সোনালী ব্যাংক লিমিটেড
সোনালী ব্যাংক লিমিটেড বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন লিমিটেড কোম্পানিভুক্ত বৃহত্তম বাণিজ্যিক ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক (জাতীয়করণ) অধ্যাদেশ ১৯৭২ মোতাবেক পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত কর্মরত ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান, ব্যাংক অব বাহাওয়ালপুর এবং প্রিমিয়ার ব্যাংক অধিগ্রহণের মাধ্যমে সোনালী ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। সম্পূূর্ণ মালিকানা সরকারের হাতে রেখে উন্নত গ্রাহকসেবা ও সর্বস্তরে দক্ষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে গতিশীল ও সফল পরিচালনার জন্য ১৫ নভেম্বর ২০০৭ তারিখে সোনালী ব্যাংককে কর্পোরাটাইজড করা হয়।
সরকার কর্তৃক নিযুক্ত ১০ সদস্যের পরিচালক পর্ষদের উপর সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ন্যস্ত। ব্যাংকটির প্রধান নির্বাহী হচ্ছেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। তাঁকে সহায়তা করেন তিনজন উপব্যবস্থাপনা পরিচালক, ১৩ জন মহাব্যবস্থাপক এবং অন্যান্য ঊর্ধ্বতন নির্বাহী কর্মকর্তা। প্রশাসনিক বিন্যাসে ঢাকার মতিঝিলে প্রধান কার্যালয় ছাড়াও ঢাকাসহ দেশের ৮টি বিভাগীয় শহরে ৮টি মহাব্যবস্থাপকের কার্যালয় রয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে জেলা শহরে ৪৪টি প্রিন্সিপাল অফিস ও ৪২টি আঞ্চলিক কার্যালয়। দেশের অভ্যন্তরে দুটি ওয়েজ আর্নাস শাখাসহ বৈদেশিক বাণিজ্যের জন্য ৪৩টি অনুমোদিত শাখা (Authorized Dealer) এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৬৮৪টি করেসপন্ডেন্টস-এর মাধ্যমে ব্যাংকের বৈদেশিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়। ১৯৯৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কস্থ ব্যাংকিং ডিপার্টমেন্ট থেকে লাইসেন্স প্রাপ্ত হয়ে সোনালী ব্যাংক ‘ইন্টারন্যাশনাল মানি ট্রান্সমিটার’ হিসেবে নিউইয়র্কে ‘সোনালী এক্সচেঞ্জ কোম্পানি ইনকর্পোরেটেড’ (এসইসিআই) নামে একটি পূর্ণাঙ্গ সাবসিডিয়ারি কোম্পানি স্থাপনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং কার্যক্রম সম্প্রসারিত করে। যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বাংলাদেশিদের বৈদেশিক মুদ্রা নিজ দেশে দ্রুত ও নিরাপদে প্রেরণ করার ক্ষেত্রে সোনালী ব্যাংকের ভূমিকা ক্রমশ বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে নিউইয়র্কের ম্যানহাটনে প্রধান অফিসসহ ব্রুকলিন, এস্টোরিয়া, জ্যাকসন হাইটস, জর্জিয়ার আটলান্টা, মিশিগানের