সরকার, অক্ষয়চন্দ্র
সরকার, অক্ষয়চন্দ্র (১৮৪৬-১৯১৭) সাহিত্যিক, সমালোচক। হুগলী জেলার চুঁচুড়ায়, কায়স্থ পরিবারে ১৮৪৬ সালের ১১ ডিসেম্বর, তাঁর জন্ম হয়। তাঁর পিতা গঙ্গাচরণ সরকার আইন পাস করে প্রথমে মুন্সেফ ও পরে সাব-জজ হন। অক্ষয়চন্দ্র সরকার ১৯৬৭ সালে বিএ পাশ করেন এবং ১৮৬৮ সালে বিএল করে বহরমপুরে ওকালতি করেন। এ সময় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বহরমপুরে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে আসলে অক্ষয়চন্দ্র সরকার তাঁর সঙ্গে পরিচিত হন। এ পরিচয় প্রগাঢ় বন্ধুত্বে পরিণত হয়। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় বঙ্গদর্শন (১৮৭২) প্রকাশিত হলে অক্ষয়চন্দ্র সরকার তার অন্যতম লেখক হন। তাঁর প্রথম রচনা ‘উদ্দীপনা’ এতে প্রকাশিত হয়। এ সময়ে তিনি নিজেও একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা সাধারণী (১৮৭৩) সম্পাদনা করেন। এ পত্রিকাটি তিনি নিরবচ্ছিন্নভাবে সতেরো বছর সম্পাদনা করেন।
১৮৭৬ সালে ‘ভারত-সভা’ প্রতিষ্ঠিত হলে অক্ষয়চন্দ্র সরকার এর প্রথম সহকারী যুগ্মসম্পাদক নির্বাচিত হন। তিনি তিন বার (১৮৯৭, ১৮৯৮ ও ১৯১৩ সালে) বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষদের সহসভাপতি ছিলেন। বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষদের উদ্যোগে ১৩১৮ সনের ১৯-২১ ফাল্গুন চুঁচুড়ায় পঞ্চম বঙ্গীয়-সাহিত্য-সম্মিলন হয়। অক্ষয়চন্দ্র সরকার এর অভ্যর্থনা-সমিতির সভাপতি হয়েছিলেন। পরের বছর ৯-১০ চৈত্র চট্টগ্রামে ষষ্ঠ বঙ্গীয়-সাহিত্য-সম্মিলন অনুষ্ঠিত হলে, তিনি এর সভাপতি নির্বাচিত হন।
বঙ্গদর্শন পত্রিকার লেখক হিসেবে অক্ষয়চন্দ্র সরকারের সাহিত্যিক-খ্যাতি অর্জিত হলেও, সারদাচরণ মিত্রের সঙ্গে যৌথ সম্পাদনায়-প্রাচীন কাব্যসংগ্রহ (১৮৭৪-৭৭), নিজের লেখা গোচারণের মাঠ (১৮৮০) -যা যুক্তাক্ষর বর্জিত পয়ার ছন্দে লেখা পলিচিত্র এবং নবজীবন (১৮৮৪-১৮৮৯) পত্রিকা সম্পাদনা তাঁকে সর্বসাধারণের মধ্যে সমধিক পরিচিত করে তোলে। নবজীবন পত্রিকাটি ধারণ করেছিল সমকালের সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্ম, রাজনীতি ও সাহিত্য-সমালোচনার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যেসব বিষয় নিয়মিত আলোচনা করতেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, নবীনচন্দ্র সেন, অক্ষয়চন্দ্র সরকার প্রমুখ কবি ও সাহিত্যিক। সে সময়ে এঁদের সাহিত্য, সমাজ ও ধর্মভিত্তিক আলোচনাগুলি প্রধানত সম্পাদকের মধ্যবর্তিতায় আলোচিত হয়েছে। নবজীবন সম্পাদনাকালেই অক্ষয়চন্দ্র সরকার বিশেষ করে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ভক্তিমান শিষ্য হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তবে অক্ষয়চন্দ্র সরকার সাহিত্য রচনায় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ভাষারীতি অনুসরণ করলেও তাঁর নিজস্বতা ছিল। তাঁর আত্মজীবনী পিতা-পুত্র গ্রন্থে তাঁর ভাষার বিশিষ্টতা যেমন লক্ষ করা যায়, তেমনি লক্ষ করা যায় সেকালের সামাজিক ও সাহিত্যিক ঘটনাবলী। অক্ষয়চন্দ্র সরকারের অন্যান্য রচনার মধ্যে সমাজ-সমালোচনা (১৮৭৪), সংক্ষিপ্ত রামায়ণ (১৮৮২), সনাতনী (১৯১১), কবি হেমচন্দ্র (১৯১২) প্রভৃতি প্রধান। ১৯১৭ সালের ২ অক্টোবর তাঁর মৃত্যু হয়। [মুহম্মদ সাইফুল ইসলাম]