শামস-উদ্-দৌলাহ, নওয়াব
শামস-উদ্-দৌলাহ, নওয়াব ঢাকার নায়েব নাজিম (১৮২২-১৮৩১)। তিনি ব্রিটিশ বিদ্বেষের জন্য কারাবরণ করেছিলেন। দেশকে কোম্পানি শাসন থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে ভারতের অন্যান্য রাজন্যবর্গ ও ব্রিটিশবিরোধী নেতাদের সমন্বয়ে একটি মহাপরিকল্পনা প্রণয়নে শামস-উদ্-দৌলাহ মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু পরিকল্পনাটি পরিশেষে ফাঁস হয়ে যায় এবং ফলে তিনি বন্দী হন এবং দীর্ঘকাল কারাবরণ করেন।
নওয়াব শামস-উদ্-দৌলাহ ছিলেন ঢাকার নায়েব নাজিম হাশমত জঙ্গ-এর (১৭৮১-১৭৮৮) এক কন্যাপক্ষের দৈহিত্র। তিন প্রপৌত্রের মধ্যে শামস-উদ্-দৌলাহ ছিলেন দ্বিতীয়। ১৭৮৮ সালে হাশমত জঙ্গ-এর মৃত্যুর পর তাঁর দ্বিতীয় প্রপৌত্র নসরত জঙ্গ নায়েব নাজিম-এর পদ অলংকৃত করেন। ১৮২২ সালে পুত্রহীন অবস্থায় নসরত জঙ্গ মারা গেলে তাঁর তৃতীয় ভ্রাতা শামস-উদ্-দৌলাহ নায়েব নাজিম পদে অধিষ্ঠিত হন, যদিও তিনি ইতিপূর্বে রাজদ্রোহের দায়ে কারাদন্ড ভোগ করেছেন। ১৮৩১ সালে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি উক্ত পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
নওয়াব শামস-উদ্-দৌলাহ ছিলেন ইংরেজি ভাষায় প্রাজ্ঞ। তিনি ইংরেজি শিখেছেন তাঁর নিজের সচিব মি. লী (খবব) এর নিকট থেকে। উইলিয়ম হিকী ও বিশপ হেবারের ভাষ্য থেকে জানা যায় যে, শুধু ইংরেজি ভাষায় নয়, ইউরোপীয় ইতিহাস ও ইংরেজি ক্লাসিক্যাল সাহিত্যেও তাঁর যথেষ্ঠ ব্যুৎপত্তি ছিল। তথাপি শামস-উদ্-দৌলাহ ইংরেজ শাসন মেনে নিতে পারেন নি। ভারতীয় শাসক, পরিবার ও ব্যক্তিদের মধ্যে যারা কোম্পানি আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন তাঁদের সঙ্গে তিনি সংহতি ঘোষণা করে প্রতিরোধ কর্মকান্ডে লিপ্ত হন। প্রতিরোধকল্পে তিনি মহীশূর নৃপতি টিপু সুলতান, আফগান রাজা জমান খান এবং বাংলার অনেক জমিদারের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন। রণকৌশল হিসেবে পত্রমাধ্যমে সিদ্ধান্ত হয় যে, আফগান রাজা উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে ব্রিটিশ রাজ্য আক্রমন করলে ব্রিটিশ শাসন উৎখাতের লক্ষ্যে এক ব্যাপক অভ্যুত্থান রচনা করা হবে।
তবে একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে শামস-উদ্-দৌলার পরিকল্পনা ব্রিটিশরা উদ্ঘাটন করে ফেলে। দেশকে ব্রিটিশমুক্ত করার পরিকল্পনায় অন্যতম ছিলেন অযোদ্ধার নির্বাসিত নওয়াব ওয়াজির আলী। বেনারসে তিনি নির্বাসন জীবন যাপন করছিলেন। এক পর্যায়ে ওয়াজির আলী বেনারসে ব্রিটিশ রেসিডেন্ট মি. চেরী ও তার দেহরক্ষীদের হত্যা করে অযোদ্ধার জঙ্গলে অপেক্ষমান তাঁর অনুগত বাহিনীর সঙ্গে যোগদান করেন। কিন্তু তাঁর ও বিপ্লবীদের দুর্ভাগ্য এই যে, পলায়ন কালে তিনি তাঁর চিঠিপত্রের থলেটি সঙ্গে নিতে ভুলে যান। এর মধ্যে ছিল শামস-উদ্-দৌলাহ ও ওয়াজির আলীর মধ্যে লিখিত সকল পত্রাদি। সেটি ব্রিটিশদের হস্তগত হয়।
পত্রসমূহ থেকে ইংরেজ সরকার দেশব্যাপী বিদ্রোহ পরিকল্পনাটি বিস্তারিত জানতে পারে। ঢাকা থেকে শামস-উদ্-দৌলাকে তৎক্ষণাৎ বন্দী করা হয়। তাঁর সঙ্গে ঢাকায় বন্দী করা হয় তাঁর অনেক সহযোগীকে। কলকাতায় রাজদ্রোহীতার দায়ে তাঁদের সবার বিচার হয়। বিদ্রোহ পরিকল্পনায় জড়িত থাকার দায়ে শামস-উদ্-দৌলাহকে আজীবন কারাদন্ডে দন্ডিত করা হয়।
তবে তাঁর ভ্রাতা নওয়াব নসরত জং ছিলেন ইংরেজ অনুগত। নসরত জং অনেক দেনদরবার করে বিদ্রোহী ভাইকে কলকাতার কারাগার থেকে মুক্ত করেন এবং নজরবন্দী অবস্থায় তাঁর ঢাকা শহরসীমার মধ্যে অবস্থানের ব্যবস্থা করেন। ১৮২২ সালে নসরত জং এর মৃত্যু হলে সরকার শামস-উদ্-দৌলাকে নায়েব-নাজিমের পদ গ্রহনের প্রস্তাব করলে তিনি নামেমাত্র অন্তঃসারশূন্য পদটি গ্রহণে সম্মতি প্রদান করেন। দারিদ্র্য ও নৈরাশ্যের ফলে ক্রমশই তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে। ১৮৩১ সালে নওয়াব শামস-উদ্-দৌলাহর মৃত্যু হয়। [সিরাজুল ইসলাম]
গ্রন্থপঞ্জি Nandalal Chatterjee, 'Shams-ud-Daulah's intrigues against the English', in Bengal Past and Present, vol. 53, January-June 1937; Reginal Heber, Narrative of a Journey through the Upper Provinces of India, 1824-25, vol. 1, London 1873; Memoirs of William Hickey, ed. by Alfred Spencer, vol. IV,1950; James Taylor, A Sketch of the Topography and Statistics of Dacca, Calcutta 1840.