রায়, আনন্দচন্দ্র
রায়, আনন্দচন্দ্র (১৮৪৪-১৯৩৫) আইনজীবী, রাজনীতিক। আনন্দচন্দ্র রায় ১৮৪৪ সালে ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল দক্ষিণ বিক্রমপুরের কানুর গাঁ গ্রামে। তাঁর পূর্বপুরুষ রাজশাহী বরেন্দ্র ব্রাহ্মণ। পিতা গৌরসুন্দর রায় ঢাকার নীলকর ও জমিদার জেমস ওয়াইজের জমিদারি এস্টেটের ম্যানেজার ছিলেন। আনন্দচন্দ্র রায় ঢাকার পোগোজ স্কুলে লেখাপড়া করেন। তিনি খুব সম্ভবত ১৮৬২-৬৩ সালে প্লিডারশীপ পাস করে ঢাকার কোর্টে ওকালতি শুরু করেন। তিনি ইংরেজি ও ফার্সি উভয় ভাষাতেই পারদর্শী ছিলেন। আনন্দচন্দ্র রায় আইন ব্যবসায়ে যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেন। একসময় তিনি ভোলায় আর্মেনি জমিদার লুকাসের জমিদারি ক্রয় করেন এবং নানাভাবে ক্রমশ প্রভাবশালী হয়ে উঠেন। উনিশ শতকের ঢাকায় তাঁর সমাজসেবারও নিদর্শন মেলে। তিনি ছিলেন পুরনো আদালতের বার লাইব্রেরির প্রতিষ্ঠাতা। এ ছাড়া তিনি ঢাকেশ্বরী মন্দিরের ফটক নির্মাণ এবং মন্দিরের সার্বিক ব্যয়বহনের জন্য আর্থিক সহায়তা দান করেন। আনন্দচন্দ্র দক্ষিণ বিক্রমপুরের নিজ গ্রামে স্ত্রী আনন্দময়ীর নামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। পরে এটিই ঢাকার আর্মেনীটোলায় তাঁর প্রাসাদোপম অট্টালিকায় স্থানান্তরিত হয়। এটি এখন আনন্দময়ী স্কুল নামে সুপরিচিত।
আনন্দচন্দ্র রায় উনিশ শতকের আশির দশকে সক্রিয়ভাবে স্থানীয় সরকার রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। প্রধানত স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় স্বায়ত্বশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আনন্দচন্দ্র রায় বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। ঢাকায় বিভিন্ন সভা সমিতিতে তিনি বক্তব্য প্রদান করেন এবং মিউনিসিপ্যালিটিকে দেশীয়দের হাতে ন্যস্ত করার দাবি জানান। এ ক্ষেত্রে ঢাকার সামাজিক রাজনৈতিক সংগঠন Dacca People’s Association (ঢাকা সাধারণ সভা) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এবং আনন্দচন্দ্র রায় এ সংগঠনের সদস্য হিসেবে মূল্যবান অবদান রাখেন। ১৮৮৪ সালের মিউনিসিপ্যালিটি আইন (১৮৮৪ সালের তিন নম্বর আইন) পাস হলে আনন্দচন্দ্র রায় এ আইনের অধীনে অনুষ্ঠিত প্রথম মিউনিসিপ্যালিটি নির্বাচনে ঢাকার পাঁচ নম্বর ওয়ার্ড থেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কমিশনার নির্বাচিত হন। চেয়ারম্যান নিয়োগে মনোনয়ন প্রথার পরিবর্তে নির্বাচন ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে আনন্দচন্দ্র রায় কমিশনারদের ভোটে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন এবং তিনিই ছিলেন ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটির প্রথম নির্বাচিত চেয়ারম্যান। তিনি ১৮৮৭ সাল পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করেন।
আনন্দচন্দ্র রায় পূর্ববঙ্গ জমিদার সভার (East Bengal Landholders Association) সদস্য ছিলেন। তিনি বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভারও সদস্য নির্বাচিত হন। জগন্নাথ কলেজ (১৮৮৪) প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তিনি এ কলেজের একজন ‘অছি’ এবং পরিচালনা পর্ষদের সদস্য নির্বাচিত হন। আনন্দচন্দ্র রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদের সদস্য এবং ঢাকেশ্বরী কটন মিলের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ছিলেন।
আনন্দচন্দ্র রায় বিশ শতকের গোড়ার দিকে ঢাকা সাধারণ সভাকে পুনরুজ্জীবিত করেন। তাঁর বাড়ি তখন ছিল বঙ্গভঙ্গ, স্বদেশী আন্দোলন প্রভৃতি রাজনৈতিক আন্দোলনের পীঠস্থান। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকালে ঢাকা সাধারণ সভা আনন্দচন্দ্র রায়ের নেতৃত্বে সরকার বিরোধী জনমত গঠন এবং বঙ্গভঙ্গ বিরোধিতায় ঢাকার মধ্যবিত্ত হিন্দু শ্রেণিকে সংগঠিত করতে সমর্থ হয়।
স্বদেশী যুগের কুমিলা সুটিং কেস এবং আলীপুর কনস্পিরেসি কেস আনন্দচন্দ্র রায়ের জীবনের উল্লেখযোগ্য মোকদ্দমা। প্রায় অর্ধ শতককাল ঢাকায় খ্যাতির সঙ্গে আইনব্যবসা করে তিনি ১৯০৮ সালে অবসর গ্রহণ করেন। এরপর তিনি কংগ্রেসের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯১২ সালে তিনি ঢাকায় কংগ্রেস প্রাদেশিক সম্মেলনের অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। জনহিতৈষী কাজের জন্য সরকার তাঁকে ‘রায়বাহাদুর’ উপাধিতে ভূষিত করেন।
আনন্দচন্দ্র রায় ১৯৩৫ সালে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর নামে ঢাকার আর্মেনীটোলা এলাকায় একটি রাস্তার নামকরণ হয় আনন্দচন্দ্র রোড। [শরীফ উদ্দিন আহমেদ]