রামকোট বনাশ্রম
রামকোট বনাশ্রম একটি প্রসিদ্ধ বৌদ্ধ বিহার। কক্সবাজার জেলার রামু থানার অন্তর্গত রাজারকুলে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার প্রধান সড়কের পূর্ব পাশে পাহাড়ঘেরা অরণ্য-পরিবেশে এটি অবস্থিত। এই বিহারকে কেন্দ্র করে এক সময় এ অঞ্চলে বৌদ্ধ শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছিল।
ছোট-বড় সতেরোটি পাহাড় বেষ্টিত রামকোট বনাশ্রম। পাহাড়ের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে এ আশ্রম এলাকায় প্রাচীন ইটের স্তূপ, বুদ্ধমূর্তির ভগ্নাবশেষ এবং পোড়ামাটির ফলক এখনও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। বর্তমানে যে বিহারটি রয়েছে তা একটি অনুচ্চ টিলার উপর অবস্থিত। বিহারটিতে ব্যবহূত ইটের পরিমাপ ৯ ইঞ্চি × ৭ ইঞ্চি × ২ ইঞ্চি। সম্পূর্ণ বিহারটি ৩৪ ফুট × ১৯ ফুট আয়তাকার। এর চূড়ার উচ্চতা ৪০। বিহারের দক্ষিণ পাশের একটি ছোট পাহাড় থেকে একটি শিলালিপি পাওয়া গিয়েছিল, কিন্তু তা বিনষ্ট হয়ে গেছে।
প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, ১৯৩০ সালে জগৎচন্দ্র মহাথের নামে এক ব্রহ্মদেশীয় ভিক্ষু শ্রীলঙ্কায় অবস্থানকালে একখানি শিলালিপি উদ্ধার করেন। শিলালিপির তথ্যানুযায়ী অনুসন্ধান ও খননকার্যের ফলে এ বিহারটি আবিষ্কৃত হয়। সেই সঙ্গে আবিষ্কৃত হয় বৃহদাকার অভয়মুদ্রায় খচিত বুদ্ধমূর্তি। বর্তমানে মূর্তিটি বনাশ্রম বিহারে রক্ষিত আছে। ভক্তরা এ মূর্তির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন।
বিহারের পূর্বদিকের পাহাড়ে একটি বৃহদাকার দালানের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়। এর চারদিকে ছড়িয়ে রয়েছে বেলেপাথর নির্মিত ভাস্কর্যের ভগ্নাংশসমূহ। সেসবের মধ্যে বুদ্ধের পদচিহ্ন, হস্ত ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। আশ্রমের দক্ষিণ-পূর্বদিকে অবস্থিত এখানকার গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানটি। এখানে মাটি থেকে ভেসে ওঠা গোলাকার স্তূপের ধ্বংসাবশেষ দেখে মনে হয় এটি ছিল একটি সংঘারাম।
চট্টগ্রাম ও আরাকান অঞ্চলের রাজা চেন্দি (চেঁদী)-র পুত্র কেয়ক্চু (কেয়ঁজউল) ভিক্ষুত্ব গ্রহণ করে চন্দ্রজ্যোতি নাম ধারণ করেন। তিনি ত্রিপিটকে ব্যুৎপত্তি লাভ করে ধর্মপ্রচারে বের হন। আগরতলা রাজার সহায়তায় তিনি কুমিল্লার লালমাই পাহাড়ে একটি বিহার প্রতিষ্ঠা করেন। পরে সীতাকুন্ড পাহাড়, চক্রশালা এবং চেঁদীরপুনি গ্রামে বিহার ও ধাতুচৈত্য প্রতিষ্ঠা করে রামকোটে এসে পৌঁছান। রামকোটে তিনি দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করে সাতটি ধাতুচৈত্য ও বিহার প্রতিষ্ঠা করেন, যার স্মৃতিচিহ্ন এখনও দেখা যায়।
বর্তমানে রামকোট বনাশ্রম বিহারে পূজার্চনা চলে এবং সেখানে একজন ভিক্ষু ও চারজন শ্রমণ বাস করেন। বিহারের উত্তর পার্শ্বেই রয়েছে বৌদ্ধগ্রাম। এ গ্রামের জনসাধারণ বিহারের যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করে। এখানে ‘অরিয়ধম্ম পাঠাগার’ নামে একটি পাঠাগার আছে।
রামকোট বনাশ্রমের গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য সংরক্ষণের লক্ষ্যে সেখানে গড়ে উঠেছে ‘জগজ্জ্যোতি শিশুসদন’ নামে একটি সেবাপ্রতিষ্ঠান। এর উদ্দেশ্য শিশুসেবা ও শিশুর মেধাবিকাশে সহায়তা করা। ইতালীয় মানবপ্রেমিক ফাদার লুইজি লুফি ১৯৯৪ সালের ৮ জানুয়ারি সদনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে ‘শরণ’ নামে একটি সংগঠন। পাঁচ থেকে এগারো বছরের পিতৃমাতৃহীন দুস্থ শিশুরা এখানে আশ্রয় পায়। তাদের সব প্রকার খরচ সদনই বহন করে। সদনের নিয়মানুযায়ী ১৮ বছর বয়সের পরে আর কাউকে রাখা হয় না। [রেবতপ্রিয় বড়ুয়া]