শাহ আলম, দ্বিতীয়
শাহ আলম, দ্বিতীয় (১৭৬১-১৮০৫) দিল্লির মুগল সম্রাট আজিজুদ্দীন দ্বিতীয় আলমগীরের পুত্র। তাঁর পূর্ব নাম আলী গওহর (পরবর্তী সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম)। তিনি ছিলেন পিতার মনোনীত উত্তরাধিকারী। দ্বিতীয় আলমগীরের বিবেকবর্জিত উজির গাজীউদ্দিন সম্রাটকে সম্পূর্ণরূপে স্বীয় নিয়ন্ত্রণে এনে আলী গওহরকে কড়া নজরে রাখেন। বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যায় আধিপত্য বিস্তার করে তাঁর অবস্থান মজবুত করার উদ্দেশ্যে ১৭৫৯ সালে আলী গওহর দিল্লি থেকে পালিয়ে সাম্রাজ্যের পূর্বাঞ্চলে চলে আসেন। বাংলার রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং মীরজাফরের জনপ্রিয়তার অভাব তাঁর মনে আশার সঞ্চার করে। সিংহাসনে অধিষ্ঠিত থাকার জন্য মীরজাফর সম্পূর্ণরূপে ব্রিটিশের উপর নির্ভরশীল ছিলেন। শাহ আলমও ব্রিটিশের সাহায্য কামনা করেছিলেন, কিন্তু ক্লাইভ মীরজাফরকেই ক্ষমতায় রাখতে আগ্রহী ছিলেন। ইংরেজ সৈন্যরা শাহ আলমের সৈন্যবাহিনীকে পিছু হটতে বাধ্য করে।
দিল্লিতে উজির গাজীউদ্দীনের আরও ষড়যন্ত্রের খবর পেয়ে শাহজাদা শাহ আলম বাংলা থেকে নিজের সৈন্য সামন্ত প্রত্যাহার করে নেওয়ার প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে ইংরেজদের নিরাপত্তা হেফাজত এবং তাঁর ভরণপোষণের জন্য আর্থিক সাহায্য প্রার্থণা করেন। ক্লাইভ শাহ আলমকে এক হাজার পাউন্ড প্রদান করলে তিনি বাংলা ছেড়ে চলে যান। উজির গাজীউদ্দীনের কারসাজিতে শাহ আলম বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার সুবাহদারি লাভে ব্যর্থ হন। কিন্তু ১৭৫৯ সালে গাজীউদ্দীন কর্তৃক সম্রাট আজিজুদ্দীন দ্বিতীয় আলমগীর নিহত হলে শাহজাদা আলী গওহর শাহ আলম উপাধি ধারণ করে নিজেকে সম্রাট ঘোষণা করেন। নতুন মুগল সম্রাট যিনি একদিকে মীরজাফরের এবং অন্যদিকে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নামমাত্র প্রভু ছিলেন, সহসা বিহার আক্রমণ করে। কিন্তু ইংরেজ বাহিনীর নিকট যুদ্ধে পরাজিত হয়ে তিনি তাদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করেন। রাজধানী ফেরার পথে ব্রিটিশ সৈন্যরা তাঁকে পাটনা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসে। পাটনায় বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার নতুন নওয়াব মীর কাসিম তাঁর সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎকারে মিলিত হন। বাদশাহ দ্বিতীয় শাহ আলম মীর কাসিমকে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার সুবাহদার হিসেবে অভিষিক্ত করেন এবং বিনিময়ে নওয়াব কর্তৃক বার্ষিক ২৪ লক্ষ টাকা কর প্রদানের প্রতিশ্রুতি আদায় করেন। ১৭৫১ সাল থেকে ১৭৬৪ সালে বক্সারের যুদ্ধ পর্যন্ত বাদশাহ শাহ আলম অযোদ্ধার নওয়াব সুজাউদ্দৌলার আশ্রয়ে ছিলেন।
বক্সারের যুদ্ধের পর সম্রাট শাহ আলম বস্ত্তত অসহায় অবস্থায় নিপতিত হন এবং পুনরায় ইংরেজদের কাছে নিরাপত্তা চান। এলাহাবাদ চুক্তি অনুসারে (১৭৬৫) শাহ আলম বার্ষিক ২৬ লক্ষ টাকার বিনিময়ে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতা বা দীউয়ানি প্রদান করেন। কোম্পানি কোরা ও এলাহাবাদকে বাদশাহর নিয়ন্ত্রণে রাখতে সম্মত হয়।
