হিন্দু মেলা
হিন্দু মেলা বাঙালিদের মাঝে জাতীয়তাবাদী চেতনা জাগরণের উদ্দেশ্য নিয়ে উনিশ শতকের ষাটের দশকের শেষ দিকে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন। এর পেছনে প্রেরণা ছিলেন ন্যাশনাল পেপার-এর সম্পাদক নবগোপাল মিত্র। হিন্দুদের অতীত গৌরব পুনরুজ্জীবিত এবং পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে দেশীয় সভ্যতার প্রেক্ষাপটে ব্যাখ্যা করার উদ্দেশ্য সামনে রেখে তিনি জনগণ, বিশেষত শিক্ষিত যুবাদের, একত্রিত করার পরিকল্পনা করেন। মেলার লক্ষ্য ছিল জনগণকে হিন্দু সভ্যতার গৌরব সম্পর্কে সচেতন করে তোলা, তাদেরকে জাতীয় ভাষা ও জাতীয় ধ্যান-ধারণা চর্চা করতে এবং জাতীয় প্রতীকসমূহকে সম্মান জানাতে প্রভাবিত করা। প্রাচীন হিন্দু সভ্যতার শ্রেষ্ঠ দিকগুলির পুনরুজ্জীবনের মাধ্যমে ব্রিটিশদের সাংস্কৃতিক উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার নবগোপাল মিত্রের ধারণাকে ঠাকুর পরিবারের কয়েকজন সদস্য দৃঢ়ভাবে সমর্থন করেন, যারা এ নতুন আন্দোলনের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের প্রধান যোগানদার ছিলেন।
১৮৬৭ সালের এপ্রিল মাসে চৈত্র সংক্রান্তির দিনে (বাংলা বছরের শেষ দিন) হিন্দু মেলা প্রতিষ্ঠিত হয়। এ উপলক্ষ্যে এক প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। শিল্পকর্ম, হস্তশিল্প, কুটিরশিল্প ইত্যদি সব দেশীয় পণ্য প্রদর্শিত হয়। মেলার প্রথম দিন একটি আনুষ্ঠানিক কমিটি গঠিত হয়। গণেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম সচিব এবং মেলার মূল আয়োজক নবগোপাল মিত্র সহকারী সচিব হন। অন্যান্যদের মধ্যে যারা মেলার সাথে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত হন তাঁরা হলেন রাজা কমল কৃষ্ণ বাহাদুর, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, রামানাথ ঠাকুর, পেয়ারীচরণ সরকার, রাজনারায়ণ বসু, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কৃষ্টদাস পাল।
‘চৈত্র মেলা’ বা আয়োজকগণ কর্তৃক ‘জাতীয় মেলা’ বলে অভিহিত প্রথম তিনটি বার্ষিক সমাবেশ, চৈত্র সংক্রান্তির দিন অনুষ্ঠিত হয়। বার্ষিক মেলাটি দ্বিজেন্দ্রনাথের দেশাত্মবোধক সংগীত ‘মলিন মুখচন্দ্র মা ভারত তোমারি’ দিয়ে উদ্বোধন করা হয়। জ্ঞানেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে বেলগাছিয়ায় অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় বার্ষিক মেলায় (১৮৬৮) সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত দেশাত্মবোধক সংগীত ‘গাও ভারতের জয়’ উপস্থাপন করা হয়। এর পরে অনুষ্ঠিত সকল মেলা এ সঙ্গীত দিয়ে উদ্বোধন করা হয় এবং এটি এত জনপ্রিয়তা অর্জন করে যে, এটি সদ্যোজাত জাতীয়তাবাদীদের জাতীয় সঙ্গীতে পরিণত হয়। পরে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘বন্দে মাতরম’ সঙ্গীতটি এর স্থান অধিকার করে। ওই একই সমাবেশে দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত নতুন দেশাত্মবোধক গান ঠাকুর পরিবারের সদস্য হেমেন্দ্রনাথ কর্তৃক পরিবেশিত হয়।
প্রায় আরও ছ’বছর ধরে বিরাট আড়ম্বর ও জাঁকজমকপূর্ণভাবে মেলার বার্ষিক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। প্রদর্শনী সমভিব্যাহারে বার্ষিক সমাবেশ কবিতা, গান-বাজনা, নাটক ও বাংলা ভাষার অন্যান্য সকল শাখায় ও লোকগীতিতে দেশাত্মবোধের ঢেউ সৃষ্টি করতে সফল হয়। এর কার্যবিবরণী সকল সংবাদপত্র ও সাময়িকীতে বিশদভাবে প্রকাশিত হয়। মেলাটি সাফল্যের উচ্চ শিখরে পৌঁছে ১৮৭৫ সালের বার্ষিক সমাবেশে। রাজনারায়ণ বসু এতে সভাপতিত্ব করেন। এ সমাবেশেই ১৪ বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর স্বরচিত কবিতা ‘হিন্দু মেলার উপহার’ আবৃত্তি করেন এবং কবিতাটি অমৃত বাজার পত্রিকায় ১৮৭৫ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত হয়।
এরপর থেকে হিন্দু মেলা তার প্রদর্শনী ও সমাবেশসমূহে কম সংখ্যক লোককেই আকৃষ্ট করতে পেরেছে। এর প্রধান কারণ ছিল ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদের সমকালীন অগ্রগতির পাশাপাশি চলার ক্ষেত্রে মেলার ব্যর্থতা। হিন্দু ভারতের পুনর্জাগরণের ব্যাপারে নবগোপালের স্বপ্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির নতুন প্রজন্মের নিকট থেকে সমর্থন পেতে ব্যর্থ হয়, যাদের নিকট ধর্ম-ভিত্তিক জাতীয়তাবাদ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে বিচক্ষণ বলে মনে হয়নি। তারা সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী ও আনন্দমোহন বসু কর্তৃক প্রবর্তিত নতুন ধর্মনিরপেক্ষ সংগঠন ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের প্রতি আকৃষ্ট হয়। সাম্প্রদায়িকতা ছাড়াও হিন্দু মেলার আরেকটি বিরাট দুর্বলতা ছিল - এর সংগঠকদের রাজনৈতিক কর্মকান্ডের সাথে সম্পৃক্ত না হওয়ার দৃঢ় সঙ্কল্প। এর অধিকাংশ শিক্ষিত সদস্য, সে সময়ে নিজেরা রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হতে উদগ্রীব ছিলেন। তাঁরা মনে করতেন রাজনীতি ব্যতিরেকে দেশাত্মবোধ জাগানো সম্ভব নয়। অধিকন্তু, ঠাকুর পরিবারের সদস্যবৃন্দ, যারা বুদ্ধিগত দিক থেকে মেলায় নেতৃত্ব দিতেন এবং এর ব্যয় বহন করতেন, মেলার প্রতি উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। এভাবে উনিশ শতকের আশি ও নববইয়ের দশকের নতুন ও জটিল প্রয়োজনসমূহের সাথে খাপ খাওয়াতে না পেরে উনিশ শতকের নববইয়ের দশকে হিন্দু মেলা ক্রমশ ম্লান হয়ে বিলুপ্ত হয়ে যায়। কিন্তু এ সংগঠন যে স্বদেশী চেতনা জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই। বিশ শতকের প্রথমদিকে স্বদেশী আন্দোলনের অবয়বে এই চেতনারই প্রকাশ ঘটেছিল। [সিরাজুল ইসলাম]