বৈদেশিক সম্পর্ক
বৈদেশিক সম্পর্ক প্রতিবেশী দেশসহ অন্যান্য দেশের সঙ্গে সম্পর্কের ধরন ও গতিপ্রকৃতির ধারাবাহিকতার বৈশিষ্ট্যকে একটি দেশের বৈদেশিক সম্পর্ক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি নির্ভর করে তার বৈদেশিক সম্পর্ক বা নীতির ওপর। অবশ্য দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এ সম্পর্ক দেশের স্বার্থে পরিবর্তনযোগ্য। বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর একটি বৈদেশিক সম্পর্ক বা নীতি অনুসরণ করে আসছে, যদিও গত ৪০ বছরে সেই নীতিতে লক্ষণীয় পরিবর্তন ঘটেছে। স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে এর অভ্যুদয়ের পূর্বেই মুক্তিযুদ্ধকালীন অস্থায়ী সরকার বাংলাদেশের বৈদেশিক সম্পর্কের একটি রূপরেখা প্রণয়ন করেছিল।
বৈদেশিক সম্পর্কে অগ্রাধিকার দেশের বৈদেশিক সম্পর্ক রচনার ক্ষেত্র হিসেবে বাংলাদেশ প্রধানত দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্যসহ মুসলিম-প্রধান দেশসমূহ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ শিল্পোন্নত ইউরোপীয় দেশসমূহ, জাপান এবং গণপ্রজাতন্ত্রী চীনকে বেছে নিয়েছে। বৈদেশিক সম্পর্ক মূলত এ পর্যন্ত ক্ষমতাসীন সব সরকারের দ্বারাই এসব দেশে পরিচালিত ও বিস্তৃত হয়েছে। প্রতিটি সরকারের পররাষ্ট্রনীতিতে এসব দেশ বা অঞ্চল সমান গুরুত্ব পায় নি, অর্থাৎ ক্ষমতাসীন সরকার তার মতাদর্শ এবং জাতীয় স্বার্থ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তার অগ্রাধিকার ঠিক করেছে। আওয়ামী লীগ সরকার ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নকে অগ্রাধিকার তালিকার প্রথমে রাখে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের সাহায্য এবং দুদেশের নেতৃত্বের মধ্যে মতাদর্শিক মিলের কারণে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বিশেষ বন্ধুত্বের প্রসঙ্গটি গুরুত্ব পায়। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন এবং সমকালীন বিশ্ব পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশ সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করতে চেয়েছিল।
বিএনপি সরকার তার বিবেচনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং মুসলিম বিশ্বকে তাঁর বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে। এ সরকারের নীতি নির্ধারকগণ বর্ধিষ্ণু অর্থনৈতিক সহযোগিতার কথা বিবেচনা করে বৈদেশিক সম্পর্কে অধিকতর ভারসাম্য আনয়নের লক্ষ্যে মুসলিম প্রধান দেশসমূহের সঙ্গে গতিশীল সম্পর্ক রচনায় উদ্যোগী হন। স্বাধীনতা যুদ্ধে চীনের বিরোধিতা সত্ত্বেও জিয়া সরকার ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের অনুষ্ণ সম্পর্কের কারণে দেশটির বন্ধুত্ব লাভে আগ্রহী ছিল। পূর্ববর্তী সরকারের আমলে পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলেও দু’দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয় জিয়া সরকারের আমলে।
পরবর্তী সময়ে জাতীয় পার্টি এবং বিএনপি সরকার বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে মূলত জিয়া সরকারের অগ্রাধিকারকে অক্ষুণ্ণ রাখে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ককে প্রাধান্য দেয়। ১৯৯৭ সালের এপ্রিল মাসে কাঠমন্ডুতে চার দেশের (বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটান) পররাষ্ট্র সচিবদের বৈঠকে দক্ষিণ এশীয় উন্নয়ন চতুর্ভুজ (South Asian Growth Quadrangle) গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১৯৯৭ সালের ১২ মে মালেতে অনুষ্ঠিত নবম সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে এ ধারণার সমর্থনে সার্কভুক্ত দেশগুলির দুই বা ততোধিক দেশের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার একটি সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছে।
দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বাইরে বাংলাদেশ জাতিসংঘ, জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন, কমনওয়েলথ, সার্ক এবং ওআইসির মতো আন্তর্জাতিক সংগঠনের সদস্যপদ গ্রহণ এবং এদের কর্মতৎপরতার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়। স্বাধীনতার অব্যবহিত পর ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের সদস্যপদ লাভ করে। তবে ১৯৭২ সালে জাতিসংঘের সদস্যপদ চেয়েও ব্যর্থ হয়েছিল চীনের ‘ভেটো’ প্রয়োগের কারণে। অবশ্য পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের মাধ্যমে এবং চীনের সম্মতিতে ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ কমনওয়েলথের সদস্যপদ লাভ করায় পাকিস্তান এ সংগঠন থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। অন্যদিকে ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ায় লাহোরে অনুষ্ঠিত ওআইসির দ্বিতীয় শীর্ষ সম্মেলনে যোগদান করে বাংলাদেশ সংগঠনটির সদস্যপদ লাভ করে। ১৯৭৫ সালে ওআইসির সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ ডি-৮ এবং বিমস্টেক-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে এ দুটি আঞ্চলিক সংগঠনের রূপায়ণ ঘটায়। জাতিসংঘের বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনে বাংলাদেশ সদস্য নির্বাচিত হয়েছে। বাংলাদেশ দুই বছরের জন্য (১৯৭৯-১৯৮০) নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য ছিল।
বৈদেশিক সম্পর্কের বিবর্তন বৈদেশিক সম্পর্ক সৃষ্টির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়। ভৌগোলিক অবস্থান, অভিন্ন ইতিহাস, অর্থনৈতিক অবস্থা এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রীয় অখন্ডতা ও নিরাপত্তার স্বার্থে দক্ষিণ এশিয়াকে প্রথম বিবেচনায় আনতে হয়। এ অঞ্চলের ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভুটান ও মালদ্বীপকে নিয়ে বাংলাদেশ ১৯৮০ সালে সার্কের ধারণাটি তুলে ধরে। সার্কের সূচনালগ্নে বাংলাদেশ প্রণীত পরিকল্পনায় উল্লিখিত ১২টি ক্ষেত্রের মধ্যে যৌথ বিনিয়োগ ও বাজার চালুকরণ ছাড়াও অন্য ১০টি ক্ষেত্রে সহযোগিতা শুরু হয়।
সার্ক ছাড়াও দ্বিপাক্ষিক কাঠামোতে এ অঞ্চলের দেশগুলির সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। তিনদিকে ভারতের অবস্থান হওয়ায় দেশের পররাষ্ট্রনীতিতে ভারত একটি স্থায়ী উপাদান হিসেবে কাজ করে। স্বাধীনতা যুদ্ধে অসামান্য অবদান সত্ত্বেও দেশটির সাথে অচিরে বাংলাদেশ বিভিন্ন ইস্যুতে বিবাদে জড়িয়ে পড়ে। স্বাধীনতার পর সীমান্ত বাণিজ্যচুক্তি, গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা, বাণিজ্যিক ভারসাম্য, সমুদ্র সীমানা চিহ্নিতকরণ বিষয়ে দু’দেশের মধ্যে অনৈক্য দেখা দেয়ায় রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ১৯৭২ সালে স্বাক্ষরিত ২৫ বছর মেয়াদী ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী চুক্তি একটি বিতর্কিত বিষয়ে পরিণত হয়। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তন হলে দু’দেশের সরকারের সমস্যা সমাধানে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি এবং মতাদর্শগত পার্থক্য দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে সংঘাতময় করে তোলে। বিবাদমূলক ইস্যুগুলির মধ্যে গঙ্গার পানি বণ্টনের সমস্যাটি সর্বাধিক জটিল এবং বাংলাদেশের জন্য এটির আশু সমাধানের প্রয়োজন ছিল। স্বাধীনতার পর থেকেই বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে গঙ্গার পানি বণ্টনের প্রশ্নে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা অব্যাহত থাকে এবং ১৯৭৫ সালে ১ বছর মেয়াদি, ১৯৭৭ সালে ৫ বছর মেয়াদি ও ১৯৯৬ সালে ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
