ট্রেজারি বিল
ট্রেজারি বিল এক ধরনের স্বল্পমেয়াদি শর্তহীন সরকারি ঋণপত্র। স্বল্পকালীন বাজেট ঘাটতি মেটানো অথবা অন্যান্য প্রয়োজনে স্বল্পকালীন তহবিল সংগ্রহের উদ্দেশ্যে সরকার ট্রেজারি বিল ইস্যু ও বিক্রয় করে। সরকার এ বিলে মেয়াদান্তে তার ধারককে নিঃশর্তভাবে অভিহিত মূল্য ফেরত প্রদানের জন্য অঙ্গীকার করে। ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকার তিন প্রকারের ৯০ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিল ইস্যু ও বিক্রয় করে। এগুলির মধ্যে অধিকাংশ ছিল ৯০ দিন মেয়াদি অ্যাডহক বিল যা সরকারের নগদ অর্থের প্রয়োজন মেটানোর জন্য বাজারে ছাড়া হয়েছিল। ১৯৭২ সালের আগস্ট মাসে চালুকৃত ট্যাপ ভিত্তিতে বিক্রয়কৃত ৩ মাস মেয়াদি বিলগুলি ছিল বাংলাদেশ সরকারের ইস্যুকৃত দ্বিতীয় প্রকারের ট্রেজারি বিল। অর্থনীতিতে সে সময়ে বিদ্যমান অতিরিক্ত তারল্য প্রত্যাহার করার উদ্দেশ্যে ৩ মাস মেয়াদি এ সকল ট্রেজারি বিল চালু করা হয়েছিল।
তৃতীয় দফায় ইস্যুকৃত ট্রেজারি বিলগুলিও ছিল ৩ মাস মেয়াদি। সুনির্দিষ্ট গ্রাহক তথা অব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান, অ-আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং জনসাধারণের নিকট বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে এ বিলগুলি বাজারে ছাড়া হয়েছিল। শুরুতে এ ধরনের ট্রেজারি বিল বিক্রয় করে ২৫০ মিলিয়ন টাকা সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও পরবর্তীকালে এ সীমা প্রত্যাহার করা হয় এবং ব্যাংক ব্যতীত অন্যান্য সাধারণ ক্রেতাদের নিকট যেকোনো পরিমাণে সেগুলি বিক্রয়ের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক-কে সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব দেওয়া হয়। তবে অব্যাংকিং খাতের অনুমোদিত ক্রেতারা খুবই স্বল্প পরিমাণে এ ট্রেজারি বিল ক্রয় করে। ফলে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলিই সরকারি ট্রেজারি বিলের প্রধান বাজারে পরিণত হয়। প্রতি ৩ মাসে একবার এ সকল ট্রেজারি বিলের পুনঃইস্যু অব্যাহত থাকে। তবে ‘ট্যাপ’ ভিত্তিতে ইস্যুকৃত অব্যাংকিং ক্রেতাদের নিকট বিক্রিত এ দুই ধরনের ট্রেজারি বিলের যথাক্রমে বিক্রয় ও ইস্যু ১৯৯৪ সালের ডিসেম্বর মাসে বন্ধ ঘোষণা করা হয়। অপরদিকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলি তাদের রক্ষিতব্য প্রয়োজনীয় তরল সম্পদের সমপরিমাণ ট্রেজারি বিল ক্রয় ও ধারণ করে। ফলে ইস্যুকৃত ট্রেজারি বিলসমূহের বৃহদাংশ অবিক্রিত থাকায় বাংলাদেশ ব্যাংককে সেগুলি ক্রয় ও ধারণ করতে হয়। ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিক্রিত মোট ট্রেজারি বিলের মধ্যে ৫৭% আমানত গ্রহণকারী ব্যাংকগুলি ধারণ করে এবং ৩০ জুন ১৯৮২ তারিখে ব্যাংকগুলির ট্রেজারি বিল ধারণের হার পূর্বাপেক্ষা হ্রাস পেয়ে মাত্র ২৭%-এ দাঁড়ায়। পরবর্তী সময়ে তা বৃদ্ধি পায় এবং ১৯৯২ সালের শেষে ৬৮%-এ উন্নীত হয়। কিন্তু ১৯৯৩ সালের শুরুতে ব্যাংকগুলির ট্রেজারি বিল ক্রয় ও ধারণের পরিমাণ দ্রুত হ্রাস পেতে থাকে এবং তা ১৯৯৫ সালের জুন মাসে মাত্র ৪%-এ নেমে আসে।
