রায়, শরৎকুমার
রায়, শরৎকুমার (১৮৭৬-১৯৪৬) বরেন্দ্র রিসার্চ সোসাইটি ও বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম। তিনি ১৮৭৬ সালে নাটোর জেলার দিঘাপতিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। দিঘাপতিয়ার জমিদার প্রমথনাথ রায়ের পুত্র শরৎকুমার রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল, রিপন কলেজ, প্রেসিডেন্সি কলেজ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেন। কলকাতায় থাকাকালে তিনি তাঁর গৃহশিক্ষক রামেন্দু সুন্দর ত্রিবেদীর মাধ্যমে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সাথে যুক্ত হন এবং দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাজা বিনয়কৃষ্ণদেব বাহাদুর ও সে সময়কার আরও অনেক পন্ডিত ব্যক্তির সাথে পরিচিতি লাভ করেন। তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বি.এ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে পদার্থ বিজ্ঞানে এম.এ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯০০ সালে ইংল্যান্ড যাওয়ার পথে তিনি পম্পেই, থিবি এবং ইউরোপের আরও কিছু স্থান পরিদর্শন করেন।
শরৎকুমার রায় অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় এবং রমাপ্রসাদ চন্দসহ বরেন্দ্র অঞ্চলের প্রাচীন নিদর্শনাবলী পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পরীক্ষা করে দেখার জন্য একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। শরৎকুমার রায়ের নেতৃত্বে অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, রমাপ্রসাদ চন্দ, কলকাতা জাদুঘরের রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এবং রামকমল সিংহকে নিয়ে গঠিত একটি দল দেওপাড়া, মানদইল, কুমারপুর, খেতুর, বিজয়নগর প্রভৃতি প্রত্নস্থলে অনুসন্ধান চালান এবং প্রচুর মূল্যবান প্রত্নসম্পদ আবিষ্কার করেন। রাজশাহীর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলসমূহে পাওয়া যাওয়ায় ভবিষ্যৎ গবেষণা কাজের জন্য শরৎকুমার এগুলি রাজশাহীতে সংরক্ষণ করার আগ্রহ প্রকাশ করেন এবং এ ব্যাপারে তিনি রমাপ্রসাদ চন্দ, ভুবনমোহন মৈত্রেয়, শশধর রায় ও অন্যদের কাছ থেকে সক্রিয় সমর্থন লাভ করেন।
বগুড়া জেলার খঞ্জনপুরে অনুসন্ধান কাজের শেষে ১৯১০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে শরৎকুমার, অক্ষয়কুমার এবং রমাপ্রসাদ তাবুতে বসে বরেন্দ্র রিসার্চ সোসাইটি গঠনের পরিকল্পনা করেন এবং সেখান থেকে প্রত্যাবর্তনের পর তা বাস্তবায়িত হয়। সোসাইটির সভাপতি, পরিচালক এবং সম্পাদক হন যথাক্রমে কুমার শরৎকুমার রায়, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় এবং রমাপ্রসাদ চন্দ। ১৮৬০ সালের ইন্ডিয়ান সোসাইটি অ্যাক্টের অধীনে ১৯১৪ সালে এ সোসাইটি নিবন্ধীকৃত হলেও আনুষ্ঠানিকভাবে এর কার্যক্রম শুরু হয় ১৯১০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর। ব্যয় নির্বাহের জন্য শরৎকুমার মাসিক ২০০ টাকা অনুদান প্রদান করেন।
শীঘ্রই প্রত্নসামগ্রীর সংগ্রহ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায় এবং এগুলির সংরক্ষণ ও প্রদর্শনীর জন্য একটি জাদুঘর ভবনের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। শরৎকুমার রায়ের ভাইয়ের দান করা জমির উপর জাদুঘর ভবনটি নির্মিত হয় এবং তিনি নিজে ৬৩,০০০ টাকা ব্যয়ভার বহন করেন। বাংলার গভর্নর লর্ড রোনাল্ডস ১৯১৯ সালের নভেম্বর মাসে এটি উদ্বোধন করেন।
শরৎকুমার পাহাড়পুরে খননকাজ চালানোর জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেন এবং তাঁর আর্থিক সহায়তায় প্রত্নতত্ত্ববিভাগ এ কাজে হাত দেয়। তিনি নিজে ১৯২৩ সালের ১ মার্চ খনন কাজের উদ্বোধন করেন। সংগৃহীত প্রত্ন সামগ্রীর উপর গবেষণা কাজের সুবিধার্থে শরৎকুমার জাদুঘরে একটি গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করেন এবং তাঁর ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারের জন্য সংগৃহীত গ্রন্থ ও পান্ডুলিপিসমূহ এতে দান করেন। তাঁর নিজস্ব জমিদারি দয়ারামপুরেও শরৎকুমার একটি বৃহৎ গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করেন। পুত্র কুমার সবিতা রায়ের স্মরণে তহবিল সংগ্রহের মাধ্যমে বরেন্দ্র রিসার্চ সোসাইটির প্রথমদিককার প্রকাশনাগুলির কাজ সম্পন্ন হয়।
শরৎকুমার রাজশাহী অ্যাসোসিয়েশন, রাজশাহী পাবলিক লাইব্রেরি, রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটি, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মিলনী এবং ইন্ডিয়ান মিউজিক সোসাইটির মতো বিভিন্ন সংগঠনের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৩০ সালে আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।
কৃষির প্রতি শরৎকুমার রায়ের ছিল প্রবল আগ্রহ। তিনি তাঁর পুত্র বিবুধনাথ রায়কে কৃষি বিষয়ে পড়াশুনার জন্য আমেরিকায় পাঠান। তিনি দয়ারামপুরে প্রায় ৩০০ বিঘা জমির উপর একটি কৃষি খামার প্রতিষ্ঠা করেন ও তাঁর স্বর্গীয় মা রাণী দ্রবময়ীর নামে এর নামকরণ করেন। তিনি একটি দুগ্ধ খামারও প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি একটি বাগান করেন যেখানে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সংগৃহীত নানা ধরনের ফুল ও ফলের চাষ করা হয়। শরৎকুমার রায় উত্তর বাংলায় একটি চিনিকল স্থাপন করেন। এ ধরনের কলের মধ্যে এটিই ছিল প্রথম। তিনি রাণী দ্রবময়ী খামারে উৎপাদিত অাঁখের সাহায্যে তা চালু রাখার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
শরৎকুমার রায়ের বড় ভাই বসন্তকুমারের রাজশাহীতে একটি কৃষি কলেজ প্রতিষ্ঠা করার পরিকল্পনা ছিল এবং এ উদ্দেশ্যে তিনি ১৯২০ সালে রাজশাহী কলেজকে আড়াই লাখ টাকা দান করেন। শরৎকুমার রায়ের উদ্যোগে ১৯৩৬ সালে রাজশাহী কলেজের নিয়ন্ত্রণে ‘বসন্তকুমার কৃষি ইনস্টিটিউট’ প্রতিষ্ঠিত হয়। ইন্সটিটিউটটি ১৯৫২ সাল পর্যন্ত টিকে ছিল। ১৯৪৬ সালের ১২ এপ্রিল শরৎকুমার রায়ের মৃত্যু হয়। [সাইফুদ্দীন চৌধুরী এবং এস.এম আব্দুল লতিফ]