খান, ইয়ার মোহাম্মদ
খান, ইয়ার মোহাম্মদ (১৯২০-১৯৮১) পুরান ঢাকার আদি বাসিন্দা, ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান, বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু, আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা কোষাধ্যক্ষ, যুক্তফ্রন্ট থেকে নির্বাচিত এমপিএ, প্রগতিশীল রাজনীতিতে বিশ্বাসী। ইয়ার মোহাম্মদ খান ১৯২০ সালে পুরান ঢাকার ১৮ নম্বর কারকুন বাড়ি লেনে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম সালেহ মোহাম্মদ খান। তিনি একজন প্রতিষ্ঠিত কন্ট্রাকটর ছিলেন। পাকিস্তান রাষ্ট্রে বিরোধী দলীয় রাজনীতি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এই পরিবারের অবদান অপরিসীম।
ইয়ার মোহাম্মদ খান সেন্ট গ্রেগরি স্কুল থেকে সিনিয়র ক্যা¤্রজি পাস করেন। এরপর তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৪৯ সালের ২৩শে জুন পাকিস্তানের প্রধান ও কার্যকর বিরোধী দল আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে তিনি সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। তিনি দলের প্রতিষ্ঠাতা কোষাধ্যক্ষ নির্বাচিত হন। পাকিস্তান সরকারের রোষানল উপেক্ষা ও ঢাকার নবাব পরিবারের বিপরীতে দাঁড়িয়ে তখন বিরোধী দল গঠন ও তা সংগঠিত করা ছিল রীতিমত দুঃসাধ্য। শুরুতে আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করেত তাঁর ও পুরান ঢাকার আর এক কৃতী সন্তান শওকত আলী ওরফে শওকত মিয়া (১৯১৮-১৯৭৫)-র সাহসী ভূমিকার কথা বঙ্গবন্ধু তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনী (ইউপিএল ২০১২) গ্রন্থের একাধিক স্থানে উল্লেখ করেছেন।
আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার পর এর সভাপতি মওলানা ভাসানী ঢাকায় ইয়ার মোহাম্মদ খানদের বাড়িতে থাকতেন। এক সময় বাড়ির নীচতলায় ছিল আওয়ামী লীগের অফিস। সেখানে হল রুমে দলের সভা হতো। হোসেন শহীদ সোহ্্রাওয়ার্দী সে সভায় যোগ দিতেন। ১৯৪৯ সালে মওলানা ভাসানী সাপ্তাহিক ইত্তেফাক পত্রিকা প্রকাশ শুরু করলে ইয়ার মোহাম্মদ খান তাতে অর্থায়ন করেন। ১৯৫১ সালে পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ গঠিত হলে ইয়ার মোহাম্মদ খান এর অন্যতম সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে তিনি পুরান ঢাকা থেকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৫৪ সালে শেরে বাংলার যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা বাতিল ও একমাত্র মন্ত্রী বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হওয়ার পর তাঁর অনুরোধে মুজিব পরিবারের জন্য ইয়ার মোহাম্মদ খান ঢাকায় বাসা বাড়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবকে নিয়ে জেল গেইটে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে এসে তিনি গ্রেপ্তার হন।
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইয়ার মোহাম্মদ খান প্রগতিশীল রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। ১৯৫৭ সালে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের বিখ্যাত কাগমারী সাংস্কৃতিক সম্মেলন (টাঙ্গাইল) প্রস্তুতি কমিটির তিনি যুগ্ম-কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। সম্মেলনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঘেঁষা পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে সোহ্্রাওয়ার্দীর সঙ্গে মওলানা ভাসানীর স্পষ্টত বিরোধ দেখা দেয়। এর জের ধরে আওয়ামী লীগের ৮ জন এমপিএসহ যে ৯ জন কেন্দ্রীয় নেতা মওলানা ভাসানীর জোট নিরপেক্ষ নীতির সমর্থনে দল থেকে পদত্যাগ ঘোষণা করেছিলেন, ইয়ার মোহাম্মদ খান ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। একই বছর জুলাই মাসে দুদিন ব্যাপী ঢাকায় অনুষ্ঠিত কর্মী সম্মেলনে মওলানা ভাসানীকে সভাপতি করে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠিত হলে, ইয়ার মোহাম্মদ খান দলের কোষাধ্যক্ষ নির্বাচিত হন। স্মর্তব্য, এর পূর্বে তিনি আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ ও ঢাকা সিটি আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। নতুন দল গঠনের পর কিছু দিন সক্রিয় থাকলেও ক্রমান্বয়ে তিনি নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। তিনি ১৯৮১ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর স্ত্রীর নাম বেগম জাহানারা খান। তিনিও প্রয়াত। এ দম্পত্তির বর্তমানে ৫ কন্যা ও ১ পুত্র সন্তান রয়েছে। [হারুন-অর-রশিদ]
তথ্যসূত্র হারুন-অর-রশিদ, বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী পুনর্পাঠ, (ইউপিএল ২০১৩)।