বাম রাজনীতি
বাম রাজনীতি বিদ্যমান রাজনৈতিক পদ্ধতি, সমাজ ও শাসনব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের মতাদর্শ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পরিচালিত রাজনৈতিক উদ্যোগ। সাধারণভাবে এ উদ্যোগটি হলো নিরস্ত্র অথবা প্রয়োজনে চরম পন্থা অবলম্বন করে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক, আইনগত ও অর্থনৈতিক কাঠামোর মৌলিক পরিবর্তনের লক্ষ্যে পরিচালিত একটি রাজনৈতিক আন্দোলন। টমাস পেইন (১৭৩২-১৮০৯), ভলটেয়ার (১৬৪১-১৭৭৮), বেনথাম (১৭৪৮-১৮৩৪), কার্ল মার্কস (১৮১৮-১৮৮৩) প্রমুখ চিন্তাবিদ আধুনিক বাম ভাবাদর্শিক রাজনীতির প্রবক্তা।
এই উপমহাদেশে বাম রাজনীতির ইতিহাসের শুরু বিশ শতকের বিশের দশকে। মানবেন্দ্রনাথ রায়ের উদ্যোগে কিছু নির্বাসিত ভারতীয় ১৯২০ সালের ১৭ অক্টোবর সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের তাসখন্দ শহরে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি (সি.পি.আই) গঠন করেন। চল্লিশের দশকের শেষ দিক পর্যন্ত বর্তমান বাংলাদেশ এলাকায় এ পার্টির তেমন তৎপরতা ছিল না। বিশ ও ত্রিশের দশকে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর তরুণদের বিপ্লবী জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে প্রধানত সন্ত্রাসবাদী রূপ পরিগ্রহ করে এবং অত্যাচারী ব্রিটিশ নাগরিক ও পুলিশ কর্মকর্তা হত্যা তাদের প্রধান লক্ষ্য হয়ে ওঠে। বৃহত্তর ঢাকা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা ও বরিশাল জেলা ছিল এ ধরনের তৎপরতার মূলকেন্দ্র। অনেক সন্ত্রাসবাদী তখন পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত হন, অনেককে জেলখানায় ফাঁসি দেয়া হয়। তদুপরি, শত শত কর্মী বছরের পর বছর জেলখানায় আটক থাকেন এবং অনেককে দ্বীপান্তর দন্ড দিয়ে আন্দামানে পাঠানো হয়। জেলখানায় আটক এই সন্ত্রাসবাদীরা কমিউনিস্ট পত্রপত্রিকা পাঠের সুযোগ পান এবং অনেকে কমিউনিস্ট দলে যোগ দেন। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির অধিকাংশ হিন্দু সদস্য সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও সরকারের দমনমূলক ব্যবস্থার কারণে ভারতে চলে যান।
১৯৪৮ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসে পূর্ববাংলা থেকে ১২৫ জন এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ৫ জন প্রতিনিধি যোগ দেন। ভারত বিভাগের বাস্তবতার পটভূমিতে তারা পাকিস্তানে পার্টির একটি স্বতন্ত্র কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তদনুসারে পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির ৯ সদস্যের একটি কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয়। পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠা ১৯৪৮ সালের ৬ মার্চ। পশ্চিম পাকিস্তানে পার্টির তেমন কোনো প্রভাব বা সংগঠন না থাকলেও পূর্ব বাংলায় পার্টির দ্রুত বিকাশ ঘটে। প্রথম দিকে এ দলের কর্মকৌশল ও কার্যপদ্ধতি সম্পর্কিত নীতি ও কার্যক্রম ছিল ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির নীতি ও কার্যক্রমের অনুরূপ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির ভেতরে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাব বৃদ্ধি পেতে থাকে। পার্টি এক পর্যায়ে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ডাক দিলে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি তা অনুমোদন করে।
