রায়, সতীশচন্দ্র
রায়, সতীশচন্দ্র২ (১৮৮৮-১৯৬০) শিক্ষাবিদ, বৈষ্ণবাচার্য, গ্রন্থকার। বর্তমান হবিগঞ্জ জেলার আজমিরিগঞ্জ উপজেলার জলসুকা গ্রামে জমিদার বংশে ১৮৮৮ সালের ২৪ মে সতীশচন্দ্র রায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম সূর্যমণি রায় এবং মায়ের নাম ললিতা দাসী। সিলেটে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের পর তিনি কলকাতা হেয়ার স্কুলে শিক্ষা লাভ করেন। পরে তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। ছাত্রজীবনে তিনি মেধার স্বীকৃতিস্বরূপ যতীন্দ্রচন্দ্র পুরস্কার, গিরিশ স্মৃতি পুরস্কার; স্যার এন্ড্রুফেজার স্বর্ণপদকসহ বহু পুরস্কার লাভ করেন। ১৯১০ সালে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে দর্শনে অনার্স পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে পোস্ট গ্রাজুয়েট স্কলারশিপ ও পিএস স্মিথ প্রাইজ লাভ করেন। পরে তিনি উচ্চ শিক্ষার্থে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। সেখান থেকে তিনি ১৯১৪ সালে দর্শন শাস্ত্রে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। প্রাচ্যবিদ এইচ ওল্ডেনবার্গ এবং পিডসনের অধীনে ভারতীয় দর্শন বিষয়ে তিনি গবেষণা শুরু করেন। কিন্তু প্রথম মহাযুদ্ধ শুরু হলে গবেষণা অসমাপ্ত রেখে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন।
১৯১৪-১৯১৫ সাল তিনি কলকাতা সিটি কলেজে অধ্যাপনা করেন। ১৯১৬ সালে তিনি লাহোরের দয়াল সিং কলেজে অধ্যক্ষ পদে যোগদান করেন। ১৯২১ সালে তিনি লাহোর থেকে চলে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, যোগ দেন দর্শন বিভাগের রিডার পদে। ১৯২৩ সালে ওই পদ ছেড়ে ইন্ডিয়ান এডুকেশন সার্ভিসে যোগদান করেন। প্রথম ভারতীয় আই ইএস হিসেবে তিনি ১৯২৩ থেকে ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত সুরমা উপত্যকা ও পার্বত্য জেলাসমূহের স্কুল বিভাগীয় পরিদর্শক এবং সুরমা উপত্যকা টেক্সট বুক কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৩৪ সালে তিনি গুয়াহাটির কটন কলেজের অধ্যক্ষ পদে যোগদান করেন। ১৯৪০ সালের জুলাই মাসে তিনি সিলেটের মুরারিচাঁদ কলেজের অধ্যক্ষ পদে যোগদান করেন। ১৯৪১ সালের এপ্রিল মাসে তিনি আসামের জনশিক্ষা পরিচালক নিযুক্ত হন। ১৯৪৩ সালে ওই পদ থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি কিছুকাল পরিকল্পনা কমিশনে কাজ করেন।
ইংল্যান্ড থেকে ফিরে এসে সতীশচন্দ্র রায় ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করলেও অবসর গ্রহণের পর বৈষ্ণবীয় চিন্তা ও আদর্শে আপ্লুত হন। পরে তিনি বৈষ্ণব সন্ন্যাস মন্ত্রে দীক্ষা গ্রহণ করে শ্রীমৎ হরিদাস নামানন্দজী নাম পরিগ্রহ করে শ্রীবৃন্দাবন ধামে বসবাস শুরু করেন। তিনি সেখানকার বৈষ্ণব থিয়োলজিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং পরে সেখানকার বৈষ্ণব রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর প্রচেষ্টায় বৃন্দাবন বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শঙ্করদেব চেয়ার অফ বৈষ্ণব ফেইথ এ্যান্ড ফিলজফি’ প্রতিষ্ঠিত হয়।
শিক্ষাবিদ, দার্শনিক, সাহিত্যিক ও দাতা হিসেবে সতীশচন্দ্র রায় বিখ্যাত হয়ে আছেন। পৈতৃক জমিদারি এবং নিজ সম্পত্তির প্রধান অংশ তিনি দুঃস্থ ছাত্র ও বিভিন্ন সংস্থাকে দান করে দিয়েছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত সূর্যমণি-ললিতা সাহিত্যভবন থেকে নিজ অর্থানুকূল্যে বহু ধর্মীয় গ্রন্থ তিনি প্রকাশ করেন। তিনি কলকাতায় বৈষ্ণব ধর্ম প্রচারিণী সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। বৈষ্ণবীয় চিন্তা প্রকাশ ও প্রচার ছিল এই সমিতির উদ্দেশ্য। কর্মজীবনে তিনি রেডক্রস, যক্ষ্মা প্রতিরোধ সমিতি, স্কাউট ও গার্লস গাইড আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। তিনি আসাম বয়স্কাউট আন্দোলনের জনক। তিনি শ্রীহট্ট সাহিত্য পরিষৎ-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ শিলং শাখার সভাপতি ছিলেন। বৈষ্ণব ধর্ম বিষয়ে তিনি বহু গ্রন্থ রচনা করেছেন। সমকালে Indian Messenger, Modern Review, Journal of the Dept. of Letters of the University of Calcutta, তত্ত্বকৌমুদী প্রভৃতি পত্রপত্রিকায় তাঁর বহু প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর রচিত ও প্রকাশিত গ্রন্থাদির মধ্যে উলেখযোগ্য: অঞ্জলি, স্মৃতিপূজা (প্রথম খন্ড-বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ; দ্বিতীয় খন্ড-ভারতের আধ্যাত্মিক সাধনা, পরমহংস রামকৃষ্ণ, তত্ত্বভূষণ সীতানাথ, ধর্মগুরু শিবনাথ শাস্ত্রী; তৃতীয় খন্ড-পিতৃদেব ও মাতৃদেবী; চতুর্থ খন্ড-স্বদেশপ্রেমিক রমাকান্ত রায়), উপনিষদের মর্মবাণী (১ম ও ২য় খন্ড), ছেলেমেয়েদের প্রার্থনা, উৎসবের প্রণতি, জীবনবীণার বিচিত্রসুর, সোনার গৌরাঙ্গ, নবযুগের শিক্ষা ও সাধনা, সর্বধর্ম সমন্বয়, সাহিত্য সমাজ ও ধর্ম, ভক্তি কুসুমাঞ্জলি, ভগবদগীতি কুসুমাঞ্জলি (দুই খন্ড), Religion and Modern India, Studies in European Philosophy, The Bhagavat Gita and Modern Scholarship (in Four Parts), Introduction to Indian Thought, Indologans and Their Researches, Educational Culture, A Scheme of Extra Mural Culture, Life of Dr. P.K. Roy, The League of Welfare, Training in Leadership and Citizenship for Young India ইত্যাদি। ১৯৬০ সালের ১৭ জানুয়ারি তাঁর মৃত্যু হয়। [নন্দলাল শর্মা]