ফারাক্কা সমস্যা ব্যতীত ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের মধ্যকার অপর একটি বিষয় ছিল দহগ্রাম ও আঙ্গরপোতা নামে দুটি ছিটমহলকে মূল ভূখন্ডের সঙ্গে যুক্ত করার জন্য ‘তিন বিঘা’ করিডোর হস্তান্তরের দীর্ঘ অমীমাংসিত সমস্যা। এ সমস্যা সমাধানকল্পে ১৯৯২ সালে ভারত বাংলাদেশকে এ শর্তে তিন বিঘা হস্তান্তর করে যে, বাংলাদেশের নাগরিকগণ দুই ঘণ্টা অন্তর অন্তর করিডোরটি ব্যবহার করবে। এ সময়সীমা পরে এক ঘণ্টায় পরিবর্তিত হয়। ভারতের সঙ্গে আরও দুটি বিষয় অমীমাংসিত রয়ে গেছে যার গুরুত্ব দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের জন্য এখনও তাৎপর্য বহন করে। হাড়িয়াভাঙ্গা নদীর মোহনায় অবস্থিত দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপটির মালিকানা নিয়ে ১৯৮১ সাল থেকে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বিরোধ চলে আসছে। অপর দিকে দু’দেশের সমুদ্র সীমানা অচিহ্নিত রয়ে গেছে। ভারতের সাথে ‘পুশব্যাক’ নিয়েও মাঝেমধ্যে সমস্যা হচ্ছে।
দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের মধ্যে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক প্রথম থেকে স্বাভাবিক ছিল না। দু’দেশের মধ্যে শুরু থেকেই বাংলাদেশে আটকে পড়া পাকিস্তানি নাগরিক প্রত্যাবাসন এবং অবিভক্ত পাকিস্তানের সম্পদের ওপর বাংলাদেশের দাবি নিয়ে বিবাদ রয়েছে যা আজ অবধি মীমাংসিত হয় নি। ১৯৭৫ সালের আগস্টের পরে পাকিস্তানের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নের পেছনে ঐ সময়ে ভারতের সঙ্গে সৃষ্ট তিক্ততার প্রভাব ছিল।
নেপাল বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ সীমান্তের দেশ হওয়ায় উভয়ের এমন কিছু স্বার্থ রয়েছে যা দুটি দেশকে কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। বাণিজ্য ছাড়াও বাংলাদেশের জন্য গঙ্গার প্রবাহ বৃদ্ধি এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য নেপালের সহযোগিতা প্রয়োজন। অন্যদিকে নেপালের জন্য কলকাতা বন্দরের ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাসে বাংলাদেশের বন্দরগুলি ব্যবহারের একটি সম্ভাবনাপূর্ণ বিকল্প বিদ্যমান। ভারতের সঙ্গে এ দু’দেশের সম্পর্কে মাঝেমধ্যে উত্তেজনা তাদের আরও কাছাকাছি হতে উৎসাহিত করেছে। এ অঞ্চলের অন্যান্য রাষ্ট্রের মধ্যে ভুটান, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সম্পর্ক ছাড়াও সার্কের আওতায় বাংলাদেশের সহযোগিতার অবকাশ আছে।
বাংলাদেশের নীতি প্রণেতাগণ গোড়া থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে চেয়েছেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতিবাচক ভূমিকা সত্ত্বেও প্রথম সরকারের সময় থেকেই দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের প্রথম সরকারের সমাজতান্ত্রিক নীতি বা সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কারণে প্রথমদিকে বাংলাদেশের ব্যাপারে মার্কিন সরকারের অসন্তুষ্টি ছিল। তা সত্ত্বেও কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকল্প, পণ্য ও খাদ্য, এ তিন ধরনের সাহায্য পাওয়ার জন্য বাংলাদেশ আগ্রহী হয়ে ওঠে। পি.এল ৪৮০-এর মাধ্যমে খাদ্য সাহায্য দেওয়া হতে থাকে। ১৯৭৪ সালে কিউবায় পাটের থলি রপ্তানি করার উদ্যোগ নেওয়া হলে যুক্তরাষ্ট্র খাদ্য সাহায্য প্রদান স্থগিত করে দেয়। বাংলাদেশকে বাধ্য হয়ে কিউবার সঙ্গে বাণিজ্যচুক্তি বাতিল করতে হয়। বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক রপ্তানি শুরু হলে অচিরে যুক্তরাষ্ট্র এ পণ্যের বৃহত্তম বাজারে পরিণত হয়। বর্তমানে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক ভারসাম্য বাংলাদেশের অনুকূলে থাকার পেছনে তৈরি পোশাকের ভূমিকা রয়েছে। সাম্প্রতিক কালে তেল ও গ্যাস আহরণের সম্ভাবনাপূর্ণ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।