১৯৪৮-৫০ সালে পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির সংগঠকদের নেতৃত্বে বহু বিক্ষিপ্ত কৃষক অভ্যুত্থান এবং লাগাতার কৃষক আন্দোলন পরিচালিত হয়। এসব অভ্যুত্থান ও আন্দোলনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল নেত্রকোনা জেলার সুসং দুর্গাপুরের হাজং উপজাতীয়দের বিদ্রোহ। এ আন্দোলন বেশ কয়েক বছর ধরে চলে। ১৯৪৬-৪৭ সালে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় বর্গাচাষীরা তেভাগা আন্দোলন চালায়। পুলিশের গুলিতে অনেক কৃষক নিহত হয়। তেভাগার দাবি মেনে নেয়া হবে এ নিশ্চয়তা দেয়া হলে আন্দোলন কর্মসূচি প্রত্যাহার করা হয়। ১৯৫০ সালে নাচোলে বর্গাচাষী ও পুলিশের মধ্যে সশস্ত্র সংঘর্ষ হয়। এ ছাড়া খুলনার ধানিমুনিয়া ও ডুমুরিয়া, যশোরের বরেন্দ্র দুর্গাপুর, চাঁদপুর ও এগারোখানে এবং সিলেটের বিয়ানীবাজারে কৃষক বিদ্রোহ ও পুলিশের সঙ্গে তাদের সশস্ত্র সংঘাতের ঘটনা ঘটে। পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির অনেক সংগঠক এসব ঘটনায় নিহত হন এবং এতে জড়িত থাকার কারণে অনেকে কারারুদ্ধ হন। ১৯৪৮-৫১ সালে তিন হাজারেরও বেশি কমিউনিস্টকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং শত শত নেতা ও কর্মী বিনাবিচারে বছরের পর বছর কারারুদ্ধ থাকেন। পার্টির সদস্যরা আত্মগোপন করেন এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন।
১৯৫০ সালের মে মাসে অনুষ্ঠিত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির এক পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে একটি নতুন অন্তর্বর্তীকালীন কমিটি নির্বাচিত হয়। ১৯৫১ সালের এপ্রিল মাসে প্রকাশিত পার্টির একটি খসড়া কর্মসূচিতে জাতীয় বুর্জোয়া এবং সামন্ত ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী শক্তি হিসেবে ব্যাপকভিত্তিক ফ্রন্ট গঠনের আহবান জানানো হয়। পার্টি সশস্ত্র সংগ্রাম পরিত্যাগ করে নেহরু সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করতে শুরু করে এবং সংসদীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। পূর্ব বাংলায়ও পরবর্তীকালে এ ধরনের পরিবর্তন ঘটে। ১৯৫১ সালে বিভিন্ন জেলা থেকে আগত কমিউনিস্ট প্রতিনিধিদের এক সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্তে পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি পেটিবুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনুপ্রবেশ করে নিজেদের সংগঠিত করার উপর গুরুত্ব আরোপ করে।
১৯৫০ এর দশকে কমিউনিস্ট ও বামপন্থি রাজনীতিকদের সহায়তায় মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির কৃষক ফ্রণ্ট কৃষক সমিতিতে কৃষকদের সংগঠিত করেন। ১৯৫৪ এবং ১৯৫৭ এ দু বছর বাদে মোটামুটি পুরো সময়টাই কৃষক সমিতি কঠোর দমননীতির শিকার ছিল। ১৯৬২ সালে পাকিস্তানে সামরিক শাসন প্রত্যাহার করা হলে কৃষক সমিতি আরও সক্রিয় ও সুসংগঠিত হয়ে ওঠে এবং দেশের বিভিন্ন এলাকায় শক্তিশালী সংগ্রামী কৃষক র্যালীর আয়োজন করে। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যূত্থানের সময়ে কৃষকরা দেশের বিভিন্ন এলাকায় স্বতস্ফূর্তভাবে জোতদার, গ্রাম্য টাউট, স্থানীয় সরকারের কর্মকর্তা এবং সরকারের উৎপীড়ক কর্মকর্তা-কর্মচারিদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়। কোনো কোনো স্থানে তারা ঘেরাও-পোড়াও কর্মসূচি সংগঠিত করে এবং জনতার আদালত বসায়। কৃষকদের এই নতুন মনোভাবের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে কৃষক সমিতি ‘লাঙ্গল যার জমি তার’ এই শ্লোগানকে জনপ্রিয় করে তোলার চেষ্টা করে। তবে আন্দোলন সংগঠিত করা এবং এসব বৈপ্লবিক চিন্তা-চেতনাকে কোন সশস্ত্র রূপ দিতে পারে নি। কারণ শ্রেণিসংগ্রাম ও জাতীয় স্বাধিকারের আন্দোলনের মধ্যে কোনটি অগ্রাধিকার পাবে তা নিয়ে কমিউনিস্টদের মধ্যে তখন মতভেদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠে।
সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির ২০তম কংগ্রেসের পর আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে বিভক্তির কারণে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিও বিভক্ত হয়ে পড়ে। ভারতীয় কমিউনিস্টদের একাংশ একটি নতুন দল ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) গঠন করে এবং চীনের নীতিকে সমর্থন জানায়। এরপর পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টিতেও বিভক্তি দেখা দেয়। পার্টির চীনপন্থী নেতা-কর্মীরা পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি নামে একটি পৃথক দল গঠন করেন। ১৯৬৭ সালে সিলেটে অনুষ্ঠিত এ দলের প্রথম কংগ্রেসে ‘স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলা’ অর্জনের এক প্রস্তাব গৃহীত হয়। অবশ্য মোঃ তোয়াহা ও আবদুল হকের নেতৃত্বে দলের একটি বড় অংশ পাকিস্তানের রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যেই জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটানোর ধারণায় অটল থাকে। শেষ পর্যন্ত পূর্বপাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টিতেও বিভক্তি ঘটে এবং দেবেন শিকদার, আবুল বাশার, আবদুল মতিন, আলাউদ্দীন প্রমুখের নেতৃত্বে স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলার প্রস্তাবক অংশটি ১৯৬৯ সালের এপ্রিল মাসে ‘পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টি’ নামে একটি আলাদা দল গঠন করে।
১৯৬৭ সালের মে-জুন মাসে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে নকশালবাড়ির কয়েকটি গ্রামে এক কৃষক অভ্যুত্থান ঘটে এবং মার্কসবাদী ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির কিছু ভিন্ন মতাবলম্বী নেতার নেতৃত্বে সশস্ত্র চাষীরা এক ‘সমান্তরাল প্রশাসন’ কায়েম করে এবং কয়েকজন জোতদারের জমি বলপূর্বক দখল করে নেয়। নকশালবাড়ির কৃষক অভ্যুত্থানের উদ্যোক্তারা শ্রেণিশত্রু খতমের রাজনৈতিক কৌশলের ওপর গুরুত্ব দেন এবং সিপিআই (এম) নেতৃত্বকে ‘নয়া-শোধনবাদী’ বলে অভিযুক্ত করেন। চীনপন্থী ভারতীয় কমিউনিস্টদের মধ্যে এ বিতর্ক প্রায় দুবছর চলে এবং পরিশেষে ১৯৬৯ সালের ১ মে এক নতুন পার্টি গঠিত হয়। সিপিআই (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) নামে এ নতুন পার্টি অন্যত্র নকশালবাড়ি ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটাতে শুরু করে। সিপিআই (এম) বিভক্তির পর অচিরেই পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির কর্মকৌশলে পরিবর্তন দেখা দেয়। এ পার্টি ১৯৬৯ সালের জুন মাসে পাবনায় অনুষ্ঠিত কংগ্রেসে সিপিআই (এম.এল)-এর রাজনৈতিক পথ অনুসরণের সিদ্ধান্ত নেয়। ইতোমধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের জাতীয়তাবাদী আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীক হিসেবে প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের অভ্যুদয় ঘটে। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে এ দল বিপুল ভোটে জয়লাভ করে। আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার পক্ষে সক্রিয় উগ্র জাতীয়তাবাদী সদস্যরা গোপনে রাজনৈতিক অঙ্গনে অত্যন্ত সক্রিয় হয়ে ওঠে। ঘটনাবহুল কয়েক মাস অতিবাহিত হওয়ার পর ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তানি সামরিক শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হয়। ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।
