সুলায়মান কররানী
সুলায়মান কররানী বাংলায় কররানী বংশের পরাক্রমশালী শাসক। নিজ ভাই তাজ খানের উত্তরসূরি হিসেবে ১৫৬৩ হতে ১৫৭২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি বাংলা শাসন করেন।
ক্ষমতালাভের পর সুলায়মান কররানী বাংলায় শান্তি স্থাপনে নিয়োজিত হন এবং তাঁর রাজধানী গৌড় হতে মালদহের ১৫ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত তান্ডায় স্থানান্তর করেন। শূর বংশের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখার অবলুপ্তির ফলে আফগানদের মধ্যে তাঁর সম্ভাব্য কোন প্রতিপক্ষ ছিল না। এ সময় মুগলদের হাতে দিল্লি, অযোধ্যা, গোয়ালিয়র এবং এলাহাবাদের পতন হলে বহু সংখ্যক আফগান বাংলায় আশ্রয়গ্রহণ করেন। তাঁদের সাহায্যে সুলায়মান কররানী এক শক্তিশালী সেনাবাহিনী গঠন করেন। এছাড়া তাঁর অধীনে ছিল এক হাজার যুদ্ধ হস্তীর এক বাহিনী।
কূটনৈতিক ক্ষেত্রেও সুলায়মান কররানী দূরদর্শিতার প্রমাণ দেন। রাজ্যের শান্তি ও নিরাপত্তা বিধানের জন্য তিনি মুগলদের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপনের প্রয়োজনীতা উপলব্ধি করেন। তিনি মুগলদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বিরোধিতা পরিহার করে চলেন। তিনি তাঁর সাম্রাজ্যের পশ্চিম সীমান্তে নিয়োজিত মুগল কর্মকর্তাদেরকে সাধারণত মূল্যবান উপহার ও বন্ধুত্বপূর্ণ চিঠিপত্র পাঠিয়ে সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টা করতেন। তিনি মুনিম খান মারফত মাঝে-মধ্যে আকবরের দরবারেও অতি মূল্যবান উপঢৌকন প্রেরণ করতেন। কখনও তিনি প্রকাশ্যে সার্বভৌমত্ব দাবি করেন নি। তিনি আকবরের নামে খুৎবা পাঠ এবং মুদ্রা প্রচলন করেন। আপাতদৃষ্টিতে মুগলদের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করলেও তিনি নিজে ‘হজরত-ই-আলা’ উপাধি গ্রহণ করেন, যা থেকে বোঝা যায় যে, কার্যত তিনি ছিলেন স্বাধীন।
পশ্চিম সীমান্তে শান্তি স্থাপনের পর সুলায়মান কররানী রাজ্যবিস্তারের দিকে মনোনিবেশ করেন। ১৫৬৭-৬৮ খ্রিস্টাব্দে আকবর যখন চিতোর অভিযানে ব্যস্ত, তখন সুলায়মান তাঁর পুত্র বায়েজীদ কররানীর নেতৃত্বে উড়িষ্যায় একটি অভিযান প্রেরণ করেন। এখানে বায়েজীদের সহকারী ছিলেন বীর সেনাপতি কালাপাহাড় ওরফে রাজু। এই যুদ্ধে বায়েজীদের নিকট উড়িষ্যার রাজা হরিচন্দন মুকুন্দদেব পরাজিত ও নিহত হন। ইতোমধ্যে স্বয়ং সুলায়মান উড়িষ্যার দিকে অগ্রসর হন এবং এর রাজধানী তাজপুর অধিকার করেন। কালাপাহাড়ের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর একাংশ পুরী পর্যন্ত অগ্রসর হয় এবং গ্রামাঞ্চল দখল করে। সুলায়মান কররানী লোদী খান এবং কতলু লোহানীকে যথাক্রমে উড়িষ্যা ও পুরীর গভর্নর পদে নিয়োগ করেন।
সুলায়মান কররানী যখন উড়িষ্যা অভিযানে ব্যস্ত, সেসময় কোচ রাজা বিশ্ব সিংহ তাঁর পুত্র শুক্লধ্বজ ওরফে চিলা রায়-এর নেতৃত্বে একটি সৈন্যবাহিনী বাংলার উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল আক্রমণে প্রেরণ করেন। কিন্তু অভিজ্ঞ সেনাপতি কালাপাহাড় কোচ বাহিনীর সম্মুখীন হলে সম্পূর্ণ অসহায় অবস্থায় শুক্লধ্বজ বন্দি হন। পরবর্তী পর্যায়ে কালাপাহাড় কোচবিহারের রাজধানী অবরোধ করেন।
ইতোমধ্যে সদ্য বিজিত উড়িষ্যায় বিদ্রোহ দেখা দেয়। এছাড়াও সম্ভাব্য মুগল আক্রমণের আশংকায় বিচক্ষণ কূটনীতিবিদ সুলায়মান উত্তর সীমান্তে শক্তিশালী মিত্রবাহিনীর প্রয়োজীয়তা অনুভব করেন। ফলে তিনি কালাপাহাড়কে ফিরিয়ে এনে কোচ রাজাকে তাঁর রাজ্যে পুনরায় অধিষ্ঠিত করেন এবং ১৫৬৮ খ্রিস্টাব্দে যুবরাজকে মুক্তি দান করেন।
সুলায়মান কররানী আট বছরকাল বাংলার শাসকরূপে দায়িত্ব পালন করেন। এই সময়ে বাংলার সালতানাত বিশাল শক্তির অধিকারী এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের এক প্রভাব বিস্তারকারী শক্তিতে পরিণত হয়। এর সীমা কোচ সীমান্ত হতে উড়িষ্যার পুরী পর্যন্ত এবং শোন নদী থেকে ব্রহ্মপুত্র পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
একজন বিজ্ঞ এবং প্রজাহিতৈষী শাসক হিসেবে সুলায়মান কররানী সুনাম অর্জন করেন। কর্মঠ, পরিশ্রমী এবং কঠোর প্রশাসক কররানী বিচারক হিসেবেও ছিলেন সৎ এবং ন্যায়পরায়ণ। তাঁর রাজ্যে শান্তি এবং স্থিতিশীলতা বিরাজমান ছিল। সুলায়মান কররানী একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান ছিলেন। তিনি ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানসমূহ যথাযথভাবেই পালন করতেন। তিনি বিদ্বান ও সুফিদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। ১৫৭২ খ্রিস্টাব্দের ১১ অক্টোবর তাঁর মৃত্যু হয়। [এ.বি.এম শামসুদ্দীন আহমেদ]