আমানত গ্রহণকারী ব্যাংকগুলির বিধিবদ্ধ জমা সংরক্ষণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক বিলসমূহকে অনুমোদিত সিকিউরিটি হিসেবে ঘোষণা এবং বাংলাদেশ ব্যাংক বিলের সুদের হার ট্রেজারি বিল অপেক্ষা অধিক হওয়ায় ব্যাংকগুলির ট্রেজারি বিলের স্থলে বাংলাদেশ ব্যাংক বিল ক্রয় ও ধারণ করতে বেশি আগ্রহী হয়। মূলত এ কারণেই ব্যাংকগুলিতে ট্রেজারি বিল ক্রয়ের পরিমাণ দ্রুত হ্রাস পায় এবং এ নিম্নগতি ১৯৯৭ সালের মার্চ পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। ১৯৯৭ সালের মার্চ মাস থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক বিলের বিক্রয় বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং মাত্র ৯০ দিন মেয়াদি এক ধরনের ট্রেজারি বিলের নিলামে বিক্রয় অব্যাহত থাকে। সরকার কর্তৃক পূর্বনির্ধারিত সুদের হারে ৯০ দিন মেয়াদি দুই শ্রেণীর ট্রেজারি বিলের বিক্রয় চলমান থাকলেও পরবর্তীকালে সেগুলি বাজার দ্বারা নির্ধারিত হারে নিলামে বিক্রয় করা হতো। ১৯৯৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি সরকার ৩০ দিন ও ১৮০ দিন মেয়াদি এবং ১৬ মার্চ ১৯৯৭ তারিখে এক বৎসর মেয়াদি ট্রেজারি বিল চালু করে ও নিলামে বিক্রয় প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখে। আগস্ট ১৯৯৮ পর্যন্ত ৩০ দিন, ৯০ দিন, ১৮০ দিন এবং এক বৎসর মেয়াদি ট্রেজারি বিলসমূহ নিয়মিতভাবে সাপ্তাহিক নিলামের মাধ্যমে বিক্রয় করা হয়। ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৯৮ তারিখে উল্লিখিত ৪ ধরনের বিলের স্থলে সরকার ২৮ দিন, ৯১ দিন, ১৮২ দিন, ৩৬৪ দিন, ২ বৎসর এবং ৫ বৎসর মেয়াদি ট্রেজারি বিল প্রবর্তন ও বিক্রয় শুরু করে। বর্তমানে এ পাঁচটি বিভিন্ন মেয়াদের ট্রেজারি বিল বাজারে চালু রয়েছে।
২০০৩ সালে মুদ্রানীতির হাতিয়ার হিসেবে রেপো ও রিভার্স রেপো প্রবর্তনের ফলে দেশের আর্থিক বাজারে ট্রেজারি বিল ব্যবহারের একটি নতুন ক্ষেত্র তৈরি হয়। অন্য কোন আলাদা হাতিয়ার না থাকায় স্বল্প মেয়াদি তারল্য ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ ব্যারক থেকে রেপো সুবিধা গ্রহণের জন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে জামানত হিসেবে ট্রেজারি বিলের ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়। ব্যাংকসমূহের তারল্য নিয়ন্ত্রণে ট্রেজারি বিলের নিলামের সম্পুরক হিসেবে রিভার্স রেপো নিলামের প্রয়োগ সত্ত্বেও অদ্যাবধি মুদ্রানীতির অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে ট্রেজারি বিলের ব্যবহার রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এখন রপ্তানি খাতের প্রবৃদ্ধি এবং রেমিটেন্সের আন্তঃপ্রবাহ বৃদ্ধিজনিত উদ্বৃত্ত অতিরিক্ত