ডেট্রয়েট, ক্যালিফোর্নিয়ার লসএঞ্জেলস এবং নিউ জার্সির প্যাটারসন শাখা/বুথ অফিস স্থাপন করা হয়। এছাড়া সোনালী ব্যাংক লিমিটেড ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের যৌথ মালিকানায় ২০০১ সাল থেকে যুক্তরাজ্যে সোনালী ব্যাংক (ইউকে) লিমিটেড-এর কার্যক্রম শুরু করে। তবে কতিপয় বিধিবদ্ধ কার্যক্রম বাস্তবায়নে ব্যর্থতার কারণে সোনালী ব্যাংক (ইউকে) লিমিটেডের কার্যক্রম ২০২২ সালে বন্ধ হয়ে যায়। এর আগে মোট ৬টি অফিসের (লন্ডন, লুটন, বার্মিংহাম, ব্রাডফোর্ড, ম্যানচেস্টার ও ক্যামডেম) মাধ্যমে এটির কার্যক্রম চালু ছিল। মালয়েশিয়ার মে ব্যাংক-এর মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় কর্মরত বাংলাদেশিরা তাদের অর্থ দেশে প্রেরণ করে; এ ব্যাপারে সোনালী ব্যাংক সহযোগিতা করে। মধ্যপ্রাচ্যস্থ ৪৪টি এক্সচেঞ্জ হাউস-এর মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে বসবাসকারী বাংলাদেশিরা তাদের অর্থ প্রেরণ করে। বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশিদের প্রেরিত অর্থ যাতে তাদের আত্মীয়স্বজন বা মনোনীত প্রতিনিধিরা সহজে ও স্বল্প সময়ে হাতে পান এ লক্ষ্যে সোনালী ব্যাংক লিমিটেড সরকার কর্তৃক ঘোষিত নীতিমালার সাথে সংগতি রেখে রেমিট্যান্সের অন্তঃর্র্মুখী প্রবাহ বৃদ্ধি এবং তা নিরাপদ ও দ্রুততম সময়ে জমাকরণ ও বিতরণের বিষয়ে অনেকগুলি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। পদক্ষেপগুলি হলো: (১) RMS Software প্রবর্তনের মাধ্যমে ৮ ঘণ্টা থেকে ২৪ ঘণ্টায় ৬১টি Outlet-এর মাধ্যমে রেমিট্যান্স বিতরণ; (২) প্রতিটি এক্সচেঞ্জ হাউস/ব্যাংকের জন্য ওয়েজ আর্নার্স কর্পোরেট শাখায় একটি ওয়ার্ক স্টেশন স্থাপন; (৩) ৩০০টি শাখায় IFRMS (Instant Financial and Reconciliation Messaging System)-এর মাধ্যমে তাৎক্ষণিকভাবে বেনিফিসিয়ারির হিসাবে রেমিট্যান্সের অর্থ জমাকরণ; (৪) IFRMS ও RMS পদ্ধতি ছাড়াও অন্যান্য শাখায় কুরিয়ার সার্ভিস যোগে ৪৮-৭২ ঘণ্টার মধ্যে রেমিট্যান্স বেনিফিসিয়ারির হিসাবে প্রেরণ নিশ্চিতকরণ; (৫) প্রধান কার্যালয়ে ৩টি অভিযোগ সেলের মাধ্যমে তাৎক্ষণিক রেমিট্যান্স সংক্রান্ত অভিযোগ নিষ্পত্তি ও তথ্য প্রেরণ; (৬) ৩টি Representative অফিস (কুয়েত, জেদ্দা ও রিয়াদে)-এর মাধ্যমে প্রবাসী বাংলাদেশি ওয়েজ আর্নার্সদের বাংলাদেশে সোনালী ব্যাংকে হিসাব খোলা, স্থিতির নিশ্চয়তাপত্র প্রেরণ, ওয়েজ আর্নার্স বন্ড, প্রিমিয়াম বন্ড, সঞ্চয়পত্র ইত্যাদি কাজে বিনিয়োগে সহায়তা প্রদান; (৭) প্রতি বছর রেমিট্যান্স সেবাপক্ষ উদযাপন; (৮) এন্টি মানি লন্ডারিং বা হুন্ডি নিরোধক আইন সম্পর্কে সকল প্রবাসীকে অবহিত করে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রেরণে উদ্বুদ্ধকরণ, টেলিভিশনে ও সংবাদপত্রে প্রচারণা এবং (৯) বৈদেশিক রেমিট্যান্স প্রেরণকারীগণকে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে পুরস্কার প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ।