বাদশাহ শাহ আলম এলাহাবাদে বসবাস শুরু করেন। সেখানে তিনি শান্তিতে বাকি জীবন কাটিয়েও দিতে পারতেন। কিন্তু মুগলদের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে তিনি দিল্লিতে ফিরে যেতে চাইলেন। সুযোগও এলো। দিল্লি মারাঠা শক্তির পদানত হলো। মারাঠারা তার পূর্বপুরুষের সিংহাসন দখলের জন্য তাঁকে দিল্লি ফিরে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানাল এবং তারা মুগল সম্রাটের অধীনস্থ থেকে তাঁকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতিও দিলো। সে অনুযায়ী ১৭৭১ সালের মে মাসে শাহ আলম এলাহাবাদ থেকে দিল্লি রওয়ানা হন এবং ডিসেম্বরে দিল্লি পৌঁছেন। দিল্লি গিয়ে তিনি ইংরেজদের সাথে আলাপ করলে ইংরেজরা তাঁকে মারাঠাদের উপর নির্ভরশীল না হওয়ার পরামর্শ দেয়। সম্রাট এলাহাবাদ দুর্গে দীর্ঘ ছয় বছর ইংরেজের বন্দি হিসেবে জীবনযাপন করেন। ১৭৭২ সালে ওয়ারেন হেস্টিংস বাংলার গভর্নর নিযুক্ত হয়ে এসে সম্রাটকে বার্ষিক ২৬ লক্ষ টাকা প্রদানের চুক্তি বাতিল করেন এবং এলাহাবাদ ও কোরা অঞ্চলদ্বয় সম্রাটের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করে অযোধ্যার নবাবকে প্রদান করেন। এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দীউয়ান হিসেবে এর অবনমিত অবস্থান পরিত্যাগ করে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যায় ব্রিটিশ প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করে। ১৭৮৮ সালে সিন্ধিয়া যখন সাময়িকভাবে দিল্লি ছেড়ে যান সেই সুযোগে গোলাম কাদের নামে এক আফগান শাহ আলমের চক্ষু উৎপাটন করে তাঁকে অন্ধ করে দেয়।
ইউরোপে ফ্রান্সের সম্ভাব্য আক্রমণের মুখে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের পদক্ষেপ হিসেবে ভারতে ব্রিটিশরা শাহ আলমের ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করে। ব্রিটিশরা এই ভেবে চিন্তিত হয় যে, ফ্রান্স তার সাম্রাজ্যবাদী স্পৃহা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে ভারতে ফরাসি সামরিক অফিসারদের সহায়তায় মারাঠাদের দমন করে ফরাসি স্বার্থে বাদশাহকে ব্যবহার করবে। ১৮০৩ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ বাহিনী দিল্লি প্রবেশ করলে জরাজীর্ণ চাঁদোয়ার নিচে আসীন বৃদ্ধ অন্ধ মুগল সম্রাট শাহ আলম ইংরেজ শক্তির আশ্রয় লাভ করেন। তখন মুগল বাদশাহর এমন কোন সামরিক শক্তি ছিল না যা দিয়ে তিনি তাঁর ইচ্ছাকে বাস্তবায়িত করতে পারতেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি তৈমুরের সম্মানিত বংশধর হিসেবে সমগ্র দেশে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তখনও নওয়াব ও সুবাহদারগণ সিংহাসনে আরোহণ করে তাঁর অনুমোদন বা স্বীকৃতি প্রার্থনা করতেন এবং সম্রাট প্রদত্ত যে কোন উপাধিকে গুরুত্ব সহকারে মূল্যায়ন করতেন। এসকল নওয়াব সুবাহদার তাঁর নামে মুদ্রাঙ্কণ করতেন এবং তাঁর নামে খুতবা পাঠ করাতেন। তখন পর্যন্ত ব্রিটিশরা সরাসরি ভারতবর্ষের সার্বভৌমত্ব দাবি করার মতো শক্তি অর্জন করতে না পারায় শাহ আলমকে তাঁর মৃত্যুর (১৮০৫) পূর্ব পর্যন্ত নামমাত্র সম্রাট হিসেবে বহাল রাখে। [মোহাম্মদ শাহ]