মস্কোপন্থী পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রতি সমর্থন জানায় এবং দলের অনেক সদস্য যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। অবশ্য যুদ্ধকালে চীনপন্থী কোনো কোনো উপদলের ভূমিকা ছিল নেতিবাচক। পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির একটি ক্ষুদ্র অংশ মুক্তিযুদ্ধ সমর্থন করে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির একটি অংশ পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীকে সহযোগিতা যোগায় এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে সক্রিয় অবস্থান নেয়। পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি ও পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টি উভয় দলের সঙ্গে জড়িত আরেকটি শাখা স্বাধীনতা যুদ্ধকে পাকিস্তানি বুর্জোয়া ও উঠতি বাঙালি বুর্জোয়ার মধ্যকার লড়াই বলে অভিহিত করে এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধা দুপক্ষকেই জনগণের দুশমন বলে ঘোষণা করে। চীনপন্থী কমিউনিস্টদের একটি স্বতন্ত্র গ্রুপ পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি ছিল একক ব্যতিক্রম। এ পার্টি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। ১৯৬৮ সালের জানুয়ারি মাসে সিরাজ শিকদার এ দল (পূর্ব বাংলার শ্রমিক আন্দোলন) গঠন করেন। ১৯৬৯ সালের শেষদিকে তারা ঢাকায় মাও সে তুং গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। দলটি পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তানের উপনিবেশ হিসেবে চিহ্নিত করে এবং গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানকে মুক্ত করার সংকল্প ঘোষণা করে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর মস্কোপন্থী বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি, সাবেক পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি) জাতিগঠনমূলক কাজে আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে সহযোগিতার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৭২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় কমিটির এক বৈঠকে সিপিবি বৃহত্তর পরিসরে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে প্রগতিশীল ধ্যানধারণা লালনের লক্ষ্যে আওয়ামী লীগের সঙ্গে একযোগে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে আওয়ামী লীগের শাসনের শরীক হওয়ার কারণে দলটি দ্রত জনপ্রিয়তা হারায় এবং কতকটা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। এ সময়ে চীনপন্থী কমিউনিস্ট গ্রুপগুলোর অবস্থারও অবনতি ঘটে। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় ও পরবর্তীকালে এ দলগুলো আরও ভাঙনের শিকার হয়। যুদ্ধকালীন ভূমিকার জন্য তাদের ভাবমূর্তি জনসমক্ষে কালিমালিপ্ত ছিল। যুদ্ধের পর তাদের জনবিচ্ছিন্নতা প্রায় চরম পর্যায়ে পৌঁছায়।