আমানত সংগ্রহ ও ঋণদানসহ সোনালী ব্যাংক সকল প্রথাগত ব্যাংকিং ক্রিয়াকলাপ স¤পাদন করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধিরূপে ব্যাংকটি সরকারি কোষাগারের দায়িত্ব পালন করে। ব্যাংকটি খাজনা, স্ট্যা¤প শুল্ক এবং নিবন্ধীকরণ ফি আদায় করে, বিশেষ সঞ্চয়ী হিসাব পরিচালনা করে, সরকারি কর্মচারিদের পেনসন এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের শিক্ষকদের বেতন পরিশোধ করে থাকে। এছাড়া সোনালী ব্যাংক লিমিটেড ওয়েজ আর্নার্স ডেভেলপমেন্ট বন্ড ও সঞ্চয়পত্র ক্রয়বিক্রয়, সরকারি খাদ্যশস্য ক্রয় বিল প্রদান, বিদ্যুৎ টেলিফোন বিল, ওয়াসা বিল, পাসপোর্ট ফিস ও বিদেশ ভ্রমণ কর, আবগারি শুল্ক ও উৎসে কর এবং হজ্জ, যাকাত ও রাষ্ট্রীয় তহবিলের অর্থ গ্রহণসহ নানাবিধ রাষ্ট্রীয় আর্থিক কার্য সম্পাদন করে থাকে। ব্যাংকটি দারিদ্র্য বিমোচন ঋণ কর্মসূচি, নারীদের বিশেষ ঋণ কর্মসূচি এবং পল্লী অঞ্চলে কৃষিভিত্তিক শিল্পঋণ কর্মসূচি নামে আয় উপার্জনে সহায়ক কর্মকাণ্ড এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে কিছু কিছু প্রকল্পে অর্থায়ন করে থাকে। বিগত দুইদশকেরও বেশি সময় ধরে ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহৎ শিল্পখাতে অর্থায়ন করে বাংলাদেশের অগ্রসরমান শিল্পপ্রবৃদ্ধি অর্জনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে সোনালী ব্যাংক লিমিটেড। বৈদেশিক বাণিজ্য এবং উদ্বর্তপত্র-বহির্ভূত (অফ-ব্যালেন্স শিট) কর্মকাণ্ডেও ব্যাংকটি ব্যাপক ভূমিকা রাখছে।
মৌল তথ্য ও পরিসংখ্যান (মিলিয়ন টাকায়)
বিবরণ || ২০১৮ || ২০১৯ || ২০২০ |- |অনুমোদিত মূলধন || ৬০০০০ || ৬০০০০ || ৬০০০০ |- |পরিশোধিত মূলধন || ৪৫৩০০ || ৪৫৩০০ || ৪৫৩০০ |- |রিজার্ভ || ৩৯৫৯৬ || ৩৪৬৪৬.৬ || ৪৯৯২৬ |- |আমানত || ১০৯৩৮৬৬.২ || ১১৫৮৭৮৭.৮ || ১২৫৮৭৮৬.৩ |- |ক) তলবি আমানত || ২৯৮০৭৮.৫ || ৩১৯২৩৫ || ২৯৪১৪৪.৮ |- |খ) মেয়াদি আমানত || ৭৯৫৭৮৭.৭ || ৮৩৯৫৫২.৮ || ৯৬৪৬৪১.৫ |- |ঋণ ও অগ্রিম || ৪৬৪১৬৫.৮ || ৫৫১০২৬.৩ || ৫৮৫৯৩৮.৩ |- |বিনিয়োগ || ৪৪০৯২১.১ || ৫০০৩৮৬.৯ || ৬২৯৯৮৫.৯ |- |মোট পরিসম্পদ || ১৩০৬৮৪২.৩ || ১৪৭২৬০৪.৬ || ১৫৯০৮৩১.২ |- |মোট আয় || ৭৮৩২১.৪ || ৭৭০১৯.৪ || ৮৫৮৯৯.১ |- |মোট ব্যয় || ৫৮০৬৪.১ || ৫৯৭০৯.