তারল্য তুলে নেয়ার জন্য ট্রেজারি বিল বিক্রির ব্যবস্থা করে। সরকারি ধারের হাতিয়ার হিসেবে সেকেন্ডারি বাজার সৃষ্টির উদ্দেশ্যে আন্তঃব্যাংক রেপো বাজারেও ট্রেজারি বিলকে জামানত হিসেবে ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়। ২০০৪ অর্থবছর থেকে ৫ বছর মেয়াদি ট্রেজারি বিলের নিলাম বন্ধ করে দেওয়া হয়। সরকারি ট্রেজারি বিল এবং অন্যান্য সরকারি ঋণের হাতিয়ারসমূহের সেকেন্ডারি মার্কেট সৃষ্টিতে সহায়তা এবং জোরদারকরণে ২০০৪ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক ৯টি প্রাইমারি ডিলার এবং পরবর্তীকালে আরও ৩টি ডিলার নিয়োগ প্রদান করে। তারা প্রাতিষ্ঠানিক এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে গ্রাহক সংখ্যা বৃদ্ধির প্রয়াশে নিয়মিতভাবে ব্যাপক পরিমাণে নিলামে অংশগ্রহণ করছে। নিলাম প্রক্রিয়ার ফরাসি ট্রেজারি বিলের নিলাম পদ্ধতি অনুসরণপূর্বক ট্রেজারি বিল ইস্যু করা হয়। এখানে সর্বনিম্ন ঈল্ড থেকে শুরু করে নিলামের জন্য নির্ধারিত অংকের পরিমাণ পর্যন্ত প্রদত্ত ঈল্ডের ট্রেজারি বিল ইস্যু করা হয়। কাট-অফ মূল্যেও আনুপাতিক হারে ট্রেজারি বিলের বণ্টন করা হয়। ট্রেজারি বিল বাজারের আরও একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে ২০ অক্টোবর ২০০৩ থেকে দেশে ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে ট্রেজারি বিলের লেনদেন কার্যক্রম সম্পন্ন করা হচ্ছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ট্রেজারি বিলের স্থানান্তর প্রক্রিয়া অনলাইনে পরিচালিত হচ্ছে। এই নতুন বিপণন কৌশল ব্যবস্থাপনা আর্থিক বাজারের ভিত্তিতে প্রসারিত ও গভীরতর করতে সহায়ক হবে।
তারিখ ও টাকার পরিমাণ উল্লেখপূর্বক তৈরি নিলাম পঞ্জিকা জনসম্মুখে প্রকাশের মাধ্যমে ২০০৭ অর্থবছর থেকে বাজারভিত্তিক ট্রেজারি বিলের নিলামের ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক নিয়মের সঙ্গে ট্রেজারি বিলের মেয়াদের সঙ্গতি বিধানে ২ বছর মেয়াদি ট্রেজারি বিল বন্ধ করা হয়েছে। অধিকন্তু ১ জুলাই ২০০৮ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ৩০ দিন মেয়াদি বিলের সঙ্গে ওভার ল্যাপিং এড়াতে ২৮ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের নিলামও বন্ধ রাখা হয়েছে। এসব পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে বর্তমানে বাজারে লেনদেনের জন্য ৯১ দিন মেয়াদি, ১৮২ দিন মেয়াদি এবং ৩৬৪ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিল চালু আছে।
মুদ্রা বাজারের তারল্য পরিস্থিতির ভিত্তিতে বিভিন্ন ধরনের ট্রেজারি বিলের ঈল্ড কাঠামো নির্ভরশীল। অর্থবছর ২০০৯-এ বাজারে ব্যাংকসমূহের কাছে প্রচুর পরিমাণে তারল্য বিরাজমান থাকায় বিভিন্ন মেয়াদের ট্রেজারি বিলে ঈল্ড জুন শেষে শতকরা ৩.০২ ভাগ থেকে শতকরা ৮.৬০ ভাগে দাঁড়ায়। ২০০৮ সালের জুন শেষে এ হার ছিল শতকরা ৭০২৮ থেকে ৮.৪৮ ভাগ। [সৈয়দ আহমেদ খান এবং এ. সামাদ সরকার]