রায়, সত্যজিৎ
রায়, সত্যজিৎ (১৯২১-১৯৯২) আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বাঙালি চলচ্চিত্রকার; আলোকচিত্রী, চিত্রকর, শিশুসাহিত্যিক, সঙ্গীতজ্ঞ হিসেবেও সুপরিচিত। ১৯২১ সালের ২ মে তিনি কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল বৃহত্তর ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জ জেলার মসুয়া গ্রামে। পিতা প্রখ্যাত লেখক, সম্পাদক ও আলোকচিত্রী সুকুমার রায় ছিলেন রয়াল ফটোগ্রাফিক সোসাইটি অব গ্রেট ব্রিটেন-এর ফেলো। তাঁর মাতা সুপ্রভা রায় ছিলেন একজন সঙ্গীতশিল্পী ও হস্তশিল্পে পারদর্শী এবং তাঁর পিতামহ উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীও ছিলেন প্রখ্যাত লেখক, শিশু সাহিত্যিক, চিত্রকর, আলোকচিত্রী, ব্লক ডিজাইনার এবং শিশুতোষ পত্রিকা সন্দেশ (১৯১৩)-এর সম্পাদক। জন্মের মাত্র দুই বছরের মধ্যেই পিতাকে হারিয়ে মামার আশ্রয়ে দৃঢ়চেতা মাতার তত্ত্বাবধানে সত্যজিৎ রায়ের শৈশব-কৈশোর অতিবাহিত হয়। বালিগঞ্জ সরকারি হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক ও প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অর্থনীতিতে অনার্সসহ বি.এ পাসের পর ১৯৪০ সালে সত্যজিৎ রায় শান্তিনিকেতনে ভর্তি হন।
১৯৪৩ সালে একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থার কমার্শিয়াল আর্টিস্ট হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। বিজ্ঞাপনের ভাষা ও ডিজাইনে তিনি নতুন মাত্রা সংযোজন করেন। প্রায় একই সময়ে তিনি বইয়ের প্রচ্ছদ এবং পত্রিকায় ছবি অাঁকা শুরু করেন। ১৯৪৭ সালে কয়েকজন বন্ধুর সহায়তায় গঠন করেন কলকাতা চলচ্চিত্র সংসদ। পরবর্তী বছরে তাঁর সুযোগ ঘটে ফরাসি চলচ্চিত্রকার জাঁ রেনোয়ার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার। রেঁনোয়া তাঁর পরিচালিত দ্য রিভার ছবির কিছু অংশ কলকাতায় শুটিং করেন এবং সত্যজিৎ তা প্রত্যক্ষ করেন।
পরে চলচ্চিত্র নির্মাণের উদ্দেশ্যে তিনি গঠন করেন ‘কনক পিকাচার্স’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। সত্যজিৎ এ সময় এ পারফেক্ট ডে নামে একটি চিত্রনাট্য রচনা করেন। ১৯৫০ সালে চাকরির সূত্রে পাঁচ মাস লন্ডনে অবস্থানকালে তিনি প্রায় একশ চলচ্চিত্র দেখেন এবং পরিচিত হন ব্রিটিশ চলচ্চিত্র নির্মাতা লিন্ডসে অ্যান্ডারসন, চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞ পেনেলোপি হাস্টন এবং গ্যাবিন ল্যাম্বটি-এর সঙ্গে। ইতালির ভিত্তোরিও ডি সিকা পরিচালিত দ্য বাইসাইকেল থিফ দেখে তিনি মুগ্ধ হন এবং বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস পথের পাঁচালী অবলম্বনে ছবি নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। একই বছর অক্টোবরে দেশে ফিরে তিনি এর চিত্রনাট্য রচনা করেন এবং ১৯৫২ সালে অপেশাদার লোকজন নিয়ে ছবির শুটিং শুরু করেন। বহু ধারদেনা এবং গহনা, বইপত্র ও সঞ্চিত সম্পদ বিক্রয় করেও তিনি ছবির কাজ শেষ করতে পারেন নি। নিজের জীবন বীমার পলিসি বন্ধক দিয়ে ও বন্ধুবান্ধব-আত্মীয়দের কাছ থেকে তিনি মাত্র ১৭,৫০০ টাকা সংগ্রহ করেন।
পরে তিনি ব্যয় কম করার জন্য পুরানো ক্যামেরা ভাড়া করেন, খাদ্য ও যাতায়াত খরচ কমিয়ে দেন এবং কলকাতার প্রত্যন্ত এলাকায় শু্যটিং করেন।