৮ || ৬৪১১৫.২ |- |বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবসা পরিচালনা || ৩৯২৩০৩.৯ || ৩৯৩১১৩.৮ || ৩১৯৮৯০.৭ |- |ক) রপ্তানি || ৩২৫০২.৬ || ২৫৬৬৫.৬ || ২৫১৭৩.১ |- |খ) আমদানি || ২৫৭০২০.২ || ২৫৫৯৬৫.২ || ১৬৫৬৬২ |- |গ) রেমিট্যান্স || ১০২৭৮১.১ || ১১১৪৮৩ || ১২৯০৫৫.৬ |- |মোট জনশক্তি (সংখ্যায়) || ১৭২৭১ || ১৭৪৮০ || ১৮৯১৮ |- |ক) কর্মকর্তা || ১৪৬৭১ || ১৫১৯৮ || ১৭৬০২ |- |খ) কর্মচারি || ২৬০০ || ২২৮২ || ১৩১৬ |- |বিদেশি প্রতিসংগী ব্যাংক (সংখ্যায়) || ৬৬৯ || ৬৮২ || ৬৮৪ |- |শাখা (সংখ্যায়) || ১২১৫ || ১২২৪ || ১২২৬ |- |ক) দেশে || ১২১৩ || ১২২২ || ১২২৪ |- |খ) বিদেশে || ২ || ২ || ২ |- |কৃষিখাতে |- |ক) ঋণ বিতরণ || ১১৬৩৪.১ || ১৩৯৭৫ || ১২৫৭৭.৫ |- |খ) আদায় || ১২৮৩১.৯ || ১৪৫০২ || ৬৮৯৭.৬ |- |শিল্পখাতে |- |ক) ঋণ বিতরণ || ১০৭২৯ || ৯৩০৫.৪ || ১৩৩২৪.৭ |- |খ) আদায় || ৯৫০৯ || ৯০৩০.৮ || ১৮২৯.৮ |- |খাতভিত্তিক ঋণের স্থিতি |- |ক) কৃষি ও মৎস্য || ৫০০১২.৯ || ৫২৮৩১.৩ || ৫৫৯১.৮ |- |খ) শিল্প || ৬৪৩২৭.৬ || ৬৬৭৮০.৭ || ৬৬৭৮০.৭ |- |গ) ব্যবসা বাণিজ্য || ২৩৫৯৮১.৪ || ২৬০০০০.৭ || ২৮২২৫৩.৮ |- |ঘ) দারিদ্র্য বিমোচন || ৮৮৬২.১ || ৮৭৮৫.৭ || ১১৮৮ |- |সি.এস.আর || ১৯ || ৪৭.৬ || ১৯ |}
উৎস আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, অর্থ মন্ত্রনালয়, বাংলাদেশ সরকার, বার্ষিক প্রতিবেদন , ২০১৯-২০২০ ও ২০২০-২১।
সোনালী ব্যাংক লিমিটেড একটি কার্যক্রমভিত্তিক আয়-ব্যয় বিবরণীর (পারফরমেন্স বাজেটের) মাধ্যমে তার কর্মকাণ্ড পরিবীক্ষণ করে থাকে। এর একটি নিজস্ব বিপণন তথ্যকেন্দ্র রয়েছে। ব্যাংকটি প্রশিক্ষণ ও প্রেষণার (মোটিভেশন) মাধ্যমে মানবস¤পদ উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে থাকে। আর্থিক খাত সংস্কার কর্মসূচির (এফএসআরপি) ভিত্তিতে ব্যাংকটি ঋণঝুঁকি বিশ্লেষণপদ্ধতি প্রবর্তনসহ বেশকিছু নীতিগত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ব্যাংকটির ১৯৯০-এর দশকে গৃহীত ব্যবসায়িক নীতিমালার অন্তর্গত ছিল মূলধন ঘাটতির পরিপূরণ, ব্যাপক আমানত সংগ্রহ সক্রিয়করণ এবং অধিকতর লাভজনক খাতে স¤পদ বিনিয়োগ। কর্মকাণ্ডের পরিধি সম্প্রসারণ এবং সুদ-বহির্ভূত খাতে আয় বাড়ানোর লক্ষ্যে গৃহীত কৌশলের অংশ হিসেবে উদ্বর্তপত্র-বহির্ভূত ক্ষেত্রসমূহে ব্যাংকটির কর্মতৎপরতা যথেষ্ট সম্প্রসারিত হয়েছে।
২০১৯ সালে ব্যাংকের আমানত ও ঋণ অগ্রিমের স্থিতির অংশ ছিল ব্যাংকিং খাতের মোট আমানত ও ঋণ অগ্রিমের স্থিতির যথাক্রমে ৯.১ এবং ৫.১ শতাংশ এবং আমানত ও ঋণ অগ্রিমের গড় সুদহার ব্যবধান দাঁড়ায় ২.২ শতাংশ। [মোহাম্মদ আবদুল মজিদ]