অর্থনৈতিক বিবেচনার বাইরে রাজনৈতিক কারণেও দু’দেশের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে। স্নায়ুযুদ্ধকালীন সময়ে দক্ষিণ এশিয়ায় সোভিয়েত প্রভাব হ্রাসের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব ছিল। এছাড়া মার্কিন বৈদেশিক নীতির প্রতি বাংলাদেশের সমর্থন লাভও তার প্রয়োজন ছিল। অন্যদিকে বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন সরকারগুলি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মার্কিন প্রভাবের পরিপ্রেক্ষিতে ঐ দেশের সঙ্গে রাজনৈতিক ও নিরাপত্তামূলক সম্পর্ক গড়তে চেয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ যৌথ সামরিক মহড়া এবং মার্কিন সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তাদের ঘন ঘন বাংলাদেশ সফর এর সাক্ষ্য বহন করে। এদিকে ১৯৯৮ সালের মাঝামাঝি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আমেরিকান সৈন্যদের অবাধ চলাচলের অধিকার চেয়ে ‘সোফা’ (স্টেটাস অব ফোর্সেস অ্যাগ্রিমেন্ট) চুক্তি সম্পাদনের প্রস্তাব দিলে সরকারের অভ্যন্তরে একটি অংশের আপত্তি এবং প্রবল গণবিরোধিতার জন্য শেষ পর্যন্ত তা স্বাক্ষরিত হয় নি। তবে ‘সোফা’ চুক্তি স্বাক্ষর না করলেও বাংলাদেশ ‘হানা’ (হিউম্যানিটারিয়ান অ্যাসিস্ট্যান্স নিডস অ্যাসেসমেন্ট) চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে।
পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলির সঙ্গে বাংলাদেশের কমবেশি অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। এদের মধ্যে ব্রিটেন, জার্মানি, স্ক্যান্ডিনেভীয় দেশগুলির সঙ্গে কারিগরি প্রশিক্ষণ, অবকাঠামো উন্নয়ন, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও পল্লী উন্নয়ন প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকার কারণে বাংলাদেশ সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক গড়ে তোলে। শেখ মুজিব তাঁর বিদেশ সফরের জন্য দ্বিতীয় দেশ হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নকে বেছে নিয়েছিলেন। মুজিবের মস্কো সফরের সময় যে যুক্ত ইশতেহার প্রকাশিত হয়, তাতে এমন সব বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল (ভিয়েতনামের বিপ্লবী সরকারের ৭ দফা দাবি সমর্থন, ইউরোপীয় নিরাপত্তা ও সহযোগিতা সম্মেলন ইত্যাদি) যাতে এমন একটা ধারণার জন্ম হয় যে, বাংলাদেশ তার বৈদেশিক নীতিতে মস্কোঘেঁষা নীতি অনুসরণ করছে। প্রত্যাশা অনুযায়ী বাংলাদেশে সোভিয়েত সাহায্য আশানুরূপ না হলেও, শেখ মুজিবের সময়ে বাংলাদেশ সামগ্রিকভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর নির্ভরশীল ছিল। শেখ মুজিবের পতনের পর এ নির্ভরতা সম্পূর্ণ হ্রাস পায় এবং রাজনৈতিক সম্পর্কও শিথিল হয়ে পড়ে। সম্প্রতি রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন এবং রাশিয়া থেকে সামরিক সরঞ্জাম কেনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে আরবদেশসহ মুসলিম প্রধান দেশগুলির সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার একটা জোরালো উদ্যোগ নেওয়া হয়। বিশেষ করে এ অঞ্চলে পাকিস্তানের অব্যাহত বাংলাদেশ বিরোধী অপপ্রচারের প্রেক্ষাপটে তা জরুরী ছিল। ফলে ধীরে ধীরে এসব দেশ বাংলাদেশের বাস্তবতা মেনে নিয়ে কূটনৈতিক স্বীকৃতি প্রদান করে। আরব বিশ্বের তেল উৎপাদনকারী দেশগুলি ১৯৭৩ সালে তেল অবরোধের ফলে অধিক মূল্যে তেল বিক্রি করে উদ্বৃত্ত অর্থের মালিক হয়। তারা এ অর্থ দিয়ে এশিয়া ও আফ্রিকার উন্নয়নশীল দেশগুলিকে সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নিলে বাংলাদেশ তার সুযোগ নেয়। এসব দেশে সদ্যসৃষ্ট শ্রমবাজারে বাংলাদেশ তার দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিকের কর্মসংস্থানও করে নেয়। সুতরাং ধর্মীয় বিবেচনার পাশাপাশি অর্থনৈতিক কারণে মুসলিম বিশ্ব তথা আরব দেশগুলি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসর্ম্পকে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বিভিন্ন রাজনৈতিক সঙ্কটে এসব দেশের পক্ষে বাংলাদেশ সক্রিয় হয়ে ওঠে। ইসলামী সম্মেলন সংস্থায় (ওআইসি) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন ছাড়াও ফিলিস্তিন ইস্যু, আফগানিস্তানে সোভিয়েত বাহিনীর হস্তক্ষেপ, ইরাক-ইরান যুদ্ধ, কুয়েতে ইরাকি দখলের অবসান প্রভৃতি দ্বিপাক্ষিক বিষয়ে বাংলাদেশ জোরালো সমর্থন জানায়।
জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক মূলত অর্থনীতিভিত্তিক। ১৯৭৯-৮০ সাল থেকে একক বৃহত্তম দাতা দেশ হিসেবে জাপানের আবির্ভাব একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। বাংলাদেশ দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে যে সাহায্য পায়, জাপানের অবস্থান তাতে দ্বিতীয়। অর্থনৈতিক সাহায্যের পাশাপাশি জাপানি বাজারে দেশী পণ্যের প্রবেশ ও জাপানি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করাও বাংলাদেশের লক্ষ্য। এছাড়া বাংলাদেশ তার আমদানি পণ্যের একটি বৃহদংশ জাপান থেকে সংগ্রহ করে। দক্ষিণ এশিয়া সম্পর্কে ক্রমবর্ধমান জাপানি আগ্রহের প্রেক্ষাপটে এ দু’দেশের সম্পর্ক ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশে জাপানি বিনিয়োগের ব্যাপারে কাফকো ব্যতীত উল্লেখ করার মতো কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত না হলেও অন্যান্য শিল্পোন্নত দেশের মতো জাপানকেও বাংলাদেশ তার বাজারে আকৃষ্ট করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
১৯৭৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত যে দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক ছিল না, সেই চীনের সাথে এ সময়ের পর থেকে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হতে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যায় চীন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বিরোধিতা করেছিল মূলত ভারত ও সোভিয়েত বিরাগের কারণে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলেও চীন তা করে নি, বরং পাকিস্তানের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বাংলাদেশকে ভারত অধিকৃত ভূখন্ড বলে আখ্যায়িত করতে থাকে। বাংলাদেশ বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেছে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে। কিন্তু চীন তাতে সাড়া দেয় নি, এমন কি ১৯৭২ সালে জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যভুক্তির বিরুদ্ধে চীন ভেটো দিয়েছিল। ১৯৭৪ সালের ২৮ এপ্রিল পাকিস্তান, ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে চীন জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যভুক্তির ব্যাপারে আর আপত্তি তোলে নি। চীন ১৯৭৫ সালের ৩১ আগস্ট বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। এরপর থেকে দু’দেশের সম্পর্কের দ্রুত উন্নতি হতে থাকে। জাতিসংঘে ফারাক্কা বিষয়টি উত্থাপনেও চীন বাংলাদেশকে সমর্থন দেয়। রাজনৈতিক বিষয় ছাড়াও চীনের সঙ্গে সামরিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সহযোগিতার সূত্রপাত হয়। সশস্ত্রবাহিনী ও নৌবাহিনীকে অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিতে চীন এগিয়ে আসে। দক্ষিণ এশিয়ার আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের নিরিখে এ দু’দেশের সম্পর্ক বিবর্তিত হতে থাকে।
যেকোন দেশের ন্যায় বাংলাদেশের বৈদেশিক সম্পর্ক নিজস্ব স্বার্থে বিকাশ লাভ করছে। বাংলাদেশের বৈদেশিক সম্পর্কে সব দেশ গুরুত্ব না পাওয়ার কারণ হলো এর শাসকগোষ্ঠী শুধুমাত্র দেশের লাভের হিসাব নিকাশের ভিত্তিতেই বৈদেশিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। [আকমল হোসেন]