পথিকৃৎ ছিল এ সংস্কৃতি সংসদ। ১৯৫১ সালের ৪ সেপ্টেম্বর মাহবুব আলী ইনস্টিটিউটে বিজন ভট্টাচার্যের জবানবন্দী নাটক মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে সংস্কৃতি সংসদ আত্মপ্রকাশ করে। এ নাটকে প্রথম নারী চরিত্রে অভিনয় করে ছাত্রীরা। এর ফলে নাট্যচর্চায় এক নতুন ধারার প্রবর্তন হয়। পর্যায়ক্রমে সংস্কৃতি সংসদ তুলসী লাহিড়ীর পথিক (১৯৫৩), মেঘনাদবধ কাব্যের প্রথম সর্গ (১৯৫৪), বনফুলের কবয় (১৯৫৪) এবং রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবী (১৯৫৬) মঞ্চস্থ করে। এছাড়া সংসদের উদ্যোগে নৃত্যনাট্য শ্যামা (১৯৬২ ও ১৯৬৪) ও জ্বলছে আগুন ক্ষেতে খামারে (১৯৬৬) মঞ্চস্থ হয়। সংসদ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, যেমন দেশাত্মবোধক গান ও গণসঙ্গীতসহ বিভিন্ন সঙ্গীতানুষ্ঠান, নৃত্যানুষ্ঠান, রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্ত বার্ষিকী উদ্যাপন, নিয়মিত সাহিত্য সভা ও আলোচনা সভার আয়োজন করে। পোস্টার ও দেয়াল পত্রিকা প্রকাশের ক্ষেত্রেও সংস্কৃতি সংসদ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। সংসদ ১৯৫৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে দশ দিনব্যাপী একটি সাংস্কৃতিক কর্মসূচির আয়োজন করে, যার অন্তর্ভুক্ত ছিল নাটক, কাব্যনাটক, সঙ্গীত, সাহিত্যালোচনা এবং আলোকচিত্র প্রদর্শনী। ফলে সংস্কৃতি সংসদ বাংলা একাডেমীর স্বীকৃতি এবং আর্থিক সহায়তা লাভ করে।
উল্লিখিত ব্যক্তিবর্গ ছাড়াও প্রগতিশীল চিন্তার অধিকারী এবং শিল্পসংস্কৃতি অঙ্গনের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, যেমন গিয়াসউদ্দীন আহমদ, আ.ন.ম গোলাম মোস্তফা, মুজিবুর রহমান খান, রফিকুল ইসলাম, সন্জীদা খাতুন, মোহম্মদ মনিরুজ্জামান, মমতাজউদ্দীন আহমদ, বজলুল করিম, জিয়া হায়দার, জহিরুল হক, আবদুল্লাহ আল মামুন, রামেন্দু মজুমদার, ফারুক আলমগীর, রশীদ হায়দার, আসাদ চৌধুরী, মুসা আহমদ, আতাউর রহমান, কামরুন্নাহার লাইলী, মালেকা বেগম, ফেরদৌসী মজুমদার, সুলতানা রেবু প্রমুখ সংস্কৃতি সংসদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
কমিউনিস্ট পার্টি পরিচালিত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাকাল (১৯৫২) থেকে সংস্কৃতি সংসদ ছিল এর একটি সহযোগী সংগঠন। কিন্তু ১৯৬৫ সালে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট রাজনীতির মতপার্থক্যের কারণে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন বিভক্ত হয়ে গেলে সংস্কৃতি সংসদও বিভক্ত হয়ে যায় এবং পরবর্তীকালে সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে এর ভূমিকা বহুলাংশে স্তিমিত হয়ে পড়ে। বর্তমানে এর কোনো কার্যক্রম নেই। [সমবারু চন্দ্র মহন্ত]