শিওয়ালিক নদী
শিওয়ালিক নদী ইন্দো-ব্রাহ্ম নদী (Indo-Brahm River) নামেও পরিচিত। মধ্য মায়োসিন কালের (আনুমানিক ১ কোটি বছর পূর্বে) প্রচন্ড গিরিজনির (Orogenesis) ফলে হিমালয় পর্বত এবং এর শাখা-প্রশাখা যথা আসামের নাগা ও লুসাই এবং চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড় শ্রেণীর সৃষ্টি হয় এবং উপমহাদেশ থেকে টেথিস সাগরের সম্পূর্ণ বিলুপ্তি ঘটে। হিমালয় পর্বতের উৎপত্তির সঙ্গে সঙ্গে এর সম্মুখে একটি সম্মুখ খাতেরও (Foredeep) উৎপত্তি হয়। এই সম্মুখখাত পূর্বে আসাম থেকে পশ্চিমে পাকিস্তানের পটোয়ার পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
হিমালয়ের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে অসংখ্য খরস্রোতস্বিনীর সৃষ্টি হয়। এ সমস্ত স্রোতধারা নতুন জেগে ওঠা পর্বতমালাকে আড়াআড়িভাবে ক্ষয় করে পলি বহন করে সম্মুখ খাতে নিয়ে আসতে থাকে। পরে ওই সমস্ত ছোট ছোট নদী সম্মিলিতভাবে একটি মাত্র বৃহৎ নদীর সৃষ্টি করে। স্যার ই.এইচ প্যাস্কো (Sir EH Pascoe) এবং ড. জি.ই পিলগ্রিম (Dr GE Pillgrim) নদীটির নাম দেন শিওয়ালিক বা ইন্দো-ব্রাহ্ম। ধারণা করা হয়, শিওয়ালিক নদী আসাম থেকে প্রবাহিত হয়ে হিমালয়ের পাদদেশ দিয়ে উত্তর-পশ্চিম দিকে হিমালয় পর্বতের সমান্তরালে প্রবাহিত হতো। বর্তমানে উত্তর ভারতের যেখানে শিওয়ালিক গিরিশ্রেণী (Siwalik Range) রয়েছে, নদীটি সেস্থানের উপর দিয়ে ‘প্রধান সীমানা চ্যুতি’ (Main Boundary Fault) বরাবর প্রবাহিত হচ্ছিলো। এটি পাকিস্তানের নন্নু এবং পটোয়ারে প্রবেশ করার পর মোড় পরিবর্তন করে দক্ষিণমুখী হয় এবং পরে বর্তমান সিন্ধু নদের গতিপথ ধরে প্রবাহিত হওয়ার পর আরব সাগরে পড়ে।
শিওয়ালিক নদী উক্ত সময়ে বাংলাদেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল কিনা, তা বলা বেশ কঠিন। তবে আসাম থেকে এটি উদ্ভূত হয়েছিল এতে কোনো সন্দেহ নেই। এখানে উলেখ্য যে, হিমালয়ের উত্থানের বহু পূর্ব থেকেই ব্রহ্মপুত্র এবং সিন্ধু প্রাক-ভূমিরূপ নদী (pre-antecedent river) হিসেবে উপমহাদেশে প্রবহমান ছিল। এটা মনে করা ভুল হবে না যে, মধ্য মায়োসিন কালের প্রচন্ড গিরিজনির ফলে হিমালয়ের অভ্যুত্থানের সঙ্গে সঙ্গে সম্মুখখাত এবং প্রধান সীমানাচ্যুতির সৃষ্টির ফলে আরও একটি হিমালয়ী নদীর (Himalayan river) জন্ম হয়, যা এখন গঙ্গা নামে পরিচিত।
ধারণা করা হয়, গঙ্গা নদীই সে সময় বর্তমানে যেখানে শিওয়ালিক পাহাড়শ্রেণী রয়েছে সেখান দিয়ে প্রবাহিত হতো। পরে নদীর দস্যুতা বা পানি ছিনতাই (stream piracy) প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সিন্ধু এবং ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে যুক্ত হয়ে একটি মাত্র নদী শিওয়ালিক বা ইন্দো-ব্রাহ্ম নদীতে পরিণত হয়। এই নতুন নামধারী নদীটি সম্ভবত পায়োসিন কালের শেষ (প্রায় ২০ লক্ষ বছর পূর্ব) পর্যন্ত আসাম, উত্তর ভারত এবং পাকিস্তানের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আরব সাগরে পড়ত। পরে পায়োসিনের শেষের দিকে যে হিমালয়ী চতুর্থ গিরিজনি সংঘটিত হয়, তার ফলে উত্তর ভারতে শিওয়ালিক গিরিশ্রেণী এবং পাঞ্জাবের পটোয়ার অঞ্চলে গিরিমালার উৎপত্তির কারণে এই শিওয়ালিক নদী উপমহাদেশে একক নদী হিসেবে আর অস্তিত্ব বজায় রাখতে পারে নি। এর পরিবর্তে তিনটি পৃথক নদীর উৎপত্তি হয়, যথা: সিন্ধু, গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র। [সিফাতুল কাদের চৌধুরী]