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি ১৯৭২ সালের ৫-৭ মার্চে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ‘শ্রেণিসংগ্রামকে তীব্রতর করে সমাজবিপ্লবের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার’ আহবান জানিয়ে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে। কয়েক মাস ধরে ছাত্রলীগের মধ্যে অন্তর্দলীয় কোন্দল চলতে থাকে এবং ১৯৭২ সালের ২১-২৩ জুলাই দুই প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপের পৃথক কাউন্সিল অধিবেশনে এ বিভক্তি চূড়ান্ত রূপ নেয়। একটি গ্রুপ আওয়ামী লীগের ঘোষিত নীতির প্রতি অনুগত থাকে এবং অন্য গ্রুপ সমাজবিপ্লবের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র অর্জনের অভিপ্রায় ব্যক্ত করে। ঘটনাবহুল কয়েক মাস অতিক্রান্ত হলে ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল জন্ম নেয়। এ দলটির অভ্যুদয় ছিল বিশ শতকের ষাটের দশকে গঠিত ”নিউক্লিয়স” নামক একটি গোষ্ঠী কর্তৃক গোপন রাজনৈতিক কর্মকান্ডের চূড়ান্ত রূপ।
১৯৭৪ সালের অক্টোবর থেকেই বাংলাদেশে রাজনৈতিক অসন্তোষ ও সহিংসতা চরমে পৌঁছায়। জাতি তখন গভীর সঙ্কটের দিকে এগিয়ে চলে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান তখন দেশে গৃহযুদ্ধ পরিহারের লক্ষ্যে চূড়ান্ত পদক্ষেপ হিসেবে একটি একদলীয় রাজনৈতিক পদ্ধতি চালু করার চিন্তা করছিলেন। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর আওতায় রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারপদ্ধতি ও একদলীয় রাজনৈতিক পদ্ধতি প্রবর্তনের জন্য একটি বিল গৃহীত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি হন। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এক আংশিক সামরিক অভ্যুত্থানে তাঁর সরকারের পতন ঘটে।
আগস্ট অভ্যুত্থানের পরে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র বিরোধী শক্তি দেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে অত্যন্ত সক্রিয় হয়ে ওঠে। চীনপন্থী কমিউনিস্টদের একটি অংশ নতুন সরকারকে স্বাগত জানায়। এ অভ্যুত্থান সেনানিবাসের ভেতর ও বাইরে ক্ষমতার রাজনীতি ও চক্রান্তের পথ উন্মুক্ত করে দেয়। ফলত একদল ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তার নেতৃত্বে ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর আরেকটি অভ্যুত্থান সংঘটিত হলে খোন্দকার মোশতাক সরকারের পতন ঘটে। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর ভোরে এক পাল্টা অভ্যুত্থানে ঐ অভ্যুত্থানের নায়কেরা উৎখাত হন। সেদিন সকালে বেতারের এক ঘোষণায় জাসদের সশস্ত্র শাখা ‘বিপ্লবী গণবাহিনী’র উদ্যোগে পরিচালিত ৭ নভেম্বরের ঘটনা ‘বিপ্লব’ বলে উল্লেখ করা হয়। তবে জেনারেল জিয়াউর রহমানের উত্থানের প্রেক্ষিতে এ ‘বিপ্লব’ ইপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছতে ব্যর্থ হয়। জাসদ ‘দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী ও রাষ্ট্রীয় অখন্ডতা বিরোধী’ অভিযোগে অভিযুক্ত হয়। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অনুষ্ঠিত এক গোপন বিচারে ৭ নভেম্বর জাসদের নেতা কর্নেল আবু তাহেরকে ফাঁসি দেয়া হয় এবং জাসদের বহু শীর্ষনেতা কারারুদ্ধ হন।
বাংলাদেশ সরকার সূচনালগ্ন থেকেই সমাজতন্ত্রকে অন্যতম রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। দেশের প্রথম পাঁচসালা পরিকল্পনায় (১৯৭৩-৭৮) এর কিছুটা প্রতিফলন দেখা যায়। অবশ্য ১৯৭৫ সালের পর রাষ্ট্রীয় নীতি মূলত ছিল সমাজের আমূল রূপান্তরের ধারণার পরিপন্থী। [মহিউদ্দিন আহমদ]
গ্রন্থপঞ্জি V Putchkov, Thirty-five Years of Struggle, Communist Party of Bangladesh. (Translated by Mozammel Hossain and Nazrul Islam as Sangramer Poitrish Bachhar-Bangladesher Communist Party, Dhaka, 1983; Sumanta Banarjee, In the Wake of Naxalbari, Calcutta, 1980; K Antonova, G Bongard-Levin and G Kotovsky, A History of India, Book 2, Moscow, 1979; Badruddin Umar, Purba Banglar Bhasha Andolon O Totkaler Rajniti Dhaka, 1970.