তিনি একজন প্রযোজকের সন্ধান করছিলেন যিনি অন্তত ৪০,০০০ টাকা অর্থায়নে সক্ষম। ছবির এক-তৃতীয়াংশ চিত্রায়িত হওয়ার পর যোগাড় করা টাকা শেষ হয়ে যায়। বাধ্য হয়ে তিনি পশ্চিমবঙ্গের সরকারের কাছে অর্থসাহায্য কামনা করেন। এ বিষয়ে আমলাদের অনীহা প্রত্যক্ষ করে মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় নিজে ছবিটির নির্মাণ ব্যয় সংকুলানের ব্যবস্থা করেন। ১৯৫৫ সালে পথের পাঁচালী নিউইয়র্কে প্রদর্শিত হয় এবং ঐ বছরই, আগস্টে কলকাতার প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত হয়। মুক্তির পরপরই ছবিটি সারা বিশ্বে প্রশংসা লাভ করে এবং পুরস্কার ও সম্মাননা অর্জন করে। ১৯৫৫ সালে পথের পাঁচালী রাষ্ট্রপতি ও পশ্চিমবঙ্গ সাংবাদিক সমিতির পুরস্কার লাভ করে। ঐ বছরই ছবিটি ফ্রান্স ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ‘সর্বশ্রেষ্ঠ মানব দলিল’ হিসেবে জুরি বোর্ডের বিশেষ পুরস্কার অর্জন করে।
ছবিটি পৃথিবীর বিভিন্ন শহর ও দেশ, যথা এডিনবার্গ, ম্যানিলা, স্পেন, সানফ্রান্সিসকো, বার্লিন, ভ্যাঙ্কুবার, ডেনমার্ক ও জাপানে পুরস্কৃত হয়। ১৯৫৬-তে মুক্তি পায় তাঁর দ্বিতীয় ছবি অপরাজিত, এটি তাঁকে এনে দেয় ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসব পুরস্কার, গোল্ডেন লায়ন, Cinema Nuveall এবং ক্রিটিকস অ্যাওয়ার্ড। ১৯৫৬ থেকে ১৯৯২-এর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত চলচ্চিত্র মিশে ছিল তাঁর চিন্তা ও কর্মে। তিনি ছিলেন বিশ্বের সেরা দশজন চলচ্চিত্রকারের মধ্যে একজন। তাঁর চলচ্চিত্র কর্মের মধ্যে রয়েছে ২৮টি পূর্ণদৈর্ঘ্য চিত্র, ৫টি তথ্যচিত্র এবং ৩টি টেলি-ফিল্ম। তাঁর নির্মিত চলচ্চিত্রসমূহের মধ্যে উলেখযোগ্য হলো: পথের পাঁচালী (১৯৫৫), অপরাজিত (১৯৫৬), পরশপাথর (১৯৫৭), জলসাঘর (১৯৫৮), অপুর সংসার (১৯৫৯), দেবী (১৯৬০), তিন কন্যা (১৯৬১), রবীন্দ্রনাথ (১৯৬১), কাঞ্চনজঙ্ঘা (১৯৬২), অভিযান (১৯৬২), মহানগর (১৯৬৩), চারুলতা (১৯৬৪), কাপুরুষ ও মহাপুরুষ (১৯৬৫), নায়ক (১৯৬৬), চিড়িয়াখানা (১৯৬৭), গুপী গাইন বাঘা বাইন (১৯৬৯), অরণ্যের দিনরাত্রি (১৯৭০), প্রতিদ্বন্দ্বী (১৯৭০), সিকিম (১৯৭১), সীমাবদ্ধ (১৯৭১), অশনি সংকেত (১৯৭৩), সোনার কেলা (১৯৭৪), ইনার আই (১৯৭৪), জনারণ্য (১৯৭৫), বালা (১৯৭৬), শতরঞ্জ কি খিলাড়ি (১৯৭৭), হীরক রাজার দেশে (১৯৮০), পিকু (১৯৮২), সদগতি (১৯৮২), ঘরে বাইরে (১৯৮৪), সুকুমার রায় (১৯৮৭), গণশত্রু (১৯৮৯), শাখা প্রশাখা (১৯৯০), আগন্তুক (১৯৯১)। এছাড়াও তিনি বহু ছবির চিত্রনাট্য রচনা ও সঙ্গীত পরিচালনা করেন।
লেখক হিসেবেও সত্যজিৎ রায় খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে: বিষয় চলচ্চিত্র, একেই বলে শুটিং, আওয়ার ফিল্মস দেয়ার ফিল্মস, ফেলুদা সিরিজ, শঙ্কু সিরিজ, পিকুর ডায়েরী ইত্যাদি। পুরস্কার: পথের পাঁচালী-এর জন্য ১৯৫৫ থেকে ১৯৬৬-এর মধ্যে ভারত ছাড়াও মোট ১১টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার; অপরাজিত পেয়েছে ভেনিস, সানফ্রান্সিসকো, বার্লিন, ডেনমার্কসহ ৫টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার। তথ্যচিত্র ‘রবীন্দ্রনাথ’ ও ‘ইনার আই’ এবং টিভি চিত্র ‘সদগতি’ও পেয়েছে দেশ-বিদেশের পুরস্কার। এছাড়া ব্যক্তিগতভাবে তিনি পেয়েছেন বিশেষ সম্মান ও পুরস্কার। তিনি ভারত সরকারের নিকট থেকে ৪০টি পুরস্কার এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ৬০টি পুরস্কার লাভ করেন। এসবের মধ্যে রয়েছে দেশ-বিদেশের বহু বিশ্ববিদ্যালয়ের অনারারি ডক্টরেট ডিগ্রি, বিশ্বভারতীর ‘দেশিকোত্তম’, ‘দাদা সাহেব ফালকে’ পুরস্কার, ম্যাগসেসেই পুরস্কার, ফ্রান্সের ‘লিজিয়ন অব অনার’ (১৯৮৭), ‘ভারতরত্ন’ (১৯৯২), বিশেষ ‘অস্কার’ (১৯৯২) পুরস্কার ইত্যাদি। ১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল কলকাতায় সত্যজিৎ রায়ের মৃত্যু হয় । [আমানুল হক]