রায়মঙ্গল

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ২২:৫৫, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)

রায়মঙ্গল মধ্যযুগীয় আখ্যানকাব্য। ব্যাঘ্র-দেবতা দক্ষিণ রায়ের মাহাত্ম্য প্রচার উপলক্ষে এ কাব্যটি রচিত হয়। দক্ষিণ রায় একজন লৌকিক দেবতা। দক্ষিণ বঙ্গের, বিশেষত  সুন্দরবন অঞ্চলের শ্রমজীবী মানুষেরা এর পূজারী। তারা যখন জীবিকার উদ্দেশ্যে সুন্দরবনে যায় তখন তারা বাঘের আক্রমণের শিকার হয়। এ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যই তারা দক্ষিণ রায়ের পূজা করে, কারণ তাদের বিশ্বাস, দক্ষিণ রায়ের পূজা মানত করলে আর বিপদ হবে না।

দক্ষিণ রায় সম্পর্কে জনমত হলো এই যে, তিনি ছিলেন যশোরের রাজা মুকুট রায়ের সেনাপতি। তিনি দক্ষিণের আঠারো ভাটি জয় করে সেখানে শাসন ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু একসময় সেখানকার গাজী খাঁ ও গাজী কালুর সঙ্গে তাঁর বিরোধ ও যুদ্ধ হয় এবং যুদ্ধে দক্ষিণ রায় পরাজিত হয়ে আঠারো ভাটির একাংশ ছেড়ে দিয়ে তাদের সঙ্গে সন্ধি ও সহাবস্থান করেন। এসব ঘটনা নিয়ে হিন্দু কবি রায়মঙ্গল এবং মুসলমান কবি  গাজী-কালু-চম্পাবতী কাব্য রচনা করেন। রায়মঙ্গলের  প্রথম কবি মাধবাচার্য, কিন্তু তাঁর কাব্য পাওয়া যায়নি। কলকাতার নিকটবর্তী নিমিতা গ্রামনিবাসী কৃষ্ণরাম এর দ্বিতীয় কবি। তিনি দক্ষিণ রায়ের স্বপ্নাদেশে কাব্যখানি রচনা করেন বলে কথিত হয়। কৃষ্ণরামই এ ধারার শক্তিমান কবি। তাঁর কাব্যের রচনাকাল ১৬৮৬ খ্রিস্টাব্দ। ১৭২৩ খ্রিস্টাব্দে হরিদেব এবং আরও পরে রুদ্রদেব রায়মঙ্গল রচনা করেন।

রায়মঙ্গলের সংক্ষিপ্ত কাহিনী হলো: পুষ্পদত্ত নামে এক বণিক সমুদ্রগামী জাহাজ নির্মাণের জন্য রতাই মউল্যাকে সুন্দরবন থেকে কাঠ সংগ্রহ করতে বলে। রতাই ছয় ভাই ও এক পুত্রসহ সুন্দরবনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে এবং দক্ষিণ রায়কে সন্তুষ্ট করে কাঠ নিয়ে ফিরে আসে। পুষ্পদত্ত মধুকর নামে জাহাজ নির্মাণ করে যথাসময়ে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। এ যাত্রায় নিরুর্দ্দিষ্ট পিতাকে উদ্ধার করাও তার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল। পথিমধ্যে খনিয়া নামক স্থানে সে দক্ষিণ রায়ের পূজা করে। সেখানে পীরের মোকাম দেখে পোতের কর্ণধারের নিকট তার ইতিহাস জানতে চায়। এ প্রসঙ্গে কর্ণধার দক্ষিণ রায় ও বড় গাজী খাঁর বিরোধ ও মিলনের কথা বিস্তৃতভাবে বর্ণনা করে। পরে পুষ্পদত্ত সমুদ্র অতিক্রম করার সময় পানির উপর তুরঙ্গ নামে এক বিচিত্র নগর দেখতে পায়। পুষ্পদত্ত নগরে উপস্থিত হয়ে সেখানকার রাজাকে তার অভিজ্ঞতার কথা বলে, কিন্তু রাজাকে অদ্ভূত নগরী দেখাতে না পেরে সে কারারুদ্ধ হয়। অবশেষে দক্ষিণ রায়ের স্তব করে সে মুক্তি পায়, কারারুদ্ধ পিতাকে মুক্ত করে এবং রাজকন্যা রত্নাবতীকে বিবাহ করে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে। রায়মঙ্গলের এ কাহিনীর সঙ্গে চন্ডীমঙ্গলের বণিক খন্ডের ধনপতি সওদাগরের কাহিনীর অংশত মিল আছে।

রায়মঙ্গলে তৎকালীন সমাজের ধর্মীয় ও সামাজিক বিশ্বাস, রীতিনীতি, রাজনীতি ইত্যাদি সম্পর্কে অনেক তথ্য আছে। বিশেষ করে দক্ষিণ বঙ্গ তথা সুন্দরবন সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য রয়েছে। দক্ষিণ রায়ের বার্ষিক পূজা উপলক্ষে গায়েনরা পালাক্রমে রায়মঙ্গল পরিবেশন করে এবং বাউল্যা, মউল্যা, মলঙ্গি প্রভৃতি শ্রমজীবী মানুষেরা এ গান ভক্তিভরে শ্রবণ করে।

[ওয়াকিল আহমদ]